বর্ষা চলে যেতেই আমি মালীকে ডেকে পাঠালাম। মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তায় আমার বাগানের মাটি, চারা-গাছ, সব তছনছ হয়ে গিয়েছিল; সৌন্দর্য্যটাই কে যেন কেড়ে নিয়েছিল। শুধুমাত্র ঐ জুঁই গাছটা সাদা ফুলে ভরে গিয়েছিল; আর তার গন্ধে, মধু খেতে রং-বেরঙের প্রজাপতিরা ছুটে আসত; ঠিক যেমনটি আমি অফিস ছুটি হলেই ঘরে ফিরে আসতাম; জুঁইয়ের মালায় সজ্জিত তোমার ঐ খোঁপার আকর্ষনে। আজ তুমিও নেই আর…।
তবে জানো, তোমার নিজের হাতে লাগানো গোলাপ গাছটা বর্ষার জলে পূর্ণ যৌবনা হয়ে উঠেছে। শীতেই কুঁড়ি ধরবে নিশ্চয়; ওটা কি রঙের গোলাপ যেন? হলুদ, তাই না? তোমার পছন্দের রঙ। মালীকে সঙ্গে নিয়ে বাগান তো সাজিয়ে তুললাম; কিন্তু দু’হাজার স্কোয়ার ফিটের এই দোতলা বাড়িটা? এই বেডরুম, খাবার ঘর, বসার ঘর, ঠাকুর ঘর, বারান্দা,ছাদ সবই তো ফ্যাকাসে; কি রঙে সাজাই, বলো না? আর কেই বা যত্ন করে সাজাবে? তুমি থাকলে না হয়…
আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে শরৎ এসেছে; ভোরবেলা সাদা শিউলিতে ছেয়ে যায় লাল মোরামের ঐ রাস্তাটা। বোধহয় তারাই খবর দিয়েছে সকলকে। এবার পূজোয় সকলে এসেছিল, জানো? চেন্নাই থেকে এল গোদাবরী, স্বামীর সঙ্গে। বেতলা থেকে এসেছিল মিষ্টি পিসি, তার বউমাকে নিয়ে। সুজিত আজকাল পাঠানকোটে আর্মি ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড; ছুটি পাওয়ার কথা ছিল না; সেও এসেছিল। আর? সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় নন্দিতা এল দীর্ঘ ছ’বছর পরে তার ফর্সা টুকটুকে শাওনকে নিয়ে; পিতৃভূমির সঙ্গে পরিচয় করাতে।
শারদীয়া উৎসব বলে কথা; কত হৈ-চৈ; আনন্দ, ঠাকুর-দেখা, ফুচ্কা, ভেলপুরি খাওয়া, ঢাকের বাদ্যি, ভাসানের নাচ, ধুনুচির ধোঁয়ার পবিত্র গন্ধ সব মিলিয়ে ক’টা দিন বেশ কাটছিল, জানো? কিন্তু তবুও দেখলাম যে সকলের মাঝে আমি একা, বিজোড়। কেন? আমি কি ব্যতিক্রম? না। তা নয়। তুমি যে নেই…
কোজাগরীর চাঁদ আবার উঠেছিল; ঘরে ঘরে শঙ্খ আর উলুর ধ্বনির আওয়াজে আকাশ বাতাস পূন্যতা অর্জন করছিল। শুধু আমার জীবনেই একরাশ শূন্যতা। ঠাকুর ঘরে প্রদীপ জ্বলল না,শাঁখ বাজল না। লাল পাড় গরদের শাড়ি, মকরমুখী বালা, বিছেহার, কোমরবন্ধে সুসজ্জিতা আমার প্রিয়া প্রসাদের থালা হাতে এল না…। বিশ্বাস করো সেদিন সারা বাড়ি খুঁজেছি তোমায়। তুমি নেই। কোথাও নেই। কিন্তু মন বলে, তুমি আছো, লুকিয়ে আছো কোনখানে।
প্রিয়তমা, তুমি কি আসবে না? দেখ চারিদিকে কত আলোক সজ্জা, আমিও জ্বালিয়েছি মাটির প্রদীপ, একশো আটটি; শুধু তোমার জন্যে। যদি তুমি আসো; অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলবে যে। যে অন্ধকার তুমি ঢেলে দিয়ে চলে গিয়েছো আমার জীবনে, দীপাবলীর ফুলঝুরি আর তুবড়ির আলোতে তা ভরবে কি?
