কক্সবাজারের-মিয়ানমার সীমান্তে ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরও বড় মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।১৩ এপ্রিল বুধবার সন্ধ্যায় সারা দেশের মতো কক্সবাজারে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় এ আশঙ্কা আরো তীব্র হয়েছে।আর এই ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে পর্যটননগরী কক্সবাজার।
এছাড়াও শহরে রয়েছে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন।একই সাথে কক্সবাজারের বিশাল অংশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে এ আশঙ্কা করছে ভূবিজ্ঞানীরা।আর রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কক্সবাজারের শত শত ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।সেই সাথে বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ডের আশঙ্কাও রয়েছে।
বিশেষ করে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনখ্যাত কলাতলীতে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ ও জনঘনত্ব বেশি হওয়ায় ভূমিকম্পে শহরে মারাত্বক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। রিখটার স্কেলে ৮ বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্পকে মহা প্রলয়ঙ্করী হিসেবে নির্দেশ করা হয়।
এদিকে সারা দেশের মতো পরপর দুই বার কক্সবাজারে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় এ আশঙ্কা আরো তীব্র হয়েছে। এর ফলে বহু মানুষের প্রাণহানী সহ মহাবিপর্যয় নামবে পর্যটনসহ লবণ,শুটকি, চিংড়ি, হ্যাচারী,পান-সুপারি, মৎস্য উৎপাদন সহ নানা ব্যবসায়।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফী বিভাগের অধ্যাপক ও কক্সবাজার মাস্টার প্ল্যানের পরিকল্পনাকারী অলক পাল জানান, ভারত ও মিয়ানমার প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পূর্বাংশ তথা কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-মিয়ানমার প্লেটের মধ্যে অবস্থিত।কক্সবাজার পাহাড়ি এলাকা।এমন ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে ভূমিকম্প হবে এটিই স্বাভাবিক।এ জন্যই কক্সবাজার বেশি ভূমিকম্প প্রবণ। এছাড়া মায়ানমার এবং বাংলাদেশ সীমান্তে একটি ফল্ট জোন (ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি) রয়েছে। কক্সবাজার ও চট্রগ্রাম এই চ্যুতির অত্যন্ত কাছে হওয়ায় বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম।মায়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের উক্ত চ্যুতির মধ্যে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কক্সবাজারের শতশত ভবনের মধ্যে অধিকাংশ ভবনই ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন,কক্সবাজারে পাহাড় কাটা বন্ধ, জলবায়ুর উষ্ণতা রোধসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা গেলে কক্সবাজার ঝুঁকিতে মধ্যম অবস্থানে থাকবে।
এব্যাপারে কক্সবাজারের বিল্ডিং প্ল্যানার্সের পরিচালক ও স্বনামধন্য প্রকৌশলী ইনঞ্জনিয়ার বদিউল আলম জানান, ভূমিকম্প কখনো মানুষ মারে না,অপরিকল্পিত নির্মাণই মানুষ মারে।শহরে যে হারে অপরিকল্পিত নির্মাণ হয়েছে তাতেই বড় ধরনের ভূমিকম্পে পুরো নগরী ধ্বংস্তুপে পরিণত হবে। কক্সবাজারের ব্যবসা বাণিজ্য এবং পর্যটন শিল্প তছনছ হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিটি ভবন নতুন করে এসেসম্যান্ট করতে হবে।ভূমিকম্প প্রতিরোধে শক্তিশালী করতে হবে। অন্যথায় আমাদের ভিশন ২০২১ বা ভিশন ২০৪১ ব্যর্থ হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন,গত ২০ বছর আগে যে ভবণগুলো নির্মিত হয়েছে সেগুলো মারাত্বক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।এছাড়া কক্সবাজার শহরে কোন নিয়মনীতি ছাড়া যেভাবে বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে হঠাৎ ভূমিকম্পে ধ্বংসজজ্ঞ এবং প্রাণহানি এড়ানো প্রায় অসম্ভব।তাই নজর দিতে হবে ক্ষতি কমানোর দিকেই।এছাড়া ৭ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হলে পর্যটন নগরীর কক্সবাজারের বহুতল ভবনের ৭০ শতাংশই ধসে পড়তে পারে যা ঘটাবে মহাদূর্যোগ।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ নাজমুল হক জানান, বুধবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমার।কেন্দ্রস্থলে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৯ এবং চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তন, নির্বিচারে পাহাড় কাটা,বৃক্ষ নিধন,বিল্ডিং কোড না মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ ও বিভিন্নভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের ফলে দিন দিন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে পড়ছে কক্সবাজার। তিনি আরও জানান, কক্সবাজারের সমুদ্রবেষ্টিত পাহাড়গুলো দিন দিন কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে মাটি স্থির থাকার ভারসাম্য ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। এতে ভূমিকম্পের ঝুঁকিটা তীব্রতার দিকে যাচ্ছে।
কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আব্দুল মজিদ জানান, ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার কাজের জন্য উদ্ধার কাজের ভারি সব ধরণের যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে।তবে এই ধরণের যন্ত্রপাতি সেনাবাহিনীর রয়েছে এবং তারা ছাড়া আর কেউ এগুলো চালাতে পারে না।তিনি আরও বলেন,কক্সবাজারে আমরা ইতোমধ্যে ২ থেকে ৩ হাজার লোককে ভূমিকম্প সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।আরো লোককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানান, পর্যটন শহর কক্সবাজারে বহু সংখ্যক ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে এবং এটি নি:সন্দেহে আতঙ্কজনক।তাই দ্রুত সময়ে বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের মতামত নিয়ে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।