ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প জোট গঠন করতে দীর্ঘদিন ধরেই তৎপরতা চালিয়ে আসছে বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো। ইতিমধ্যে বিকল্প জোট গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের মধ্যে। তারা এক সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচীও পালন করে আসছে। আরো বেশ কয়েকটি বাম দল তাদের সাথে জোট গঠনে সক্রিয় রয়েছে । 
সিপিবি ও বাসদ বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকলেও রাজনৈতিক আস্থাহীনতার কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোকে কাছে টানতে পারছে না তারা। তবে হরতালসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি যুগপৎভাবে পালন করে যাচ্ছে সিপিবি-বাসদসহ বামপন্থীদের বৃহৎ জোট- বামমোর্চা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবির ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, তাজরিন ফ্যাশনসে’র অগ্নিকা-ে ১২৪ গার্মেন্ট শ্রমিকের নির্মম প্রাণহাণির ঘটনায় মালিকসহ দায়ীদের গ্রেফতার ও বিচার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারসহ সকল ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে সিপিবি-বাসদ ঐক্য ও বামমোর্চা যুগপৎভাবে হরতাল, পদযাত্রা, বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে। সম্প্রতি রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ব্লগার হত্যাকা- ও তনু হত্যার প্রতিবাদেও  যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
বাম দলগুলোর সূত্রে জানা গেছে, বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে এবং অপরাপর দলগুলোকে আন্দোলনে যুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে আলোচনা ও মতবিনিময় করে যাচ্ছেন সিপিবি ও বাসদ নেতারা। পাশাপাশি বর্তমানে ৮টি দলের সমন্বয়ে পরিচালিত গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাও একই লক্ষ্যে তৎপর রয়েছে। গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ, বাসদ (মাহবুবুল হক), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দল মহাজোটের শরিকদের বাইরে বামদের বৃহৎ এই জোটের শরিক। এছাড়া বদরুদ্দীন উমরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমুক্তি মিলে ঐক্যবদ্ধ বাম বিকল্প জোট গঠনেও সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে চারটি পক্ষ পৃথকভাবে প্রায় একই রকম উদ্যোগ নিলেও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো টানাপোড়েন নেই বলে দলগুলোর নেতাদের দাবি।
দেশে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এবং বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি- সিপিবি গত এক দশক ধরে দ্বি-দলীয় বৃত্তের বিপরীতে গণতান্ত্রিক বাম বিকল্প বলয় গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে সিপিবি’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে জানান দলটির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তাদের সে উদ্যোগ অনেকাংশেই সফল হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। সিপিবি-বাসদ ঐক্য সে উদ্যোগেরই ধারাবাহিকতা বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ ঐক্য ইতিমধ্যে নিজেদের অবস্থান বেশ শক্ত করেছে বলেও তিনি জানান।
তাছাড়া নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে শরিক হলে দল থেকে বেড়িয়ে আসেন দেশের অন্যতম বামপন্থী নেতা হায়দর আকবর খান রনোসহ বেশ কিছু নেতা। সে সময় বাংলাদেশের ওয়র্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত) নামে আলাদা দল গঠন করেন রনো। পরবর্তীতে নবগঠিত এ দলটির প্রায় সবাই সিপিবি’র সঙ্গে একীভূত হন। নব্বইয়ের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার পর বাংলাদেশে দু’টি রাজনৈতিক দলের একীভূত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। সেই থেকে বাম বিকল্প জোট গড়ে তোলার বিষয়টিও ভিন্ন মাত্রা পায়।
এ বিষয়ে সিপিবি’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ বলেন, বামদের নেতৃত্বে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি সে লক্ষ্যেই সিপিবি-বাসদ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পার্থক্য থাকলেও প্রত্যেকটি দলেরই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের এই উদ্যোগের সাথে মহাজোটের বাম শরিকদেরও সম্পৃক্ত হওয়ারও সুযোগ রয়েছে।  কারণ মহাজোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর) ও কমিউনিস্ট কেন্দ্রের সংবিধান সংশোধনসহ সরকারের অনেক নীতির সঙ্গেই তাদের দ্বিমত রয়েছে। 
তাই দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে বাম দলগুলোকে এক মঞ্চে আনার লক্ষ্যে সিপিবি এরইমধ্যে বাম চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ বিভিন্ন বামদলগুলোর সঙ্গে যৌথ সভা-সমাবেশ ও যুগপৎ আন্দোলনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে তিনি জানান। 
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান  মনে করেন, দেশে চলমান দ্বি-দলীয় মেরুকেন্দ্রিক আদর্শহীন রাজনীতির বলয়ের বাইরে জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তিতে বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলা জরুরি। তিনি বলেন, বামপন্থী অপরাপর সকল শক্তিকে সাথে নিয়ে যুগপৎ এবং যুক্তধারায় চলার চেষ্টা আমাদের অব্যাহত রয়েছে। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় প্রক্রিয়াতেই আলোচনা অতীতে যেমন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে বলেও জানান তিনি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন,  বিএনপি-জামায়াতসহ চার দলীয় বিরুদ্ধে যেসব কথা বলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় গেছে, সেই একই কাজ এখন তারাও করছে। দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ জাতীয় সম্পদ রক্ষার ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে দেশের বামপন্থীরা জনগণের মাঝে অনেকাংশে জায়গা করে নিয়েছে। তুচ্ছ মত পার্থক্যের সংকীর্ণতা পরিহার করে বামপন্থীদের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষেই তিনি মত দেন।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, জোট-মহাজোটের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এ অবস্থায় বাম বলয়কে ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি হিসেবে কেউ দেখতে চায় না। নিজেদের পায়ে না দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি’র ছায়াতলে দাঁড়িয়ে বাম বিকল্প গড়া সম্ভব নয়। তবে বাম বিকল্প গড়ার পাশাপাশি জনগণের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে স্বতন্ত্র এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা, রণকৌশল গ্রহণ করাটা জরুরি বলে তিনি মনে করেন।