সকলে একে একে চলে গেলেও নন্দিতা যায় নি। “এতদিন বাদে এসেছি, ভাইফোঁটা না দিয়ে যাই কি করে?” সেদিন আমার সন্মানে সে কত কি যে সুস্বাদু পদ রান্না করল তোমারই রেসিপি বুক দেখে; তোমারই রান্নাঘরে। তোমারই মত করে ভাত বেড়ে দিয়েছিল; সঙ্গে এক চামচ ঘি আর নিমপাতা। মন ভরে গেল; কিন্তু হৃদয় তো ফাঁকা থেকে গেল; তুমি তো এলে না…।
সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। দূর্বাঘাসের উপর শিশির বিন্দু গুলি মুক্তোর মত উজ্জ্বল। চটি খুলে ফেললাম। খালি পায়ে কিছুটা পথ চললাম ভিজে ঘাসের উপর দিয়ে, তুমিও তো তখন আমার সঙ্গে এইভাবে পথ চলতে প্রিয়া; মনে পড়ে? পড়ন্ত বিকেলে কফি হাতে বসে থাকতে থাকতে উত্তুরে হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে গেল। ‘আহা! ঐ দেখো গরম কাপড় তো বেরই করা হয় নি।’ তোমার অনুপস্থিতি আমায় কেমন আপনভোলা করে তুলেছে দেখেছো?
সেবার বসন্তপঞ্চমীতে হলুদ কাঞ্জিভরমে সেজেছিলে তুমি। খোঁপায় লাগিয়েছিলে সাদা-হলদে চন্দ্রমল্লিকা; কপালের মাঝখানে চন্দনের ফোঁটা। মুগ্ধ চোখে দেখছিলাম তোমায়। তুমি হাতেখড়ি দিচ্ছিলে পাড়ার কোন বাচ্চার। আমিও হলুদ পাঞ্জাবী পরেছিলাম; শুধু তোমার জন্য। দধিকর্মার দইয়ের দাগ এখনও মুছে যায় নি। আমিও সে দাগ তোলার চেষ্টা করিনি। হাজার হোক স্মৃতি তো?
দোলের দিন পেছন থেকে তোমায় লাল আবীর মাখিয়ে দিয়েছিলাম; তুমি কি ভীষন রেগে গিয়েছিলে? রাগলে কিন্তু তোমাকে বেশ লাগে! ফর্সা গাল গুলো আরো টুকটুকে হয়ে যায়। ঠিক যেমন নীল আকাশের বুকে কৃষ্ণচূড়া পলাশের সারি মনকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি; কে বেশী সুন্দর, তুমি? না ওরা?
অমন করে আর দূরে সরে থেকো না। এখনও কি অভিমান করে আছো তুমি? দেখ, ঢের হয়েছে; এবার ফিরে এসো। চড়কের মেলা বসেছে? যাবে? কতবার যেতে চেয়েছিলে? আসবে না তো? কথা বলবে না তো? শুকনো আকাশে চাতকের মত হাহাকার করে চলেছি আমি? শুনছো আমার করূণ আর্তনাদ? শুনতে পাচ্ছো? তবুও আমার ডাকে সাড়া দেবে না তুমি? ঐ দেখো, ঈশান কোনে মেঘ জমেছে। কালবেশাখী আসছে। ঝড় উঠল বলে; ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবার সব ওলোট-পালোট করে দিয়ে যাবে যে! বৃষ্টি হবে না হয়তো; শুধু কালো কালো ধুলো-রাশি; আঁধার করে দিয়ে যাবে আমার ঘর। তবুও কি তুমি দূরে সরে থাকবে? তবুও তুমি আসবে না? আবারও ভালবাসবে না? এই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের মধ্যিখানে আমি দাঁড়িয়ে থাকব একাকী; তবুও তুমি…।