কক্সবাজারের বাঁকখালী মোহনা, মহেশখালী চ্যানেল ও নাজিরারটেক এলাকায় শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে নিয়মিত বালি উত্তোলন করে চলেছে একটি শক্তিশালী চক্র। উত্তোলিত এসব লোনা বালি ব্যবহার করা হচ্ছে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ কাজে। সিডিউল অমান্য করে সিলেটি বালির পরিবর্তে স্থানীয় বালি ব্যবহারের ফলে বিমানবন্দরের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন সবার।
অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিডিউল লঙ্গন করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় মূলত নদীতে ড্রেজার বসিয়ে প্রতিদিন বালু তুলছে। তাতে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে স্থানীয় বালি দিয়ে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন বিশ্লেষকদের। তবে বালি উত্তোলন কাজে স্থানীয় কতিপয় রাঘববোয়ালও সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে। যে কারণে আইন অমান্য করে বালি আহরণকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাঁকখালী নদীর মোহনায় অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের ঘটনায় গত বছরের ১২ জানুয়ারি বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক ও বিমানবন্দর ব্যবস্থাপককে নোটিশ দেয় পরিবেশ অধিদফতর এর কক্সবাজার অফিস।
ওই নোটিশে বলা হয়, কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভূমি উন্নয়নের জন্য বাঁকখালী নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় না করে ছাড়পত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন, সংরক্ষণ ও পরিবহনের কারণে নদীর তীরে অধিদফতরের সৃজিত ১৫ একর প্যারাবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নোটিশে ৭ দিনের মধ্যে তাদের জবাব দিতে বলা হলেও তাতে পাত্তা দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতরের জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, পরিবেশের ক্ষতি করে কোনো কাজ করা উচিত নয়। বালি উত্তোলন বন্ধে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নোটিশ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা নোটিশের কোন জবাব দেয়নি। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এরপরও এটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প বিধায় একটু দেখে শুনে এগুতে হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন পরিবেশ অধিদফতরের এ কর্মকর্তা।
বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক আমিনুল হাসিব বলেন, অনুমতি নিয়ে বাঁকখালী নদী ড্রেজিং করে লোনা বালু আহরণ করে বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য ভূমি উন্নয়ন (জমি ভরাট) করা হচ্ছে। রানওয়ের নির্মাণকাজে লোনা বালু ব্যবহার করা হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আমিনুল হাসিব বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই লোক (সরদার শরীফুল ইসলাম) ১০ বছর ধরে কক্সবাজারে আছেন। তাঁর কর্মকান্ড নিয়ে বিতর্ক আছে। কক্সবাজারের পাহাড় কেটে সাফ করা হলেও এ ব্যাপারে তাঁর গরজ নেই।’
এদিকে বালি উত্তোলন বন্ধে ১০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে কক্সবাজার জেলা জাসদ। ৫ মার্চ শনিবার দুপুরে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জেলা জাসদের সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুল বলেন, টেন্ডার ও ওয়ার্ক পারমিটে সিলেটি পাথর, ছোট নুড়ি পাথর ও সিলেটি বালি ব্যবহারের কথা উল্লেখ থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সমুদ্রের পয়েন্টে থেকে বালু উত্তোলন করছে। ফলে ধংস হচ্ছে খনিজ সম্পদ, জীব প্রণালী, মৎস্য ভান্ডার, চিংড়ির রেনু পোনা, শামুক-ঝিনুক, ডলপিন, কাঁকড়া, সী-উইডসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক পাণী।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে অবাধে বালি উত্তোলনের কারণে মারাতœক হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। সঙ্কটাপন্ন ঘোষিত উত্তর ও মধ্যম নুনিয়ারছরা এলাকা। বিনষ্ট হচ্ছে বিকল্প সুন্দরবন খ্যাত প্যারাবন। বালু উত্তোলনের ফলে নদীর গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাঁকখালী তীরে বসবাসরত অন্তত ২০ হাজার মানুষের ঘরবাড়ী। লোনা ও পানি মিশ্রিত এই বালির সাথে ওঠে আসছে সামুদ্রিক নানা প্রজাতির রেনু পোনা।
পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডস্থ সমিতি পাড়া পয়েন্ট, নাজিরার টেক পয়েন্ট ও বাঁকখালী নদীর মোহনায় উপকুল থেকে অন্তত ২০০ মিটার দূরে সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। উত্তোলন করা বালু পাইপ লাইনের মাধ্যমে স্থলভাগে নিয়ে আসা হচ্ছে। সমুদ্রতল, জলরাশি, জলস্রোত, বায়ু, সামুদ্রিক প্রবাল-প্রাচীরও দূষিত হচ্ছে। জলবায়ু ও জীব বৈচিত্রের ইকো-সিস্টেমকে বিপর্যস্ত করে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ধসংসকারী এ কর্মযজ্ঞ আগামী দশ দিনের মধ্যে বন্ধ না করলে সাধারণ জনতা সাথে নিয়ে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন জেলা জাসদের এ নেতা।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান বলেন, বাঁকখালীতে শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে বিমানবন্দরের জন্য বালি উত্তোলন করায় নদীর গভীরতা বাড়ছে এবং বসতির মাটি সরে যাচ্ছে। ভাঙন প্রক্রিয়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনসহ সবার জানা আছে। এরপরও ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে এলাকা রক্ষায় ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরণের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজের টেন্ডার পাওয়া কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান ইউনিশ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, সিউকে ওয়াং ডেভেলপমেন্ট কোং লিঃ, হ্লা কর্পোরেশন লিমিটেড জেভি। এদের সহযোগী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লিঃ জয়েন্টভেঞ্চারে বিমানবন্দর উন্নয়নের কাজের চূড়ান্তভাবে টেন্ডার পান। সংবাদ সম্মেলনে জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আবুল কালাম আজাদসহ বিভিন্ন স্থরের নেতা উপস্থিত ছিলেন।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলেছে, এভাবে বালু উত্তোলনে প্রাকৃতিক জীব সম্পদ, চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, ডলফিন, কাকড়া, সি-উইড, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, এনাড্রস জাতের প্রাণী, ক্যাটাড্রমাস প্রজাতি, সেডেন্টারি প্রজাতি, বিভিন্ন জাতের প্রাণী, জু-প্লাংকটন এবং ফাইটোপ্লাংকটনসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের প্রজনন-আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ২৭৪৯ (২৫) নম্বার সিদ্ধান্ত এবং জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বর জ্যামাইকা কনভেশন-এ সাধারণ পরিষদের ১৫১৪(১৫) নম্বার সিদ্ধান্ত, জাতিসংঘের জীব বৈচিত্র কনভেনশন -১৯৯২ , ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত জৈব নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রটোকল-২০০০, ১৯৭৩ সালের সাইটাস, ১৯৮০ সালের আইইউসিএন বিশ্ব সংরক্ষণ কৌশল ১৯৮২ সালের প্রকৃতির বিশ্ব সনদ, ১৯৭২ সালের স্টকহোম ঘোষণা, দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ সংক্রান্ত ষ্টকহোম কনভেনশন-২০০১, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন-১৯৯২, রামসার কনভেনশন-১৯৭১-এ সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে- সমুদ্রের ইকো সিস্টেম এর ক্ষতিসাধন করে এমন কোনো প্রকার ড্রেজার বসিয়ে মাটি, বালু উত্তোলন করতে পারবেনা।
সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করা সরাসরি নিষিদ্ধ থাকলেও আইনের কোনো প্রকার তোয়াক্কা করছেনা কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অসাধু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
সূত্র মতে, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ এর ২,৩ ধারা, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৮৫, ৩(১)(২) উপবিধি (১) এবং সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্র অধ্যাদেশ-১৯৮৩ ১(খ) (ঘ) ২৪(২) ক, খ, ২৬(ক)(খ)(গ)(ঘ) ধারা অনুযায়ী নদীর মোহনা সমুদ্রের মৎস্য প্রজনন ও আবাসস্থল এলাকায় বালু উত্তোলন করতে মৎস্যসহ জীবন্ত সামুদ্রিক সম্পদের ক্ষতিসাধন করা যাবেনা। এরপরও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার হোসেন লিঃ সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে হরদম সামুদ্রিক বালু উত্তোলন করে যাচ্ছে।
কক্সবাজার আনবিক শক্তি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমলা অনুযায়ী খনিজ সম্পদ ও সামুদ্রিক খনিজ বালু পারমানবিক শক্তি কমিশন ছাড়া আর কেউ উত্তোলন ও ব্যবহার করতে পারবেনা। পরিবেশ ও দেশের ক্ষতি করে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা উচিৎ নয়।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সাধন কুমার মোহন্ত বলেন, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য একটি দেশিয় ও প্রতিষ্ঠান ৩টি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে। কেন সামুদ্রিক বালি ব্যবহার করা হচ্ছে সেবিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তারা জানবেন। এতে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প একটি আন্তর্জাতিক কাজ। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করা উচিত হবেনা।
তিনি বলেন, এসব বিষয়ে কাজ করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর রয়েছে। তাছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতির বিষয়ে আমাকে কেউ লিখিত জানায়নি। এরপরও আমি খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব খুরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, সমুদ্রের লোনা বালি দিয়ে বিমানবন্দরের রানওয়ের সম্প্রসারণ কাজ হচ্ছে, এমন খবর তাঁর জানা নেই। তিনি এ ব্যাপারে খোঁজ নেবেন।