বাঘগুজারা ড্যামের রাবার চতুর্থ দফায় ছিঁড়ে মাতামুহুরী নদীতে ঢুকছে লবণ পানি হুমকির মুখে ১৫ ইউনিয়নের ৫০ হাজার একর জমির চাষাবাদ
ডেইলি কক্সবাজার ডেস্ক ::
আপডেট সময়
শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১৬
২৭৫
বার পড়া হয়েছে
চকরিয়ার মাতামুহুরী নদীর বাঘগুজারা পয়েন্টে নির্মিত ২৩৩ দশমিক ৫০ মিটার দীর্ঘ দেশের বৃহত্তম রাবার ড্যামের (ব্যারেজ) শনির দশা কাটছে না। ড্যামটির অদূরে শ্যালো মেশিন বসিয়ে নদীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন ও সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের লবণ পানির তোড়ে চতুর্থবারের মতো ছিঁড়ে গেছে রাবারের জোড়া। গত বুধবার দুপুর বারোটার দিকে রাবারের জোড়া ছিঁড়ে গেলে নদীতে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করছে লবণাক্ত পানি। এই অবস্থায় চলতি আমন মৌসুমে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ১৫টি ইউনিয়নের ৫০ হাজার একর জমির চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, ড্যামটির বর্তমান অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হবে। এর পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে যাতে ড্যামটির ছিঁড়ে যাওয়া রাবার জোড়া লাগানো যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ড্যামটির রাবারের জোড়া ছিঁড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া। তিনি বলেন, ‘দেশের বৃহত্তম এই ড্যামটি নির্মাণের সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছিল। এ কারণে বার বার বিপর্যয় ঘটছে দেশের বৃহত্তম এই ড্যামের। একইসময়ে নদীর পালাকাটা-রামপুর পয়েন্টে নির্মিত ড্যামটির এখনো পর্যন্ত এ ধরণের সমস্যা দেখা দেয়নি। নিন্মমানের কাজ হওয়ায় এবং প্রায় দুইমাস ধরে শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে বার বার বিপর্যয় ঘটছে বাঘগুজারা রাবার ড্যামে।’
চেয়ারম্যান জিয়া আরো বলেন, ‘চতুর্থ বারের মতো বাঘগুজারা ড্যামটির রাবার ছিঁড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ১৫টি ইউনিয়নের ৫০ হাজার একর জমির আমন চাষাবাদ চরম হুমকির মুখে পড়েছে। ড্যামের রাবার ছিঁড়ে যাওয়ার খবরে কৃষকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তাই টেকসইভাবে ড্যামটির রাবার পুনঃস্থাপনের জন্য কৃষকদের পক্ষে আমি জোর দাবি জানাচ্ছি।’
বাঘগুজারা ড্যামের তদারক আবদুর রহিম বলেন, ‘সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির তোড়ে ও ড্যামের তলানীর বেইজের পাইলিংয়ের গোড়া থেকে মাটি সরে যাওয়ার কারণে চার স্প্যানের মধ্যে দ্বিতীয় স্প্যানের রাবারের জোড়া ছিঁড়ে ব্যাপকভাবে নদীতে ঢুকে পড়ছে লবণ পানি। জোয়ারের পানির চাপ এতই প্রবল যে, অন্য তিন স্প্যানের রাবারের জোড়াও ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিষয়টি ইতিমধ্যে আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধতন কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে অবহিত করেছি।’
সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর বাঘাগুজারা পয়েন্টে নির্মিত দেশের বৃহত্তম রাবার ড্যামটির একেবারে কাছ থেকে শ্যালোমেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে প্রায় দুইমাস ধরে বালু উত্তোলন করছিল ১২ সদস্যের একটি প্রভাবশালী চক্র।
স্থানীয় ও কৃষকদের ভাষ্যানুযায়ী, ড্যামের একেবারে কাছ থেকে বালু উত্তোলনের কারণে চতুর্থ বারের মতো ছিঁড়ে গেল রাবারের জোড়া। তার উপর সামুদ্রিক অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ও রয়েছে। বালু উত্তোলনের কারণে এতদিন ধরে রাবারের জোড়া একটু একটু খুলে এবং ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ছিল ধরে রাখা নদীর মিঠাপানি।
পেকুয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ চৌধুরী রাজু বলেন, ‘বাঘগুজারা রাবার ড্যামের ধরে রাখা মাতামুহুরী নদীর মিঠাপানি দিয়ে পেকুয়ার সাতটি ইউনিয়নের কৃষকেরা প্রতিবছর চাষাবাদ করে। কিন্তু বার বার এই ড্যামটির বিপর্যয় কেন ঘটছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সেচসমস্যা দূর করতে প্রায় ৪০ বছর পর অনেক দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ড্যামটি নির্মাণ করলেও প্রতিবছর একাধিকবার ড্যামটির রাবারের জোড়া ছিঁড়ে যাওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত উঠছে। বার বার এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে ড্যামটির স্থায়ী সমাধান চান কৃষকেরা।’
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘চতুর্থদফায় বাঘগুজারা রাবার ড্যামের রাবারের জোড়া ছিঁড়ে যাওয়ার খবর শুনেছি। ছিঁড়ে যাওয়া রাবার দ্রুত জোড়া লাগাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি।’
চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, ‘আমন চাষাবাদের মোক্ষম সময়ে বাঘগুজারা ড্যামের রাবার ছিঁড়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ড্যামটি দ্রুত কার্যকর না করলে ৫০ হাজার জমিতে রোপিত আমন ক্ষেতের ফসল গোলায় তুলতে পারবে না কৃষক। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে জরুরী পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছি।’
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘বাঘগুজারা ড্যামের রাবারের জোড়া ছিঁড়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ড্যামস্থলে উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে পাঠানো হয়েছে। তিনি সরজমিন পরিদর্শন করে দেওয়া প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এবং চলতি আমন মৌসুমের মোক্ষম সময়ের সেচসমস্যার বিষয়টি মাথায় রেখে জরুরীভিত্তিতে ড্যামটি কার্যকরের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর দুই পয়েন্টে রাবার ড্যাম দুটি নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। পারিশা এন্ড কম্পানী এবং ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং নামের দুটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ড্যাম দুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করলে ২০১২ সালে উদ্বোধন করেন তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন। দেশের বৃহত্তম বাঘগুজারা ড্যামটি উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার রাবারের জোড়া ছিঁড়ে যায়।