ভাষা আন্দোলন, বাংগালি জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।
কিন্তু এই ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে,
প্রিয় পাঠক আমি আপনাদের কাছে এই ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্ঠা করব।
বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় ৬৫০ খ্রীষ্টাব্দে, এর পর অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে বাংলা ভাষা আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট ভাষাগুলোর অন্যতম।১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজরা ক্ষমতা নিলে মুসলিম রা কোনঠাশা হয়ে পরে, বাংলা ভাষা চর্চা থেমে যায়, শুরু হয় ইংরেজী চচা।
এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় উপমহাদেশের জনগন বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং অনেক স্বাধীকার আন্দোলন হয়, ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে সংখ্যাগরিষ্টের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত দুটি দেশ এর জন্ম হয়.
বায়ান্নর ২১ এর রক্তাক্ত ইতিহাস যে সংগ্রামের ফলশ্রুতি তার সাংগঠনিক প্রক্রিয়া শুরু হয়১৯৪৭ সালের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে। তৎকালিন মানুশের কাছে এটা সব্রজন স্বীকৃত যে ইসলামি সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিশ সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রুপ দান করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্টার মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে এ সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি জন্ম লাভ করে(১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭) । এর উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন অধ্যপক জনাব আবুল কাশেম ও রাষ্ঠ্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আহবায়ক ছিলেন অধ্যপক নূরুল হক ভূইয়া।
প্রাথমিক অবস্থায় কেউই বাংলা ভাষা আন্দোলন প্রচার করতে সাহস পাচ্ছিলো না, ঢাকার ছাত্রাবাস গুলিতে ফজলুল হক হল ই প্রথম ভাষার দাবীতে কিছুটা সাড়া দেয়।
বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা জনাব মোঃ তোয়াহা (ঢাকা ডাইজেস্ট) এর এক সাক্ষাৎকার এ বলেন, ”এ সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে ইশতেহার বিলি করতে গিয়ে ছাত্ররা চকবাজার এ জনতা কতৃক ঘেরাও হন। ছাত্ররা উত্তেজিত জনতার সম্মুখে অশহায় অবস্থায় পতিত হন। এ সময় তৎকালিন ডাকসুর ভি,পি, গোলাম আজম সাহস করে এগিয়ে যান। তিনি চিতকার করে জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘ ভাই আমরা কি বলতে চাই তা শুনবেন তো।’ এ বলেই তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে পূর্র পাকিস্তান এর কি উপকার হবে তার উপর একটি বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে শান্ত করেন।”
এখান থেকেই ঘটনা ক্রমে আন্দোলনমূখী হতে থাকে। এরপর সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের পহেলা সপ্তাহে ১১ মার্চ কে প্রতিবাদ দিবস ঘোষনা করে বিভিন্ন পত্রিকায় বিব্ৃতি দেয়, সেদিন সাধারন ধর্মঘাট পালন করা হবে। মজলিস কর্মীদের দিনরাত পরিশ্রমের ফলে ছাত্রসমাজের চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে এবং সর্ব্বস্তরের কর্মীরা আন্দোলনকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এ প্রথম সংঘটিত গণবিক্ষোভ দিবস। বস্তুতঃ ১১ মার্চ এর বিক্ষোভ এবং আন্দোলন এর ফলেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে নাজিমুদ্দিন সরকার এর সাথে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর ৭ দফা চুক্তি হয়।
দাবীগুলো ছিলো—
১। অবিলম্বে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের সরকারী ভাষা, আদালত এর ভাষা ও শিক্ষা মাধ্যম ঘোষনা করতে হবে।
২। কেন্দ্রীয় গভর্নর যাহাতে বাঙলা কে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেন, সে জন্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদ এ একটি প্রস্তাব পাশ করিয়া কেন্দ্রীয় গভর্ণর এর নিকট তাহা পাঠাতে হইবে।
৩। ভাষা আন্দোলনের সময় যারা বন্দী হইয়াছেন তাহাদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে।
৪। ভাষা আন্দোলনের সময়ে ইত্তেহাদ, অমৃতবাজার, আনন্দবাজার প্রভৃতি পত্রিকার উপর যে নিষেধাগ্গা জারি হয়-তাহা উঠাইয়া লইতে হবে।
৫। ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিল বলে কোন কর্মকর্তা কর্মচারীকে কোন রকমের শাস্তি দেয়া যাবে না।
৬।প্রেসনোট বাহির করিয়া সরকার ঘোষনা করিবেন যে, ভাষা আন্দোলন কোনমতেই রাষ্ট্রের শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত হয় নাই।
৭। ভাষা আন্দোলন দমাইবার জন্য সরকার যে কার্যক্রম লইয়াছে তজ্জন্য প্রকাশ্যভাবে নাজিমুদ্দিন সাহেবকে ক্ষমা চাহিতে হইবে।
ভাষা আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য গঠিত হ্য় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যার প্রথম আহবায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নেতা অধ্যপক নূরুল হক ভুইয়া। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তৎকালিন রাজনীতিবিদদের আচরন সম্পর্কে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম বলেন, “এই পর্যন্ত তমদ্দুন মজলিসের পক্ষে আমরা এককভাবে আন্দোলনটিকে আগাইয়া নিয়ে যাইতেছিলাম। এই আন্দোলনকে সাহায্য করিবার জন্য আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে যাই। মুসলিম লীগ ইহাকে মোটেই আমল দেয় নাই, কংগ্রেস কর্মীরা ইহার নাম শুনেই আতকে উঠেন। ঢাকা জজ কোর্টের পিছনে কমূনিষ্ট পার্টির যে বিরাট অফিস ছিল, তাহাতে একদিন কমূনিষ্ট পার্টির এক মিটিং ছিল। কমরেড মুজাফফর আহমদ উক্ত বৈঠকে নেতৃত্ব করিতেছিলেন, সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হইতে আমি কয়েকজন কর্মীসহ তাহাদের নিকট উপস্থিত হইলে তিনি পার্টির পক্ষ হইতে আমাকে জানাইয়া দেন: এই আন্দোলন কে সমর্থন করা তাহাদের পক্ষে সম্ভব হইবে না। শুধু তাই নয় , তিনি মেমোরেন্ডামে দস্তখত করিতেও অস্বীকার করেন। বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশনও ইহাতে যোগদান করিতে অস্বীকার করে।”
