একজন শিক্ষক যদি ধর্ষণ করেন, ঘুষ খান, বা একই কাজ যদি কোনো সরকারি-বেসরকারি অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী করেন তাহলে সেই দোষ, দায়িত্ব একান্ত যার যার। কিন্তু কোনো বাহিনীর সদস্য যদি এ ধরনের গর্হিত কোনো কাজে জড়িত হয়; তখন সেই অকাজের দায়দায়িত্ব গিয়ে পরে পুরো বাহিনীর উপর। সে কারণে বাহিনীর সদস্যদের অত্যন্ত সজাগ থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
পুলিশের বিষয়ে যদি বলি- দিনাজপুরে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সময় আমিও পুলিশে ছিলাম। কয়েকজন দুশ্চরিত্র পুলিশের জন্য অশান্ত হয়েছিল দিনাজপুর জেলা। মারা গিয়েছিল কয়েকজন, আহত হয়েছিল অনেকে। শুধু তাই নয়, যেসব পুলিশের সদস্য এসবের কিছুতেই জড়িত ছিল না আক্রান্ত হয়েছিল তাদের পরিবার পরিজনও।
সে সময় দিনাজপুর থানার দায়িত্বে ছিলো আমার ব্যাচের মাহতাব। আমাদের ৮৮ ব্যাচের সবচেয়ে ভালো এবং ভদ্র ছেলে সে। আমরা যে ক’জন ভার্সিটিতে পড়ে পুলিশে যোগ দিয়েছিলাম সে ছিলো তাদের অন্যতম। সে রাজশাহী ভার্সিটির ছাত্র ছিলো। অথচ হলো কি ‘ল্যাক অব সুপারভিশন’ এর কারণে চাকরি গেল জেলার এসপি এবং ওসি’র দায়িত্বে থাকা মাহতাবের। সে অবশ্য অনেকদিন পর চাকরি ফিরে পেয়েছিল।
এ কারণেই আমি যখন বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালন করেছি তখন অধীনস্থদের কাজকর্ম নিয়ে খুবই সজাগ থাকতাম। না হয় তাদের কারো অপকর্মের ফল তো ভোগ করতে হতো আমাকেও। কারো কোনো অভিযোগের বিষয় আমার গোচরীভূত হবার সাথে সাথে আমি বিষয়টা জিডি করে জেলার এসপিকে অবহিত করতাম, প্রয়োজনে বদলী করার ব্যবস্থা করতাম।
যেসব অফিসার এসব খেয়াল করে না তাদের ইউনিটের কেউ কেউ ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে বড় অঘটনে জড়িয়ে পড়ে। এবং একদিন তার বিস্ফোরণ হয়। এই যে দেশে হঠাৎ হঠাৎ কোনো কোনো পুলিশ সদস্যের কাজে পুলিশের দুর্নাম হচ্ছে সেটা একদিনের পরিণতি নয়, বাড়তে বাড়তে একদিন প্রকাশ হচ্ছে মাত্র।
সম্প্রতি পেপার আর টিভিতে যে বিষয়টা নিয়ে আলাপ হচ্ছে সেটা হলো মাসুদ সিকদার নামের একজন এসআই বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার গোলাম রাব্বীকে কোনো কারণ ছাড়াই রাতের বেলা রাস্তা থেকে উঠিয়ে থানায় নিয়ে মারধর করে এবং টাকা দাবী করে ছেড়ে দেবার জন্য।
যার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পুলিশের আইজিপি বরাবর পত্রপ্রেরণ করেছেন অভিযুক্ত এসআইয়ের শাস্তি চেয়ে, যা পুলিশের জন্য মোটেও সুখকর বিষয় নয়। বর্তমান আইজিপি মহোদয়ের অধীনে আমিও চাকরি করেছি, তিনি তখন চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি ছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশে যে কজন ঘুষমুক্ত সৎ অফিসার আছেন, তিনি তাদের একজন। আশা করি অভিযুক্ত এসআই তার অপরাধের সাজা পাবে।
ঘটনাটা ঢাকা মেট্রো এলাকায়। মেট্রো এলাকায় আমিও চাকরি করেছি। তখন দেখেছি পুলিশ রাতের বেলা পেট্রোলিং করার সময় সন্দেহজনক লোক দেখলে গ্রেফতার করে, এটা অবশ্য পুলিশি কার্যক্রমের মধ্যেই পড়ে। তবে পরোয়ানা ব্যতিত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে হলে ফৌজদারি কার্যবিধি ৫৪ ধারাসহ আরও যে যে আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায় সেসব আইনের শর্ত অবশ্যই মেনে তা করতে হয়। কারণ কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা মানে সেই ব্যক্তির যে দিকে খুশি যাওয়া বা চলাফেরা করার মৌলিক অধিকার রহিত করেই তাকে গ্রেফতার করতে হয়। সুতরাং এখানে আইনের শর্তসমূহের শীতলতা গ্রহণযোগ্য নয়। মনের ইচ্ছায় বা রাগ অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সুযোগ নাই। তাছাড়া কোনো ব্যক্তিকে যখন বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা হয় তখন উচিত হয়, অনতিবিলম্বে তার বিষয়ে তদন্ত সমাপ্ত করা। যাতে নিরাপরাধ ব্যক্তি দীর্ঘক্ষণ বা দীর্ঘদিন আটকের সম্মুখীন না হয়। এখন সন্দেহজনকভাবে আটক ব্যক্তিকে যদি জেলে পাঠানোর ১৫ বা ৩০ দিন পর যদি নির্দোষ মর্মে রিপোর্ট দেয়া হয়, তাহলে সেই নির্দোষ ব্যক্তির ১৫ বা ৩০ দিন জেলে আটক থাকার দায় কার? দায় নিশ্চয় পুলিশের।
আইনে যদিও পুলিশকে দায়ী করা যায় না, কিন্তু যিনি আটক ছিলেন তিনি বা তার আত্মীয়স্বজন তো আর পুলিশী তদন্তে আস্থা রাখতে পারবে না কিছুতেই। আস্থা হারাবে দেশের মানুষও। তাহলে উপায়? উপায় হলো বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা ও তদন্তের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে আইন প্রণয়ন করা যাতে নিরীহ লোক হয়রানি না হয়, দোষী যেন ছাড় না পায়। এ বিষয়ে আরও যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা আজ মনে পড়ছে তা হলো, সরকারি দল সব সময় চায় তার বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলে তাদের যেন কার্যবিধি ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে ব্যবস্থা নেয়া হয়। সরকারের এ আচরণও পাল্টানো দরকার। অর্থাৎ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের আইন যেন বিতর্কিত না হয় কোনোভাবেই।
মেট্রো এলাকায় দেখা যায় অনেক অফিসার সন্দেহজনক আসামী গ্রেফতার করে আসামীকে থানায় না এনে পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে সারারাত ঘুরছে, তারপর সকালে থানায় আসার সময় হলে কিছু ছাড়ছে কিছু রাখছে। এখানে অর্থের বিনিময় মানুষ সরাসরি দেখে এবং প্রকাশ করে। এ অভ্যেস থেকে পুলিশের সরে আসতে হবে। তবে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার যেমন করতে পারে, তেমনি ছাড়তেও পারে। এই ছাড়তে পারার সুযোগটাই পুলিশ খারাপভাবে ব্যবহার করে মাঝে মাঝে। কিন্তু পুলিশ যদি কাউকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার করার পর তাৎক্ষণিক তদন্তে যদি পায় যে লোকটি ভালো, সে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছিল, সঠিক ঠিকানাও যদি পাওয়া যায় তাহলে পরবর্তীতে যদি প্রয়োজন হয় হাজির হবার মুচলিকা নিয়ে অনতিবিলম্বে ছেড়ে দেয়াই ভালো, তাহলে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি আর অভিযোগ তুলবে না।
আর যদি দ্রুত তদন্ত অর্থের বিনিময়ে হয়, তাহলে সেই তদন্তে কোনো লাভ নেই। মানুষ বিরক্ত হবেই। পুলিশের এসআই সিকদার এই কাজটিই করতে চেয়েছিল যে টাকা দিলে ছেড়ে দিবে, না হয় মামলায় দিবে। যেকারণে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিসহ দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। পুলিশের যেসব অফিসার এসব কাজ করে তারা একদিনে বেড়ে উঠে না। এ ধরনের কাজ করতে করতে তারা বেড়ে উঠে, ধরাকে সরা জ্ঞান করে, তারপর একদিন পুরো বাহিনীর বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। থানায় চাকরি করতে এরকম অনেক অফিসার দেখেছি আমি। যাদের দাপটে থানায় অন্যান্য অফিসারের চাকরি করাই দায় হয়ে পড়ে। থানার ওসি যদি এসব বিষয় খেয়াল না রাখে তাহলে একদিন পাহাড় সমান বিপদ তার মাথার উপর এসেই পড়ে।
অফিসারেরা কেন এমন হয়?
দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি করে দেখেছি- পুলিশে কনস্টেবল থেকে উচ্চ পদস্থ অফিসারদের মধ্যে সৎ ও ভালো লোক হাতে গোনা। নাম বলা যায় মুখস্থ, কারণ সংখ্যা অতি অল্প। পুলিশে চাকরি করলে এরকম একটা ধারণা যদি কাজ করে- বেতনের টাকায় যদি চলতে হয় তাহলে আর পুলিশে চাকরি করা কেন? নয়টা-পাঁচটার একটা সিভিল চাকরি করলেই হয়। আজকাল অবশ্য শুধু পুলিশ কেন সরকারের সব বিভাগের লোকেরাই অবৈধ আয় করছে দেদারছে। কিন্তু অন্যদের আয়টা হল সরকারি টাকার আত্মসাৎ, আর পুলিশের টাকাটা আসে সরাসরি পাবলিকের পকেট থেকে। তাই প্রচার পায় সরাসরি।
আবার পুলিশ প্রসঙ্গে আসি। পুলিশের পদোন্নতি থেকে পোস্টিং কোনো কিছুই বিনে পয়সায় হয় না (দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে)। কনস্টেবল থেকে এএসআই, এএসআই থেকে এসআই সব পদোন্নতিতে অনেক টাকার লেনদেন হয়, ভুক্তভোগীরা তা জানে, জানে তাদের পরিবারের সদস্যরাও। তারপর পোস্টিং এর জন্য ব্যয় করতে হয় লাখ লাখ টাকা। পুলিশের উর্দ্ধতন অফিসারেরা এই টাকা নেয়। নিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। তারপর সেই অফিসার যখন থানায় যায় সে তার বিনিয়োগের টাকা উঠিয়ে নেবার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে ওঠে। পারলে তো পারলো, ধরা খাইলে শেষ। সে টাকা যদি উঠাতে না পারে সিনিয়র অফিসার তো আর তার টাকা ফেরত দিবে না। সুতরাং ঝুঁকিতে থাকে ছোটরাই। আর যদি কেউ ধরা খায় তাহলে বিচারও করে সেই সিনিয়র অফিসারই। এ যেন ‘সর্প হইয়া দংশন করে আর ওঝা হইয়া ঝাড়ে’ র মতো কারবার।
আবার এমনও দেখা যায়- অনেক এসপি, ডিআইজি থানা পর্যায়ে পোস্টিং এ বা পদোন্নতিতে টাকা নেয় না, কিন্তু বিনে টাকায় পোস্টিং নিয়ে থানায় আসা সেসব অফিসার যে ঘুষ দুর্নীতি মুক্ত থাকছে তাতো নয়।
অসৎ অফিসার যেভাবে বেড়ে ওঠে
অপরাধপ্রবণ পুলিশ অফিসারেরা যেভাবে বেড়ে ওঠে সেটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এরা চাকরিতে প্রবেশ থেকে শুরু করে পদোন্নতি সবই পায় অস্বচ্ছভাবে। টাকার বিনিময়ে অথবা প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীর মাধ্যমে তারা এসব আদায় করে। এই প্রভাব পতিপত্তির কারণে ওইসব অফিসার ধরাকে সরা জ্ঞান করে, মানে না চেইন অব কমান্ডও। পুলিশের কোনো সদস্য যদি এভাবে প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক সুবিধা আদায় করে নিতে পারে, তখন সে বুঝতে পারে তাকে আর ঠেকায় কে? তখন সে জড়িয়ে পড়ে আইন বহির্ভূত নানা কর্মকাণ্ডে। এরাই সেই এসি আকরাম, এরাই সেই এসআই মাসুদ সিকদার। এরাই সেসব অফিসার যারা ডিএমপি ডিবি’র সোর্সকে মেরে পানির ট্যাঙ্কে ঢুকিয়ে রেখেছিল। এ ধরনের অফিসারের দাপট এখনো পুলিশে কমেছে বলে মনে হয় না, ক্রসফায়ার নামক উদ্ভট ফর্মুলার কারণে মনে হয় আরও বেড়েছে।
মানুষ ক্ষিপ্ত কেন?
