বর্ষবরণের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং বাঙালি সংস্কৃতি ধারণে মানুষের আগ্রহ নষ্ট করতে ভয় দেখানোর জন্য একের পর এক ‘ফতোয়া’ দিচ্ছে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামি দলগুলো। এপ্রিলের শুরু থেকেই পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ বরণ নিয়ে নানা বক্তৃতা বিবৃতিতে নেতিবাচক কথা বলে আসছে তারা। সর্বশেষ জীব-জন্তুর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভা যাত্রা, মুখে উল্কি আঁকা এবং নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণকে অনৈসলামিক ও বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি প্রচারণা শুরু করেছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। তবে খোদ শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমাম ও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেছেন, ‘সাংস্কৃতিক ও লৌকিক বিষয়গুলো ইসলাম কোথায় অস্বীকার করেছে তা আমার জানা নেই।’
আর নারী নেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বাংলা সংস্কৃতি বিষয়ে বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকলে এধরণের ‘ফতোয়াবাজি’ করার কথা ভাবতো না এসকল সংগঠনগুলো। এরা কেবল ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে চায়। মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী হলে তাদের কুসংস্কারগুলো শুনবে না সেটা তারা জানেন এবং জানেন বলেই ভয় তৈরি করতে চায়।
হেফাজতে ইসলাম তাদের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা ঈমান-আক্বিদা ও ইসলামি আদর্শের ঘোরতর বিরোধী। ….বর্ষবরণের নামে মূলতঃ মুসলমনাদের ঈমান-আক্বীদা বিরোধী ভিনদেশি হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টা চলছে।’ মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, ‘ইসলামের বিশ্বাস মতে কোনও জীবজন্তু, বন্যপ্রাণী ও দেবদেবীর মূর্তির কাছে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করলে ঈমান থাকবে না। … মুসলমানকে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছেই। সুতরাং মুসলমানদের জন্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতি চর্চা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।’
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পয়লা বৈশাখের নব বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারী সমাজের ওপর সংঘবদ্ধ যৌন-নির্যাতনের ঘটনার উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুধু গত বছর নয়, এর আগেও বহুবার বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারী নির্যাতন ও নারীদের সম্ভ্রমহানির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তাই মা-বোনদের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন বর্ষবরণের নামে ইসলাম বিরোধী বিজাতীয় এসব অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া থেকে বিরত থাকেন, …ইসলাম অনাত্মীয় নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ অনুমোদন করে না এবং নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যেই পর্দার বিধান জারি করেছে ‘
এদিকে এরই মধ্যে পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উৎসব পালনকে ‘বিধর্মীদের সংস্কৃতি’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ উৎসব পালন বন্ধের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করে ওলামা লীগ। গত ৯ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগসহ সমমনা ১৩ সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত এক মাববন্ধনে পহেলা বৈশাখ বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। সম্প্রতি চালু করা পহেলা বৈশাখের বোনাসও বাতিলের দাবি তোলেন তারা। এরপর সমালোচনার ঝড় উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে লেখেন, ‘ওলামা লীগ! এটা কি খায় না মাথায় দেয়? পহেলা বৈশাখ এর বিরুদ্ধে যারা বলে তারা আওয়ামী লীগের কেউ না, দায়িত্ব নিয়ে বলছি …শেখ হাসিনা প্রথম সরকার প্রধান যিনি বৈশাখী ভাতা চালু করেছেন| যে সব অতিবিপ্লবীরা বঙ্গবন্ধুর দল মুসলিম লীগ হয়ে গেছে বলে নাকি কান্নাজুড়ে দিয়েছেন, তারা দয়া করে থামুন|’
একইভাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ বিবৃতিতে বলছে, ‘১লা বৈশাখের নামে দেশময় অশ্লীলতা-বেহায়াপনা ও নগ্নতার ছড়াছড়িতে মুসলিম জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বিগত পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানগুলোতে নারী নির্যাতনের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান।’
চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমও মনে করেন, ‘মঙ্গল প্রদীপ, মাঙ্গলিক প্রতীক অঙ্কন প্রভৃতি আমদানি করা বিশেষ ধর্মীয় কুসংষ্কারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। এভাবে ভারতের সংস্কৃতির নামে আমাদেরকে পৌত্তলিকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটভিত্তিক চক্রান্ত চলছে। পহেলা বৈশাখ সেই চক্রান্তের ধারাবাহিকতার অংশ।’
যদিও ঐতিহাসিক শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমাম ও বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার চেয়ারম্যান আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ‘সাংস্কৃতিক ও লৌকিক দিক নিয়ে ইসলাম কোথায় অস্বীকার করেছে তা আমার জানা নেই। মুসলমানরা বহুকাল থেকে নববর্ষ পালন করে আসছেন। এটার সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির সম্পর্ক বিদ্যমান। তখনও কাউকে ফতোয়া দিতে শুনিনি। কোনও সমাজের সাংস্কৃতিক বিষয়কে ইসলাম আঘাত করে না, যদি না ইসলামের মৌলিক বিষয়কে সেটা আঘাত করে।’
সাংস্কৃতিক জোট এর সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, ‘তারা কোন জায়গা থেকে এসব আলাপ তোলার চেষ্টা করেন সেটা স্পষ্ট। ইসলামের সঙ্গে বিরোধের জায়গা তারাই তোলে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বিভাজনে যায় না। নতুন বছরকে নানা আয়োজনে বরণ করার বিষয়ে ধর্মীয় ভয় দেখানোর কোন সুযোগ নেই। এটা আমাদের ঐতিহ্য এবং আবহমান কাল থেকে হয়ে আসছে। তারা আসলে মানুষের মধ্যে প্রগতিশীলতা গড়ে উঠতে দেখলেই ভীত হয়ে পড়ে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ সামনে থাকলে তাদের জন্য সুবিধা।’
নারীনেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী খুশী কবীর বলেন, ‘আমার কেবল প্রশ্ন জাগে, এরা নারীদের কেন এতো ভয় পায়? তারা ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকাতে এধরণের হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকেন। কেননা, তারা শত চেষ্টা করেও আমাদের সংস্কৃতি চর্চা, আমাদের বিশেষ দিবস উদযাপনের উৎসাহ কমাতে পারেননি। বৈশাখ নিয়ে মানুষের যে প্রস্ততি তার মধ্যে তারাতো হারিয়ে যান। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ারওতো বিষয় তাদের আছে।’ খুশী কবির বলেন, ‘আমি মনে করি না এসব ধর্তব্যে নেওয়ার কিছু আছে। বাংলায় বিবৃতি লিখে, বাংলায় থেকে খেয়ে বাংলাকে অস্বীকার করে যারা, তাদের দেশে থাকার দরকারটা কি?’