বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় কয়েকগুন বেশি কাজ করলেও এখনো উপার্জনের স্বাধীনতা মেলেনি নারীর। অনেকক্ষেত্রে তারা ন্যায্য মজুরী থেকেও বঞ্চিত হয়। দেশের মাত্র ১৫ শতাংশ নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পেলেও ৮৫ শতাংশ নারীরই সেই স্বাধীনতা নেই। যারা রোজগার করেন তাদের ২৪ শতাংশেরই নিজের রোজগারের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই। টাকা ছাড়াই বাংলাদেশের পুরুষের চেয়ে মহিলারা ৫ গুন বেশি কাজ করে থাকে। অথচ বিনোদন ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রে তারা সময় পায় অনেক কম। অন্যদিকে বাংলাদেশের যুব নারীদের একটি বড় অংশই থাকছে শ্রমশক্তির বাইরে। এর সংখ্যা হিসাবমতে প্রায় ৮০ শতাংশ। যদিও দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে কিন্তু তা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া যেসব জায়গায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেশি সেখানে তাদের প্রাপ্য মজুরী অনেক কম। দেশের শ্রমবাজারে নারী সুযোগ অনেক কম পাচ্ছে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়। কর্মে নিয়োজিত পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে কাজে ৬ দশমিক ৯ ঘণ্টা এবং মহিলারা ৫ দশমিক ২ ঘণ্টা ব্যয় করে। কর্মজীবী নারী গৃহস্থালীর কাজে পুরুষের চেয়ে ৩ গুণ বেশি সময় ব্যয় করে। এক্ষেত্রে পুরষ ১ দশমিক ৪ ঘণ্টা এবং ৩২ দশমিক ৬ ঘণ্টা কাজ করে কর্মজীবী পুরুষেরা ১ দশমিক ১ ঘণ্টা অবসর খেলাধুলা ও বিনোদনে ব্যয় করলেও একই কাজে মহিলারা শূন্য দশমিক ৮ ঘণ্টা ব্যয় করে। ব্যক্তিগত পরিচর্যার ক্ষেত্রে ও কর্মে নিয়োজিত নয় এমন মহিলারা পুরুষের চেয়ে কম সময় পায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একই সময় একসঙ্গে কাজ করার পর পুরুষেরা মহিলা শ্রমিকের চেয়ে বেশি মজুরী পান। অথচ দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করেন।
মোট মহিলাদের মধ্যে ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। আর সেই তুলনায় ৬০ দশমিক ৩ শতাংশ পুরুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত। এক্ষেত্রে মোট কৃষির ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ বিনামূল্যে মহিলারা গৃহস্থালীর দৈনন্দিন কাজ হিসেবে শ্রম দেন এবং বাকি ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রম টাকার বিনিময়ে কেনা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলছে। বর্তমানে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিনটি খাতে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে নারীর আরেকটি বড় সাফল্য হলো দেশের উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর অবদান বেড়েছে। উৎপাদন খাতের প্রায় অর্ধেকই এখন নারীরা কাজ করছেন। ২০১০-২০১৩ সাল- এই তিন বছরে প্রায় ৬ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২ লাখ নারী সেবাখাতে যুক্ত হচ্ছেন। দেশের ৭৭-৯৯ শতাংশ নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে জামানত বিহীন ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেন। যা দেশের অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক বিরাট সাফল্য। এক্ষেত্রে প্রতিটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদাভাবে শিল্প প্লট বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। নারীর কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় নারীরা তাদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ পায়না। বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়। এতে করে তাদের কাজের গতিশীলতা অনেকাংশে কমে আসে। সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে কয়েকজন কর্মজীবী নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন যা নারীর উপার্জন ক্ষমতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গর্ভবতী নারীরা কারখানায় কাজ করতে গেলে সঠিক সময়ে মাতৃত্ব ছুটি পাচ্ছে না। ফলে সন্তান সম্ভবা অনেক মাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। এক্ষেত্রে নারীদের জন্য কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মায়েরা যাতে তাদের শিশু সন্তানদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে রেখে কাজে আসতে পারে সে জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং তার গুণগত মানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আশার কথা হলো শিক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের উপযোগী করার ক্ষেত্রে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এক দশক আগেও দেশে কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল খুবই কম। সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। নারীদের কর্মসংস্থানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। গত এক দশকে দেশে নারীর কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে কৃষি ও তৈরি পোশাক খাতে। দেশে তৈরি পোশাকখাতে বর্তমানে কর্মরত আছে প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক, যার ৯০ শতাংশ বা ৪০ লাখই নারী শ্রমিক। খাতটির নারী শ্রমিকের উপর নির্ভর করেই ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানির স্বপ্ন দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বাড়লেও পারিশ্রমিক পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা এখনো পুরুষের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের পারিশ্রমিকের সমতা নিশ্চিত করতে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে। এছাড়া মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়ার বিষয়েও সচেতনতা বাড়ছে অনেকগুণ এবং এই ছুটির সময়সীমাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমাজের সর্বস্তরের জনগণ ও সরকারি সহায়তার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে স্বক্ষম হবে।