দেশের মানুষ মুলত সরকারি সেবা দানকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের উপরই খুশি নয়। খুশি থাকার মতো কোনো সেবাও অবশ্য জনগণকে তারা দেয় না। সীমাবদ্ধতার কারণে দিতে না পারা এবং আন্তরিকতার অভাবে না দেয়ার পার্থক্য দেশের মানুষ বোঝে। সরকারি সেবা খাতের মধ্যে পুলিশী সেবা এবং চিকিৎসা সেবার ফলাফল জনগণ হাতেনাতে পায়, যা অন্য সেবাসমূহের বেলায় প্রযোজ্য নয়। মানুষ নিতান্ত বিপদের মুহূর্তে পুলিশের থানায় এবং ডাক্তারের হাসপাতালে যায়। এই দু’ক্ষেত্রে যদি মানুষ সেবা না পায়, উপরন্তু দুর্ব্যবহার পায় তাহলে মানুষ সেটা ভোলে না। একজন প্রকৌশলী যখন এক কোটি টাকার ব্রীজ পঞ্চাশ লক্ষ টাকায় বানিয়ে বাকি টাকা মেরে দেয় সেটা জনগণ সাথে সাথে দেখে না, যখন ব্রীজের ভেঙ্গে পড়া দেখে তখন সময় অনেক বয়ে যায়। পুলিশি সেবা যেহেতু তাৎক্ষণিক বিষয়, সেহেতু মানুষ সেটা সঠিকভাবে না পেতে পেতে মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। যখন কোনো কারণে বিস্ফোরণ হয় তখন তাদের সেই আগের পুঞ্জিভুত ক্ষোভও তার সাথে যোগ হয়।
যারা অপরাধ প্রবণ
অপরাধ প্রবণ পুলিশ অফিসারেরা লেখাপড়া তেমন করে না। বিসিএস অফিসারে মধ্যে যারা ঘুষপ্রবণ তারাও লেখাপড়ায় তেমন সুবিধের নয়। তবে পরীক্ষা পাশের পড়ালেখা তারা জানে, তার বেশি নয়। আর কেউ কেউ পড়ালেখা জানলেও জনগণের মনোজগতের ভাবনা তারা বোঝে না। আমি পুলিশের এক বিদায় অনুষ্ঠানে বলেছিলাম- কোনো অফিসার যখন বদলী হয়ে আসেন তিনি কয়েক ব্যাগ কাপড় চোপড় এবং এক ব্যাগ জুতা নিয়ে আসেন, কিন্তু নিয়ে আসেন না একটা আইনের বইও। কারণ ব্যাগে জায়গা থাকে না। এটা বড় দুর্ভাগ্য পুলিশের।
অধিক সংখ্যক পুলিশ অফিসার আজ বাইরের অন্যান্য বই দূরে থাক নিজের প্রয়োজনে আইনের বই পর্যন্ত ভালোভাবে পড়ে না। পড়ে না এজন্য যে, ভালো আইন জানা না জানা নিয়ে তো আর ভালো পোস্টিং হবে না, ভালো পোস্টিং পেতে দরকার টাকা আর সরকার দলীয় নেতার সুপারিশ। বিএনপি’র গত আমল থেকে রীতি চালু হয়েছে সংশ্লিষ্ট থানার এমপি মহোদয়ের মতামত ছাড়া তার থানায়/ উপজেলায় ‘ওসি’ আর ‘টিএনও’ পোস্টিং দেয়া যাবে না। এ নিয়ম চালু রেখেছেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও। ফলে দিনে দিনে পুলিশ অফিসারেরা হয়ে পড়েছে নেতা নির্ভর, আইন নির্ভর নয় কোনোভাবেই। আর এই নিয়মকে স্থানীয় এমপি বা এমপি মহোদয়ের ভাইয়েরা ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছে। চট্টগ্রামে এক মন্ত্রীর ভাই তো সিএমপি তে ‘ওসি’দের পোস্টিং এর বাণিজ্য করতো। চাকরিতে থাকতে সে আমাকেও একবার পোস্টিং এর প্রস্তাব দিয়েছিল, আমি রাজি হইনি। এই আইন না জানা অফিসারেরা থানায় নেতার চ্যানেলে আসে, নেতার কথামত কাজ করে পুলিশের দুর্নাম বাড়ায়। তারপর এক সময় ক্ষমতার বদল হলে তারাও বদলে যায়। বদলে গিয়ে নতুন ক্ষমতার নতুন নেতার কাছে তদবীরে যায়। পালটিয়ে ফেলে আগের খোলস।
