কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি প্ল্যান্ট,গভীর সমুদ্র বন্দর, অর্থনৈতিক জোন ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় হীনতায় রীতিমত রশি টানাটানি শুরু হয়েছে। এদ্বীপের মূল ভূখন্ডে ও প্রতি বছর চর জেগে গড়ে উঠা নতুন নতুন ভুখন্ডের জায়গায় শিল্পায়ন, পর্যটন, লবণ, চিংড়ি, মৎস্য ও পান উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। মহেশখালীতে জেগে ওঠা প্রায় ৫০ হাজার একর ভূমি ঘিরে সরকারের বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে।
জানা গেছে, মহেশখালীও সংলগ্ন সাগরে জেগে উঠা ওই চরে একই স্থানে এক মন্ত্রণালয় চায় অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করতে। আবার আরেক মন্ত্রণালয় আগ্রহী গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন করতে। এভাবে একই জায়গার মালিকানা চাইছে দুই আলাদা মন্ত্রণালয়। কেউ কাউকে চুল পরিমাণ জমি ছাড় দিতে নারাজ। মন্ত্রণালয়গুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না করে এভাবে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করায় দেখা দিয়েছে বিভিন্ন জটিলতা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মহেশখালীতে সাগর থেকে জেগে ওঠা ভূমিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহী। অপরদিকে জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়ী বিদ্যুত কেন্দ্রের আওতায় মহেশখালীতে আলাদা একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায় বিদ্যুৎ বিভাগ। আবার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সেখানে ১০ টি আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে তোড়জোড় শুরু করেছে। জেগে ওঠা চরে একটি পর্যটন অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, সড়ক ছাড়া সব পরিকল্পনাই অচল। সড়ক না থাকলে মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহন করা যাবে না। তাই সেখানে সড়ক নির্মাণের বিকল্প নেই। রেলপথ মন্ত্রণালয়ও পিছিয়ে নেই। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মহেশখালীর সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন জরুরি। অন্যদিকে জেগে ওঠা ভূমিতে এলএনজি টার্মিনাল করতে চায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় গুলোর প্রস্তাবিত বিভিন্ন মেগা প্রকল্প গুলো বাস্তবায়নে জমি ব্যবহারে ও পরিকল্পনা গ্রহণে বিদ্যমান জটিলতা নিরসনে গত ২২ অক্টোবর সরকারের ৯ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহেশখালী পরিদর্শন করেন। শেষে তারা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে মহেশখালীতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ জরুরি। একই সঙ্গে সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশের বিষয়টিও বিশেষ বিবেচনায় নেয়া উচিত। কারণ সোনাদিয়া এলাকাকে ইসিএ (পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে) ঘোষণা দেয়া রয়েছে। ওই প্রতিবেদনের আলোকে গত ৫ জানুয়ারি সংশিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। বৈঠকে তিনি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় জমির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ জানতে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের কাছে প্রস্তাবনা চেয়েছেন। সূত্র জানায়, কোনো মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত হিসাব দিতে পারেনি। এরই মধ্যে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরকে হুমকিতে রেখে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ জ্বাালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেট্রোবাংলা নির্মাণ করতে যাচ্ছে এলএনজি প্ল্যান্ট।এরই মধ্যে এল এনজি প্ল্যান্ট এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বেশ কয়েকবার বিশেষজ্ঞ কমিটি মাঠ জরিপ করে গেছেন মহেশখালীর ৩টি পয়েন্ট।এর আগে এলএনজি প্ল্যান্টের জন্য প্রস্তাবিত দু’টি জায়গা গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য হুমকি হতে পারে বলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে তিন দফায় লিখিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের একক সিদ্ধান্ত অনুযায়ি এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গতকাল ১৭ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেড কোম্পানীর সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল মহেশখালীর মাতারবাড়ি পরিদর্শনে গেলেও স্থানীয় মহেশখালীর উপজেলা প্রশাসন এ সর্ম্পকে কিছুই জানে না বলে এ প্রতিনিধিকে জানান। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম মহেশখালীর সোনাদিয়ায় ডেনমার্কের অর্থায়নে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু সোনাদিয়ার প্রবেশ মুখে এলএনজি প্ল্যান্টের জন্য স্থাপন করা হচ্ছে এফএসআরইউ (তরল গ্যাস বাহিত বিশেষায়িত জাহাজ) বার্থিংয়ের ইউনিট। এটি স্থাপন করতে চাচ্ছে এলএনজি প্ল্যান্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা পেট্রোবাংলা। আর যে জায়গায় এফএসআরইউ ইউনিট স্থাপন করা হচ্ছে তা প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দর সোনাদিয়ার জন্য সাংঘর্ষিক হবে বলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে এ পর্যন্ত তিন দফায় মতামত পাঠানো হয়েছে। এদিকে বিভিন্ন সুত্র থেকে খোঁজ নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠ জরিপে অংশ নেয়া একজন প্রতিনিধি জানান, এফএসআরইউ সম্পর্কে হচ্ছে একটি জাহাজ যা সমুদ্রবক্ষে অপরাপর যেকোনো জাহাজের মতো মুরিং করা থাকবে। উক্ত এফএসআরইউ’তে অপর একটি এলএনজি জাহাজ হতে এলএনজি সরবরাহ করা হবে। সাব সি পাইপ লাইনের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে তা জাহাজ থেকে টার্মিনালে আনা হবে। অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা মাতারবাড়িতে এধরনের একটি বড় জাহাজ অবস্থান করলে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরে জাহাজ প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার সময় সমস্যা হতে পারে। উল্লেখ্য, এলএনজি টার্মিনালের জন্য পেট্রোবাংলা এবং এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেডের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি এফএসআরইউ স্থাপনের কার্যক্রম ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে।