গত দু’ বছর আগেও আমানত সংগ্রহের জন্য অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল ব্যাংকগুলো। অনেক ব্যাংকই তখন আমানত টানতে সুদ গুণেছিল ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। উচ্চ সুদে নেয়া এসব আমানতের মধ্যে বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত অলস পড়ে আছে। আর এ অলস টাকা ব্যাংকগুলোর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আক্ষরিক অর্থেই টাকা নিয়ে বসে আছে ব্যাংক। কিন্তু ঋণ নিচ্ছেন না শিল্পোদ্যোক্তারা। বাড়ছে না বেসরকারি খাতের ঋণ নেয়ার হার। দেশে নতুন বিনিয়োগ তেমন হচ্ছে না। এর ফলে ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকার পরিমাণ। দেশে না করলেও উদ্যোক্তারা এখন বিনিয়োগের জন্য দেশের বাইরে যেতে চাচ্ছেন। বর্তমানে ব্যাংকগুলো আমানত নিরুৎসাহিত করতে আমানতে সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে। দেশের অধিকাংশ ব্যাংক এখন আমানতের বিপরীতে ৭ থেকে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই গত কয়েক বছরের মতো। আগের তুলনায় প্রশাসনে আস্থার পরিমাণটাও বেড়েছে। কিন্তু তারপরেও প্রত্যাশিত মাত্রায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। অনেকেই বৈধ অবৈধ উপায়ে দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাচার করছেন। মালয়েশিয়া, কানাডায় সেকেন্ড হোম গড়ে দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশের মধ্যে বিনিয়োগ পরিবেশ নেই তেমন অজুহাত অনেক ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তার মুখে শোনা যায়। তারা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে বিনিয়োগের নানা প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার মতো অর্থ দেশের অনেক উদ্যোক্তার কাছে আছে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন উদ্যোক্ত বিদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে অনুমোদন পেয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে তা জানা যায়।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ব্যাংকগুলোর উল্লেখযোগ্য আয় না হলেও আমানতকারীকে ঠিকই সুদ দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। অস্থিতিশীল অবস্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও ভালো নয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিক সময়ে ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছে না। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক অবস্থাকে অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা বেশ নাজুক।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে তা হয়তো বলা যাবে না, তবে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গতি কমেছে অর্থনীতির। তারই প্রমাণ হচ্ছে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অলস অর্থ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে মূলধনের অভাব নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আর উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা বিনিয়োগ করতে চান। অর্থও আছে। কিন্তু দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের ঘাটতি আছে। অবকাঠামোর সমস্যা তো ছিলই। নতুন করে গ্যাস পাওয়া নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট দূরীকরণে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। সরকার এ সঙ্কট উত্তরণে বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বটে, তবে এর বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া এই টাকা ২০১৪ সালের চেয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি। তার মানে প্রতি বছরই দ্রুতগতিতে টাকা পাচার করা হচ্ছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাতলুব আহমাদ বলেন, দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ মন্দা চলছে। ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে আছে। অথচ ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পারছে না। কারণ ব্যাংক ঋণের সুদহার অনেক বেশি। কোনো কোনো ব্যাংক ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের এ উচ্চ সুদহার না কমালে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। ব্যাংকের অলস টাকার ব্যবহার হবে না। তাই দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংক ঋণের সুদেরহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, বর্তমানে এক ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। বিনিয়োগ কিছুটা স্থবির। তবে এটি সাময়িক। সরকারের বড় প্রকল্পগুলো গতি পেলে সমস্যা আর থাকবে না। সব ব্যাংকের হাতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। আমানতের সুদহার কমানোর মাধ্যমে প্রধানত ঋণের সুদ হার কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে ঋণ গ্রহণে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ৮৫ শতাংশই এখন বাংলাদেশের বাইরে রাখা আছে এবং এ জন্য বাংলাদেশের আয় হচ্ছে মাত্র ১ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে যে ৪৮৯ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে, তার গড় সুদ হচ্ছে ৪ শতাংশ। ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থেকেও তেমন আয় হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন নীতিমালা কমিটির সদস্য ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে এখন বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক মূলধনের জোগান আছে। কিন্তু তা কাজে লাগানোর মতো বিনিয়োগের চাহিদা নেই। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়াতেই তা স্পষ্ট।