বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. সলিমুল্লাহ খান বলেছেন, ‘চৌদ্দ থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত চট্টগ্রামই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের কেন্দ্রে। এখানেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এখানকার ইতিহাসই সবচেয়ে সমৃদ্ধ। আর্যদের আগমন থেকে ভারতের ইতিহাস গণনা হয়েছে। কিন’ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার ১৫শ বছর আগেই ভারতের ইতিহাসের শুরু। সেই প্রাচীন ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই সমৃ্দ্ধ। নবীন চন্দ্র সেন, ড. আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মো. এনামুল হক, সাহিত্যিক আবুল ফজল, সাহিত্যিক আহমদ ছফা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চায় চট্টগ্রামকে অনন্য স’ানে নিয়ে যান। কিন’ নানাভাবে চট্টগ্রামের ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যকদের অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার ইতিহাস যদি ৮শত বছরের হয় এর মধ্যে ৪শত বছরই চট্টগ্রামের রাজত্ব ছিল। অর্থাৎ বাংলাভাষা চর্চার ইতিহাসে চট্টগ্রামের অবদানই সবচেয়ে বেশি।’ তিনি বলেন, ‘নাগরিকদের সবার প্রতি রাষ্ট্রের সমান আচরণ করা উচিত। তা না হলে দেশ বিভক্ত হয়। দেহ বিভক্ত না হলেও অন্তর বিভক্ত হয়ে যায়। যে কারণে সংঘাত বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠায় ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্য প্রয়োজন।’
সুপ্রভাত বাংলাদেশ এর ৯ মাসব্যাপী ‘এগিয়ে চলো চট্টগ্রাম’ কর্মসূচির আওতায় গতকাল শনিবার নগরীর মুসলিম ইনস্টিটিউ হলে আয়োজিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্য’ বিষয়ে একক বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
সুপ্রভাত বাংলাদেশ এর সহযোগী সম্পাদক কবি কামরুল হাসান বাদল এর উপস’াপনায় অনুষ্ঠানে সূচনা বক্তব্য রাখেন পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক কবি আবুল মোমেন। এতে পত্রিকার সম্পাদক রুশো মাহমুদ ও সহযোগী সম্পাদক রইসুল হক বাহার উপসি’ত ছিলেন।
সূচনা বক্তব্যে কবি আবুল মোমেন বলেন, ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ৯ মাসব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গত ৫ মাস ধরেই আমরা এ ধরনের বিভিন্ন কাজ করেছে, এপ্রিল পর্যন্ত চলবে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে সুপ্রভাত চট্টগ্রামের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চায়।’ তিনি বলেন, দেশ এখন একক নগরের দেশে পরিণত হচ্ছে। রাজনীতিতে এত বেশি গালাগলি, কাদা ছোড়াছুড়ি বেড়ে গেছে, এত সংকীর্ণতা পেয়ে বসেছে যে তারা আর সর্বজনীন চিন্তা করতে পারছে না। এ অবস’ায় মানুষ কোথাও আশা খুঁজে পায় না। যারা মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেন, যারা মনন জাগিয়ে তুলতে পারেন সে রকম মানুষ ড. সলিমুল্লাহ খান। আমরা তার বক্তব্য শুনতে এখানে সমবেত হয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যিকার অর্থেই একটা ‘কালান্তর’ এর সম্মুখীন হয়েছি। রবীন্দ্রনাথের কালান্তরের মতোই সামাজিক চরিত্রগুলো আবার দেখা যাচ্ছে। কিন’ সমাজে গুণগত পরিবর্তন ঘটছে। এই সময়ে চিন্তাবিদদের মানুষের সামনে আসতে হবে, তরুণদের কৌতূহল-প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তবেই সমাজ সঠিক অর্থে প্রগতির দিকে ধাবিত হবে।’
কবি আবুল মোমেন এর সূচনা বক্তৃতার পর মুসলিম ইনস্টিটিউটে হলভর্তি দর্শকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা শুরু করেন ড. সলিমুল্লাহ খান। উপসি’ত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরুতে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম আমার জন্মভূমি, এখানে আমি ঘন ঘন আসতে চাই কিন’ পেশাগত কারণে ঢাকায় থাকি বলে এখানে তেমন আসতে পারি না। মাঝে মাঝে গোপনে এখানে আসি তবে এবার এলাম প্রকাশ্যে। আমাকে বলা হয়েছিল চট্টগ্রামের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বলতে কিন’ আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে পারি না, ভবিষ্যতে কি হবে তা বলা যায় না। তাই আমি চট্টগ্রামের অতীত নিয়ে কথা বলবো। অতীতকে ভালোভাবে জানতে পারলে বর্তমানটা ভালোভাবে চলা যাবে, ভবিষ্যৎ ভালো আসতে পারে।’
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলাভাষা ও সাহিত্য চর্চায় চট্টগ্রামের কবি-সাহিত্যকদের অবদানকে নানাভাবে অস্বীকার করে আসা হয়েছে। মোঘল আমলের শুরু থেকে সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ এর শাসনামল পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলের চিন্তাবিদদের মধ্যে শাহ মোহাম্মদ ছগীর, নবীন চন্দ্র সেন, ড. মো. এনামুল হক এবং সে ধারাবাহিকতায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারাদ, আহমদ ছফাসহ অনেকেই সাহিত্য চর্চায় অবদান রেখেছেন। কিন’ তাদের এ অবদান অস্বীকার করা হয়েছে বাংলা সাহিত্য চর্চার যুগকে চারটি ভাগে ভাগ করার মধ্য দিয়ে। এর প্রথমটি ছিল গৌড়ীয় যুগ, দ্বিতীয়টি নদীয়ার যুগ, তৃতীয় কলিকাতার যুগ এবং চতুর্থ রবীন্দ্রনাথের যুগ- এভাবে চার যুগের ভেতরে চাপা পড়ে যায় চট্টগ্রামের সাহিত্যিকদের অবদান। এই চার যুগেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় চট্টগ্রামের অবদান ছিল কিন’ ‘যুগের’ নামকরণের মধ্য দিয়ে তা চাপা পড়ে যায়।’
