পশ্চিমা সভ্যতার আজ রমরমা অবস্থা। শিক্ষা-দীক্ষাসহ নানান বিভাগে পশ্চিমাদেরই আজ জয়জয়কার। কিন্তু মজার বিষয় হলো পশ্চিমাদের এই জয়জয়কারের পেছনে তাদের নিজেদের যতটা অবদান তারচেয়েও বেশি অবদান প্রাচ্যের সভ্যতার। স্বাভাবিক নিয়মেও যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাবো, পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত হয়ে পশ্চিমকে আলোকিত করে এবং দিনান্তে রাতের শেষে ভোর হলে সেই অভিজ্ঞ সূর্যই আবার পূর্বদিক দিয়ে উদিত হয়। তেমনি আজকের পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার যতই প্রশংসা করা হোক না কেন, প্রথম বিদ্যালয় ব্যবস্থা কিন্তু প্রাচ্য থেকেই পশ্চিমে গিয়েছিল। যার প্রমাণ আজও চীনের ছেংদু শিশি স্কুলে গেলে দেখা যায়।
প্রাচ্য এখন পর্যন্ত দাবি করেনি যে শিশিই প্রথম স্কুল। কারণ প্রাচ্যের শিক্ষাকাঠামোয় ভারতীয়দের টোল ব্যবস্থাও অনেক প্রাচীন। সেই হিসেবে শিশিকেও বিশ্বের প্রথম বিদ্যালয় বলা না গেলেও, প্রথম কাঠামোবদ্ধ বিদ্যালয় বলতে চীনের এই স্কুলটিই প্রথম। চীনের সিচুয়ান প্রদেশে আনুমানিক ১৪৩ থেকে ১৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক সময়ে এই বিদ্যালয়ের সূচনা হয়। মূলত তৎকালীন সময়ে ওই বিদ্যালয়ের নাম ছিল ওয়েন ওয়েং শিশি। চীনা ভাষায় শিশি শব্দের অর্থ হলো ‘স্টোন চেম্বার’। আমরা যদি বিদ্যালয়টির অবকাঠামো খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাবো বিদ্যালয়টি আসলেই পাথরে তৈরি। কিন্তু দার্শনিকদের প্রশ্ন হলো, বিদ্যালয়টি পাথর দিয়ে তৈরি বলেই কি নাম দেয়া হলো ‘শিশি’? অবশ্য ভিন্ন মতে জানা যায়, চীনে বিশ্বাস করা হয় পাথরেরও প্রাণ আছে। যেহেতু প্রাণবিশিষ্ট পাথর দীর্ঘদিন কোনো রুপ পরিবর্তন না করেই অপরিবর্তিত অবস্থায় বর্তমান থাকে, তাই জ্ঞানীরও সেই একই অবস্থায় থাকা উচিত। সেই দার্শনিক ভাব চিন্তা করেই ওই বিদ্যালয়টির নাম রাখা হয়েছিল শিশি বিদ্যালয়।
যে সময়টাতে ওই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন পুরো চীনে ইস্টার্ন হান সাম্রাজ্যের বিস্তার। তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের এক সাংঘর্ষিক মুহূর্তে বিদ্যালয়টিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৪ খ্রিস্টপূর্বে সম্রাট ইয়ুজু ঝুঝাস্কের সময়ে পুনরায় বিদ্যালয়টি নির্মান করা হয়। চীনের পাথরের কাজ করার একটা প্রাচীন রীতি ছিল শু শি ঝিং। এই রীতিতে প্রাচীন কায়দাকে অক্ষত রেখে পাথর দিয়ে বাড়ি নির্মান করা হয়। সেদিক বিবেচনা করলে পুরো বিদ্যালয়টির পাথরের কাজ শেষ হতে প্রায় দুইশ ত্রিশ বছর সময় লেগেছিল। অবশ্য মিং সাম্রাজ্যের সময়ে রাজপরিবারের আক্রোশে বিদ্যালয়টি আবারও ধ্বংস করে দেয়া হয়।
চিং সাম্রাজ্যের আমলে ১৬৬১ সালের শুরুতে সিচুয়ানের বিদ্যালয়টি আবারও চালু করা হয়। ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে ওই বিদ্যালয়টি থেকেই মূলত সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়। ওই সময় থেকেই মূলত চীন দেশ নিজস্ব এবং নতুন শিক্ষাকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা গ্রহন করতে শুরু করে। সর্বশেষ ১৯০২ সালে ছেংদু বিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রনে নতুন শিক্ষাকাঠামো প্রনয়ন করা হয়। এর ঠিক দুই বছর পরেই অর্থাৎ ১৯০৪ সালে শিশি বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘ছেংদু মিডল স্কুল’ হয়। আবারও ১৯৪০ সালে স্কুলটির নাম পরির্বতন করা হয়। এবার নাম রাখা হয় ‘শিশি মিডল স্কুল’। ১৯৪৮ সালে এই বিদ্যালয়টির শিক্ষাকাঠামোকে গোটা চীনে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
নাম পরিবর্তন যেন বিদ্যালয়টির শেষ হয় না। ১৯৫২ সালে পিপলস রিপাবলিক অব চায়না গঠিত হওয়ার পর বিদ্যালয়টির নতুন নামকরণ করা হয় ‘ছেংদু নং.৪ মিডল স্কুল’ নামে। দেশে সাংস্কৃতির পরিবর্তনের যে বিপ্লব হয় সেসময় বিদ্যালয়টির উপর আবারও আঘাত আসলেও চিং সাম্রাজ্যের বানানো বিদ্যালয়টিই এখনও বহাল আছে। অবশ্য ১৯৮৩ সালে বিদ্যালয়টিকে আবারও তার সাবেক নামে ফিরিয়ে আনা হয়।
শিশি বিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রনে এখন চীনে একশটি স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কাছে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহন করতে পারা অনেক সৌভাগ্য ও অনেক চেষ্টার ফসল বলে মনে করা হয়। কারণ অতীত ঐতিহ্য এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকায় এই বিদ্যালয়টি সবসময়ই রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। শিশি স্কুলে দশ শতাংশ নম্বর পেলেই তবে মিডল স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়। এবং সেই মিডল স্কুলে নির্দিষ্ট সংখ্যক নম্বর না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। এই বিদ্যালয় থেকে বের হওয়া প্রতিভাবানদের মধ্যে আছেন, বিজ্ঞানী গুয়ো মুরো, বিপ্লবী লী ইমাঙ, গনিতজ্ঞ মা ঝিমিং এবং সাহিত্যিক ঝুং চ্যাংয়ের মতো আরও অনেকেই।