দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আজ বৃহস্পতিবার সহিংসতায় মোট সাতজন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে দুজন নিহত হন। একজন করে নিহত হয় ঢাকা, যশোর, মাদারীপুর, জামালপুর ও নাটোরে ।
এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় অনেকে আহত হয়েছেন। নির্বাচনে জালভোট ও প্রার্থীদের ভোট বর্জনের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
দ্বিতীয় ধাপে ৬৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আজ বৃহস্পতিবার সকালে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। বিকেল চারটায় তা শেষ হয়েছে। এখন চলছে ভোট গণনা। ভোট গণনা শেষে ফল ঘোষণাও শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার বাউরিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে মো. সানাউল্লাহ (৪২) ও মো. ইব্রাহীম (৪০) নামে দুজন নিহত হয়েছেন। ভোট গ্রহণের শেষ পর্যায়ে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে এই ঘটনা ঘটে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, বিকেলে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জামাল উদ্দিন ও বিদ্রোহী প্রার্থী জিল্লুর রহমানের সমর্থকেরা চর বাউরিয়া স্কুল কেন্দ্র দখল করতে আসেন। এ সময় দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ওই দুজন নিহত এবং পুলিশের এক সদস্যসহ দুজন গুলিবিদ্ধ হন। জামাল উদ্দিন নামের গুলিবিদ্ধ ওই ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৭টি গুলি ছোড়ে পুলিশ। পরে পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধার করে থানায় নিয়েছে।
তবে নিহত সানাউল্লাহর চাচাতো ভাই মো. বেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সানাউল্লাহ ভোট দেওয়ার জন্য গত রাতে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ এসেছিলেন। বেলালের অভিযোগ, সদস্য পদপ্রার্থী মো. কাওছার আলম শাহেদ ও চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জিল্লুর রহমানের সমর্থকেরা কেন্দ্রের উত্তর দিক থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে কেন্দ্র দখল করতে আসেন। এই গুলিতেই তাঁর চাচাতো ভাইসহ দুজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও একজন।
যশোর সদর উপজেলার চাঁচরা ইউনিয়নের ৬৫ নম্বর চাঁচড়া ভাতুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে হামলা ও সংঘর্ষে আবদুস সাত্তার নামের এক ফেরিওয়ালা নিহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এই ঘটনা ঘটে।
যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষে আবদুস সাত্তার নিহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ গুলি চালিয়েছে।
তবে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুল করিমের অভিযোগ, বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল আজিজ বিশ্বাসের সমর্থকেরা কেন্দ্র ও এর আশপাশ এলাকায় হামলা চালিয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে ইউপি নির্বাচনে ভোট চলাকালে গুলিতে এক শিশু নিহত হয়েছে। সকাল ১০টার দিকে মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত শিশুটির নাম শুভ কাজী (৯)। সে মধুরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার বাবা হালিম কাজী। তিনি পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। বাড়ি ওই ইউনিয়নের ঢালিকান্দি গ্রামে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের ভাষ্য, রানা মোল্লা নামের এক ব্যক্তি ২৫ থেকে ৩০ জন লোক নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। তাঁরা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারার চেষ্টা চালান। এ সময় আতঙ্কে ওই কেন্দ্রের লোকজন ছোটাছুটি করতে থাকেন। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়লে শুভ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, মা সুবর্ণা বেগমের সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল শুভ।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, রানা আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আনোয়ার হোসেন আয়নালের লোক হিসেবে পরিচিত। নিহত শুভর বাবা হালিম বলেন, ‘ভোটের কারণে আমার ছেলেটা মারা গেল।’
এই ইউনিয়নে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল হক।
মাদারীপুর সদর উপজেলার ধুরাইল ইউপি নির্বাচনের ফলকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুই মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় সুজন মৃধা (২২) নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। পরিবারের অভিযোগ, সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে সুজন মারা গেছেন।
নিহত সুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র। তিনি ধুরাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ বিরঙ্গল গ্রামের বাচ্চু মৃধার ছেলে। তিনি মেম্বার পদপ্রার্থী মোতালেব মৃধার নাতি। মোতালেব মৃধা সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘নির্বাচনে আমি বিজয়ী হই। আমার ভোট কারচুপি করে আয়ুব আলীর সমর্থকেরা জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা ব্যালট পেপার ছিনতাই করেন। পুলিশ আমার সমর্থকদের ওপর হামলা চালান। পুলিশের গুলিতে আমার নাতি মারা গেছেন।’
মাদারীপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা অখিল সরকার সাংবাদিকদের বলেন, সুজনের গলায় গভীর ক্ষত রয়েছে। আঘাতটি গুলির মতো মনে হচ্ছে।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সরোয়ার হোসেন বলেন, দুই মেম্বার পদপ্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। সেখান থেকে অনেক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ কোনো গুলি ছোড়েনি। তবে কীভাবে ছেলেটি মারা গেছে, তা তদন্ত না করে বলা যাবে না।
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নে নির্বাচনী সংঘর্ষের সময় ভয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক বৃদ্ধ ভোটারের মৃত্যু হয়েছে। ওই বৃদ্ধের নাম রফিকুল ইসলাম (৫২)। জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শরিফুল হক বলেন, ইউনিয়নের উত্তর বালুর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই ইউপি সদস্য মোকছেদ আলী ও মর্জিনা বেগমের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ভোট দিতে আসা রফিকুল আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরে ওই কেন্দ্র থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে নিজ বাড়িতে গিয়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এদিকে আজ সকাল নয়টার সময় লালপুর উপজেলা আড়বাব ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রঘুনাথপুর এলাকায় ধানের শীষ ও নৌকার সমর্থকদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে নৌকার সমর্থকেরা ধারালো হাঁসুয়া নিয়ে বিপ্লব এবং তাঁর অপর দুই ভাই ও এক বোনকে কোপায়। স্থানীয় লোকজন বিপ্লবকে গুরুতর অবস্থায় প্রথমে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে রাজশাহীর সিডিএম হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে তিনি মারা যান। সিডিএম হাসপাতালের পরিচালক কোয়েল চৌধুরী জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বিপ্লবের মৃত্যু হয়। থানার ওসি আবদুল হাই জানান, একজনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।
গত ২২ মার্চ প্রথম ধাপে ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীক ও দলীয় মনোনয়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মোট ছয় ধাপে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শেষ ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৪ জুন।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা)