‘ভালোবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না, ভালোবাসা লুটতরাজ কীর্তিনাশা, একা মেয়েটার নরম গালের পাশে প্রহরীর মতো রাত জাগে ভালোবাসা’। কেবল কবীর সুমন না, ভালবাসা নিজের মতো করে, নিজের অনুভূতি দিয়ে নানা ভাব নিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। কখনো দেশের প্রতি, দ্রোহের প্রতি, প্রেমের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে জাগরণের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগিয়েছে মানব ইতিহাস।
ভালোবাসার চিরন্তন কোনও রূপ আছে কি? কেউ বলেন, ধরণ পাল্টে যায়, কিন্তু ভালোবাসাতো ভালোবাসাই। আবার কেউ সেটা মানতে রাজি না। ভালোবাসার মানে একই সময় বহু রকমের হয়। কেউ বলতে চান, ভালোবাসাকে এই করপোরেট যুগে স্বার্থপর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়েই তো ভালোবাসার সেকাল-একাল। পৃথিবীর সঙ্গে বন্ধন কত মায়াময়, প্রেমময় হবে তা নির্ভর করে মন কতটা মমতা নিয়ে ভালোবাসা লালন করে। বর্তমান বাস্তবতায় অস্থির পৃথিবীর সম্পর্কগুলোও অস্থির। শেষ বাস্তবতায় সময়ই ভালোবাসার ধরণ নির্ধারণ করে।
আবৃত্তিকার লায়লা আফরোজ মনে করেন, মানুষের আবেগ অনুভূতি কোটি বর্ষ ধরে একই আছে। তিনি বলেন, ‘স্বীকার করতেই হবে, ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গিটা যুগে যুগে পাল্টায়। আদম আর ইভের সন্তান হাবিল-কাবিল তাদের পছন্দের নারীকে পাওয়ার জন্য রক্তারক্তি করে প্রাণ-বিসর্জন দিয়েছে। রোম্যান্টিক-প্রণয়োপাখ্যানের সকল ক্লাসিক-চরিত্র প্রেমের জন্য জীবন তুচ্ছ করে অমরত্ব লাভ করেছে। আমাদের এই উপমহাদেশে রজকিনী-চণ্ডীদাস, মনু মিয়া-মালকা বানু, চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের কাহিনী, তাদের প্রেম ও বিরহ-বেদনার কথাও আমাদের অজানা নয়।
তিনি মনে করেন, আমাদের নানাবিধ সম্পর্ক নির্ণয় হয় মাত্রা ভেদে। প্রেমের জন্য মানুষের চিরকালের আকুতি যেমন আছে, আবার প্রেমের জন্য খুনোখুনির ঘটনাও ইতিহাসে কম নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘তবু প্রেম কভু নাহি মানে পরাভব’! মানুষের মনে অনন্ত-ফাল্গুনী বয়ে যাক। তবু মানুষ চিরকাল উচ্চারণ করুক চির-পুরাতন বিরহ-বিরহ-মিলন কথা, ‘তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার’!
আশির দশক থেকে শুরু করে এখনকার সময়ের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কীভাবে বদলে যায় সময়। দৃশ্যমান আর অদৃশ্য ভালোবাসার মধ্যে কোন সময়টা ভাল, যখন মনের কথা নানাভাবে জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে সেটা, নাকি যখন অনেকদিনের চেনাজানা মানুষটাকে ভালোবাসার কথা জানাতেই সে বলে ওঠে, সেই কবে থেকে ভালোবাসি আমিও। কোনটা? জানতে চাইলে ১২ বছরের চেনা একজনকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া নায়লা জেবিন বলেন, ‘আমি সেই কবে থেকে ভালোবাসি, বলা হয়নি। কিন্তু যখন ১২ বছর পর বিয়ের সময় এলো তখন মনে হলো দেখি না মন খুলে কথা বলে। আমি বলতেই সে তারও একই অনুভূতি জানালে অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে বিয়ে করি।’
কিন্তু তার নিজের তেরো বছরের সন্তানের কথা বলতে তিনি বলেন, এ প্রজন্ম বুকে ভালোবাসা লালন করার মতো ধৈর্য রাখবে, ভাবতেই পারে না। এখন ফেসবুকে ভালো লাগার কথা অকপটে বলে দেয়, অকপটে প্রত্যাখ্যাত হয়, অকপটে আবারও নতুন সম্পর্কে যায়। আমাদের মতো ফেলে যাওয়া রুমাল কুড়িয়ে রাখা, খোলা চুলের ওড়াউড়ি দেখেই আজীবন চোখে সেই রূপ মনে রাখা, প্রশ্নই ওঠে না। তাই বলে এখন ভালোবাসা নেই তাতো না, আছে। কিন্তু সাথে হিসাবনিকাশটা প্রবল।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাজীব মীর মনে করেন, ভালোবাসা অন্তরের আকুতি, ভালোবাসা প্রাণের প্রার্থনা। যদিও প্রযুক্তি আর পণ্য মানুষের বোধ নষ্ট করে দিচ্ছে। হাতে লেখা রঙিন কাগজের চিঠি, ফুলের পাঁপড়ি আর বুকের গন্ধ মেশানো সেলাই রুমাল আবেগ আশ্রিত ছিল তখন। আজ অজানা গন্তব্যে একই মেসেজ অজস্র মানুষের কাছে একই উদ্দেশে পাঠানো হচ্ছে, সাজানো প্যাকেজ প্রেম এখন আধুনিকতার নামান্তর। বন্ধনের সোনালী সময় অতিক্রান্ত হয়ে ধরি-ছাড়ি সম্পর্ক নানা মাত্রায় বিরাজ করছে। মানুষ আস্থা হারাচ্ছে মানুষে, চুক্তিনামা হচ্ছে অধিক টাকায় তারপরও টিকছে না প্রেম, বিয়ে, বন্ধুত্ব। আজকের সমাজে অস্থিরতা আর অরাজকতা এ কারণেই। সেই সংকট আগে হয়ত ছিলো কিন্তু এখনকার মত এত দ্রুত ও নানামুখী অবিশ্বস্ততা, এত কামজ ও পণ্যজ ছিলো না।