মরণ নেশা ইয়াবার চোরাচালান কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। স্থল ও সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই আসছে একের পর এক ইয়াবার চালান। ২০১৫ সালে শুধু কক্সবাজার জেলা পুলিশই উদ্ধার করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪৬ পিস ইয়াবা। এসময় গ্রেফতার করা হয়েছে ৮২৯ জন ইয়াবা পাচারকারীকে। মামলা হয়েছে ৬৬০টি। ইয়াবা প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর জিরো টলারেন্স নীতি বলবৎ থাকলেও ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবা পাচার। দেশজুড়ে বাড়ছে এই ভয়াবহ মরণ নেশার আধিপত্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে ৪০ হাজার ইয়াবাসহ আটক হন কক্সবাজারের জিটিভির সাংবাদিক এম সেলিম। এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র ছিল আরও কয়েকটি বড় ইয়াবা চালানের। তার মধ্যে ৬ জানুয়ারি বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ১০ লাখ ইয়াবাসহ আটজনকে আটক করা হয়। এর পরদিন ঢাকায় আড়াই কোটি টাকার ইয়াবাসহ আটক হন টেকনাফ উপজেলা যুবদলের সদস্য সচিব মোহাম্মদ তৈয়ব উল্লাহ। এই সময় তার এক সহযোগীকেও আটক করা হয়। গত ৬ জানুয়ারি পেটে পুরে (বিশেষ পদ্ধতিতে খেয়ে) ইয়াবার চালান করতে গিয়ে মোশতাক আহমদ (৩০) নামে টেকনাফের এক পাচারকারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। সাম্প্রতিক এই তিন ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনার তুঙ্গে ইয়াবা। এছাড়া প্রতিদিন ধরা পড়ছে ইয়াবার ছোট-বড় চালান। প্রতিদিন চালান ধরা পড়ার এসব ঘটনায় ইয়াবা হরদম পাচারের বিষয়টি প্রমাণ হচ্ছে বলে মনে করছেন সচেতন লোকজন।
জানা গেছে, দুই বছর আগের তুলনায়ও ইয়াবা এখন অনেক সহজলভ্য। শহর-মফস্বল পেরিয়ে অঁজপাড়া গাঁয়ে পর্যন্ত সহজে মিলছে ইয়াবা। পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার শহরে প্রায় প্রতিটি মোড়ে পাওয়া যায় এ মাদক। পানের দোকানে দোকানেও অনেক সময় সহজেই পাওয়া যায় এই প্রাণঘাতী মাদক। ইয়াবার দাপটে এখন হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদসহ অন্যান্য মাদকের কদরও কমে গেছে অনেক। বহনে সহজলভ্য হওয়ায় ইয়াবা দ্রুত এর কালোথাবা দেশজুড়ে বিস্তার করছে।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ইয়াবা পাচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলীয় লোকজন এবং রাজনীতির বাইরের লোকজনও জড়িত। ব্যবসাই এই চক্রের মূল লক্ষ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। বিশেষ করে পুলিশের একটি গোষ্ঠী সরাসরি পাচারে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বলে অভিযোগ প্রায়ই উঠছে। গত বছর ফেনীতে পুলিশের কাছ থেকে ইয়াবার বড় চালান আটক করার পর এই অভিযোগ আরও জোরালো হয়।
ইয়াবা পাচারের হোতা হিসেবে অভিযুক্ত কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদি সম্প্রতি মাদক বিরোধী এক সমাবেশে বলেন, পুলিশই ইয়াবা পাচারে বড় দায়ী। পুলিশের কিছু বড় কর্তার ইন্ধন রয়েছে ইয়াবা পাচারে। তাদের সিন্ডিকেটই দেশজুড়ে ইয়াবা সরবরাহ করছে। তিনি দাবি করেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইয়াবা ধরে ঠিকই, কিন্তু টাকার বস্তার কাছে বিক্রি হয়ে যায়।’ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ইয়াবা পাচারের ইন্ধন যোগানোর অভিযোগ আছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সড়ক পথে পাচারের পাশপাশি এখন ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে সাগরপথে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সাগর উপকূল থেকে ১০ লাখ ইয়াবা’র একটি চালান আটকের পর বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। এছাড়া বিমানপথেও ইয়াবার বড় বড় চালান পাচার হচ্ছে এমন অভিযোগ শোনা যায়। মূলত ভিআইপিরাই বিমান পথে ইয়াবা পাচার করেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।
র্যাব-৭ এর কক্সবাজার ক্যাম্প ইনচার্জ লে. কর্নেল এসএম সাউদ হোসেন জানান, স্থল সীমান্তের পাশাপাশি গভীর সমুদ্র অঞ্চল হয়ে পাচার হচ্ছে ইয়াবা। স্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক কড়াকড়ির কারণে এখন সমুদ্রপথকে বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা। এ পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় চালানগুলোর বেশিরভাগই সমুদ্রপথে নেওয়ার সময় আটক করেছে র্যাব।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানান, ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশ জিরো টলারেন্সে রয়েছে। প্রতিদিন জেলার কোনও না কোনও পয়েন্টে পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্যের চালান। একই সঙ্গে ধরা হচ্ছে পাচারকারীদেরও। পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
সম্প্রতি কক্সবাজারে মাদকবিরোধী এক সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানা তৈরি করা হয়েছে। ইয়াবা প্রতিরোধে মিয়ানমার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তারা কথা দিয়েছে ইয়াবা বিষয়ে তারা সমাধানে যাবেন।