প্রত্যেক থানাতেই দুয়েকজন অপরাধপ্রবণ অফিসার থাকে। এদের যখন সিনিয়র অফিসারেরা সনাক্ত করতে না পারে, আর যদি সনাক্ত করতে পেরেও প্রশ্রয় দেয় তখন তারা ফুলে ফেঁপে উঠে। সেই ফুলে ফেঁপে উঠার বিষফল একদিন পুরো পুলিশ বিভাগকেই খেতে হয়। সেই ফুলে-ফেঁপে ওঠা পুলিশেরা হলো এসি আকরাম, দিনাজপুরের সেই পুলিশেরা, সোর্সকে মেরে পানির ট্যাংকে ঢুকিয়ে রাখা অফিসারেরা এবং সদ্য পাওয়া গেল এসআই মাসুদ সিকদারকে।
ক্ষতিকর সোর্স
এক সময় পুলিশের তথ্য প্রদানকারী ভালো সোর্স আর নাই। এখন যেসব সোর্স থানায় দেখা যায় সবাই ধান্ধাবাজ, মতলববাজ। থানায় যেসব অফিসার টাকা আয়ের ধান্দায় থাকে ওদের পেছনে এইসব সোর্স ঘোরাফেরা করে। এরা অপরাধী গ্রেফতারের খবর আর আনে না, আনে কোন কাজে আয় হবে সেইসব খবর। তাছাড়া যেহেতু তারা এলাকার লোক ওদের সাথে যদি কারো সম্পর্ক খারাপ থাকে তাহলে তারা সেই লোককে অপরাধী পরিচয় দিয়ে থানায় গ্রেফতার করায়। নির্যাতন করার পাঁয়তারা করে অফিসারকে নানা কথা বোঝায়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার গ্রেফতারের পেছনেও সেরকম কোনো বাজে সোর্সের কারসাজি থাকতে পারে। কিন্তু আমার কথা হলো যে পুলিশ অফিসার সোর্সের নিকট থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই না করে কাউকে গ্রেফতার করে ফেলে সেই অফিসার দক্ষ কোনো অফিসারই নয়। তার তথ্য মূল্যায়নের কোনো ক্ষমতাই নাই। এসআই মাসুদের বিষয়ে যারা তদন্ত করছেন তাদের এই দিকটাও খেয়াল রাখা দরকার।
শেষ কথা
রাত্রিকালে পেট্রোলিং করার সময় পুলিশের নজরে যদি কোনো সন্দেহজনক ব্যক্তি পড়ে তাহলে তাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে, রাত্রিকালে ঘোরাফেরা করার কারণও জানতে চাওয়া যেতে পারে, এবং জবাব যদি সন্তোষজনক না হয় কার্যবিধি ৫৪ ধারা মতে গ্রেফতারও করা যেতে পারে। কিন্তু যদি জানা যায় তিনি টিভিতে খবর পড়েন, বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেন তাহলে তো সেই ব্যক্তিকে আর গ্রেফতারের কারণ থাকে না। তারপরও যদি সন্দেহ থেকেই যায় তাহলে গ্রেফতারের পর দ্রুত তদন্ত শেষ করে সেই ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া জরুরি। এখানে গোলাম রাব্বীর বিষয়ে সেটা করা হয়নি, যদি করা হতো এত কথা আর উঠতো না। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ‘ইয়াবা’ ব্যবসায়ী বানিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ। যা পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। এসব অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে ওই এসআই’র পুলিশে চাকরি করার আর অধিকার থাকে না। শুধু তাই নয় দেশের একজন নাগরিককে অন্যায় আটকের জন্য তার সাজা হওয়াও প্রয়োজন।
সবশেষে বলব, এসব অসৎ অফিসার তৈরির পথ বন্ধ করতে হলে সিনিয়র অফিসারদের পদোন্নতি বাণিজ্য, পোস্টিং বাণিজ্য বন্ধ করা দরকার। না হয় পোস্টিং এর জন্য অগ্রিম টাকা নিয়ে সেই অফিসারকে সৎ হতে বলা অর্থহীন। সরকার যখন পুলিশের সুযোগ সুবিধা অনেক বাড়িয়েছে তখন পুলিশেরও দরকার সেই প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার প্রতিদান দেয়া। থানায় থানায় এমপি/মন্ত্রীর মনোনীত পুলিশ অফিসার বাদ দিয়ে সিনিয়র অফিসারদের জানা মতে ভালো ও যোগ্য অফিসারদের নিয়োগ দেওয়াও আজ জরুরি।