তিনি বলেন, সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ এর আমলে দেখা যায় পূর্ববঙ্গে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাত্র ৫৮ জন চিন্তাবিদ। এর মধ্যে ৫০ জনই ছিলেন চট্টগ্রামের। বাকি ৮ জনের মধ্যে ৫ জন কুমিল্লার ও ৩ জন ছিলেন নোয়াখালীর। অর্থাৎ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় রাজত্ব ছিল চট্টগ্রামেরই। সে ধারাবাহিকতা ছিল প্রায় ৪শ বছর।’ তিনি বলেন, ‘১৯৩৫ সালে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ লিখেন ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’। তার এ রচনা থেকেই প্রথম জানা যায় আরাকান রাজসভায় বঙ্গসাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান ছিল অনেক সমৃদ্ধ।’
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘১৯১৩ সালের ৯ মার্চ চট্টগ্রামের পরীর পাহাড়ে এক ‘সাহিত্য সম্মেলন’ এর আয়োজন করা হয়। সে সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন ৫৮ জন চিন্তাবিদ। এতে কবি নবীন চন্দ্র সেনকে সংবর্ধনা জানানো হয়। তখন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল চট্টগ্রাম। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। শুধু রেলওয়ে নয়, প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোও ছিল চট্টগ্রামে। প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম ভৌগোলিক কারণে বাণিজ্যিক দিক থেকে যেমন সমৃদ্ধ ছিল, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় ও ছিল সমৃদ্ধ।’
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে তা রদ হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গভঙ্গ চেয়েছিল আর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা চায়নি। এ অবস’ায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের জমিদার শ্রেণি তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করলো। এতে পূর্ববঙ্গের মানুষ খুবই মর্মাহত হলো। বেশ মর্মাহত হলেন ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ। এর মাত্র দুই বছর পর ১৯১৩ সালে তিনি মারা যান। আমি বলবো যে সৎ সাহসের অভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল ঠিক একই কারণে পাকিস্তান ভাগ হয়। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দেখা দেয়, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গ করার পেছনে যেসব কারণ ছিল তার অন্যতম ছিল রাষ্ট্রীয় আচরণে অসাম্য। সুতরাং রাষ্ট্রকে সবার প্রতি সমান আচরণ করতে হয়। অন্যথায় দেশ বিভক্ত হয়। দেহ বিভক্ত না হলেও অন্তর বিভক্ত হয়ে যায়। বিশ্বাস হারিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমান সংকট হচ্ছে ন্যায়বিচারের সংকট। শোষণমুক্ত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-অঙ্গীকার। কিন’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? তবে এত বছর পর এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে-এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এর মধ্য দিয়ে সমাজে সুবিচার-ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।’
ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, ব্রিটিশদের নিজেদের প্রয়োজনে এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান ভাগ করেছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। এটা ছিল উপমহাদেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। এরপরই ব্রিটিশরা বুঝতে পেরেছিল শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে এখানে হিন্দু-মুসলিম বিভক্ত করে দিতে হবে। এ জন্য তারা পরবর্তী ২০ বছর সিপাহী বিদ্রোহকে কেবল মুসলমানদের আন্দোলন বা মুসলমানরা তাতে অংশ নিয়েছিলেন বলে প্রচার চালায় যাতে করে দু পক্ষ বিভক্ত হয়ে যায়। ১৮৫৭ সালের পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেরও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে। এই সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে রাষ্ট্রকে সবার প্রতি সমান আচরণ করতে হবে, সামাজিক সাম্য ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার বক্তৃতার পর প্রশ্নোত্তর পর দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ড. সলিমুল্লাহ খান। এক দর্শকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার নিজে পরিবারে যে ভাষায় কথা বলি সেটাই হলো আমাদের মাতৃভাষা। চট্টগ্রামের ভাষা আমাদের মাতৃভাষা কিনা কিংবা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা বাংলার বিকৃত রূপ কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে ড. সলিমুল্লাহ খান ড. এনামুল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, চট্টগ্রামের ভাষা বাংলার বিকশিত রূপ।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. সলিমুল্লাহ খান মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্ব এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে কারণ এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ ও মানবের চরম ক্ষতি করছে। কিন’ সে প্রকল্প এখানে করা হচ্ছে। মাতারবাড়িতে যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র করা হচ্ছে তার নেতিবাচক ফলাফল হবে ভয়াবহ। কেন্দ্রের ৫০ বর্গকিলোমিটার মধ্যে কোনো সুস’ মানুষের বসবাস থাকবে কি-না সে আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’