যাই হোক পরিষদ এই আন্দোলন এগিয়ে নিতে থাকে নিজেদের সামান্য শক্তি নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও মিটিং চলতেই থাকে, নাজিমুদ্দিন সাহেবের সাথে একের পর এক বৈঠক চলতেই থাকে। অবশেষে নাজিমুদ্দিন সাহেব সব দাবী মেনে নিয়ে একটি দলিলে সরকারের পক্ষে সহি দেন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ঐতিহাসিক দলিলে সহি করেন অধ্যাপক কাসেম সাহেব।
অতঃপর কায়েদে আজম ঢাকায় আগমন করেন। রেসকোর্স ময়দানে কয়েক লাখ লোকের সামনে বক্তৃতায় তিনি পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা এখানের জনসাধারনই ঠিক করবে বলে মন্তব্য করেন চুক্তি অনুসারেই, কিন্তু কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা যে ঊর্দূ হবে তা জোরের সাথেই বলে যান।এই সময় সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ সরকারী নেতাদের তাদের দাবীর যৌক্তিকতা বুঝাতে চেষ্টা করেন এবং ব্যর্থ হন। এই সময় রাজনীতিবিদরা ধীরে ধীরে এই আন্দোলনের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ খুজে পেতে থাকেন এবং নিজেরা এতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। এ কথা সর্ব্বজনবিদিত যে , ভাষা আন্দোলনের সংগঠনে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির চেয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীর ভূমিকা অনেক বেশি। যদিও আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্যদের কথা বা কর্ম বর্তমান ইতিহাসবিদদের লেখনীতে খুজে পাই না।
ভাষার দাবীটি ছিল জাতীয় দাবী। ফলে ভাষা আন্দোলন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় আন্দোলনের রুপ পরিগ্রহ করে। কোন একক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে এ আন্দোলনকে সীমিত না রেখে একে সর্বদলীয় রুপ দেয়ার ব্যাপারে তমদ্দুন মজলিস এর কোন আপত্তি ছিল না। ফলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বলতে গেলে তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনে রাজনীতিবিদদের সরাসরি ও বলিষ্ঠ আগমন ঘটে। ১৯৫০ সালে বামপন্থী ছাত্রনেতা আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হ্য়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ফলে আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে ঠিকই কিন্তু স্বার্থান্ধ মহলের জন্য তা নতুন দ্বারও উম্মূক্ত করে। কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে ২১ শে ফেব্রুয়ারী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী সর্বাত্মক হরতাল ওপ্রতিবাদের প্রস্তুতির প্রেক্ষিতে সরকার ২০ শে ফেব্রুয়ারী রাত্রি থেকে ঢাকা জেলার সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারী করেন। সর্বদলীয় কর্ম পরিষদ আন্দোলনের পিঠে ছুড়িকাঘাত করে ১৪৪ ধারা ভংগ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক সমাবেশে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ এর পক্ষ থেকে জনাব শামছুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার আবেদন জানালে সাধারন ছাত্রদের প্রতিবাদের মূখে তিনি তার সহকর্মীসহ বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন।
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহবায়ক আব্দুল মতিন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহনের দায়িত্ব ছাত্রদের উপর ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী পরিস্থিতির দায়িত্ব থেকে ণিজেকে মুক্ত করে নেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রসমাজ অনমনিয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং সৃষ্টি হয় নতুন এক রক্তাক্ত ইতিহাস—-।
ভাষা আন্দোলনের সংগঠক গাজিউল হক ঢাকা ডাইজেস্ট , জুন/৭৮ সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন,”ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে এবং তা দুদিক থেকে। এক দিকে কিছু নতুন দাবীদারকে প্রতিষ্টাকরার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে ও অন্যদিকে কারো কারো নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারার কাঠামোতে ফেলার জন্য এ মহান আন্দোলনের ইতিহাস কে ভিন্নরুপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন অনেকে।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভংগের যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সাধারণ ছাত্র-জনতা কর্তৃক , সে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন মুহাম্মদ সুলতান। ঢাকা ডাইজেষ্ট , জুন/৭৯ এর এক সাক্ষাৎকারে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে টিভি সাক্ষাৎকারে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলাপ করছিলেন শেখ মুজিব ও কে জি মোস্তফা। এক পর্যায়ে শেখ মুজিব তাকে জিঞ্গেস করেন- তোমার মনে নেই মোস্তফা ৫২ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে আমি ১৪৪ ধারা ভাংগার নির্দেশ দিয়েছিলাম। -এমনি অনেক ধরনের কথা। মোস্তফা কখনো মাথা নেড়ে , কথা বলে শেখ মুজিব এর কথার সমর্থন দিচ্ছিলেন, অথচ শেখ মুজিব তখন জেলে।” কিন্তু ৬৩ সালে প্রকাশিত কে জি মোস্তফার ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বইতে লিখেছেন “শেখ মুজিব তখন জেলে, ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকেই তিনি জেল খাটছিলেন”।