বাঁকখালী নদীর পলিতে সৃজিত প্যারাবনে একের পর এক ভূমিদস্যুরা কালো থাবা বিস্তার করলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আইনের কোন সঠিক প্রয়োগ করছে না। এতে করে দখলদাররা অতি উৎসাহে প্যারাবন নিধন করে বাঁকখালী দখল অব্যাহত রেখেছে। ঘুরে ফিরে একই দখলবাজরা এসব অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িত থাকলেও তারা কেউ আইনের আওতায় আসছে না। গতকাল মঙ্গলবার সকালে বাঁকখালী নদীর কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাট পয়েন্টে প্যারাবন কেটে মাটি উত্তোলন ও ভরাটের সময় অভিযান চালিয়ে মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসময় শ্রমিকরা পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন এবং পরিবেশবাদীরা জানান, কস্তুরাঘাট বদরমোকাম এলাকার জসিমের নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে বাঁকখালী নদীর বিশাল অংশ দখল করে তাতে মাছের ঘের তৈরী, প্যারাবন ভরাট, প্যারাবনে বর্জ্য ফেলা, প্যারাবন থেকে মাটি উত্তোলনসহ বিভিন্ন অবৈধ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন আইনী পদক্ষেপ গ্রহন করেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। যার কারণে পদে পদে আইন ভাঙ্গছেন তারা। গতকালও ৭/৮ জন শ্রমিক দিয়ে প্রকাশ্যে প্যারাবন থেকে মাটি উত্তোলন করে প্যারাবনের আরেক অংশ ভরাটের কাজ করা হয়। এছাড়া বর্জ্য ফেলেও প্যারাবন ভরাটের কাজ চলে। খবর পেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম সেখানে অভিযান চালান। সর্দার শরিফুল ইসলাম গতকাল সকালের কক্সবাজারকে বলেন, ‘খবর পেয়ে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট অংশে অভিযান চালানো হয়। জসিম নামের এক ব্যক্তি সেখানে শ্রমিক দিয়ে প্যারাবন থেকে মাটি উত্তোলন ও ভরাট করছিল। অভিযানে শ্রমিকরা পালিয়ে গেলেও মাটি কাটার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা গ্রীন কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক ও কক্সবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট অংশে জমে উঠা পলি কাঁদায় গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জাপানী একটি সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় ১০ হাজার বাইন, কেউড়া গাছ রোপন করা হয়েছিল। বর্তমানে তা বিশাল প্যারাবন আকার ধারণ করেছে। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোক জমি দখলে নিতে সেখানে প্যারাবন নিধনে ব্যস্ত। ইতিমধ্যেই সেখানে প্যারাবন নিধন করে মাছের ঘের ও বিভিন্ন স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে। কিছুতেই এসব দখলদারদের রোধ করা যাচ্ছে না। প্যারাবনের গাছ নিধন, মাটি উত্তোলন, ভরাট ও ঘের তৈরীর সময় একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হলেও নামে মাত্র অভিযান চালিয়ে তা থেমে যায়। যার কারণে আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় এসব প্যারাবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর সভাপতি ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট অংশে প্রকাশ্যে প্যারাবন নিধন ও বাঁকখালী দখল অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সেখানে আইনের কোন প্রয়োগ করছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। অথচ বাঁকখালী রক্ষায় ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করে। আদালত বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধসহ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে রুল জারি করেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে নদীতে বর্জ্য ফেলে তা ভরাট অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরকার ১৯৯৫ সালে এটিকে প্রতিবেশগত সংকাটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষনা করে। অথচ প্যারাবন নিধন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা হলেও সেখানে ইসিএ আইন কার্যকর হচ্ছে না।’
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদর উপজেলা ইসিএ কমিটির সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম জানান, বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট অংশে প্যারাবন কাটার ঘটনা তিনি শুনেছেন। ব্যবস্থা গ্রহনে সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সরকার ১৯৯৫ সালে এটিকে প্রতিবেশগত সংকাটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষনা করে। এর আওতায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রনালয় ১৯৯৯ সালের ২৯ জুন এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসব এলাকায় যথাযথ সরকারী অনুমোদন ব্যতীত সকল প্রকার ভৌত নির্মাণ কাজ, যে কোন নির্মাণ কাজে পাথুরে ও প্রবাল শিলার ব্যবহার, প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ এবং অন্যান্যপ্রানী আহরন, যে কোন শৈবাল আহরন, গাছপালা কর্তন বা আহরন, প্রানী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস বা অনিষ্টকারী সকল প্রকার কার্যকলাপ, ভুমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট পরিবর্তন হতে পারে এমন কাজ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোন প্রকার কার্যাবলী, জীববৈচির্ত্র্য ধ্বংস হতে পারে এমন কাজ সহ পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ এমন কাজ নিষিদ্ধ করে। তা ২০০২ সালের ১১ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশ করে সরকার। পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি এসব বিধিনিষেধ লঙ্গন করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।