রোহিঙ্গা সমস্যার মূলে রয়েছে বার্মার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন। কারণ, এই আইনের মধ্য দিয়েই রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব হারিয়ে রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছেন।
আট অধ্যায়ে মোট ৭৬ ধারা বিশিষ্ট সেই আইনের ১ নং ধারায় বলা হয়েছে আইনটির নাম ‘Citizenship Law’, ২ নং ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রের নাম ‘Socialist Republic of the Union of Burma’ এবং ৩ নং ধারায় বলা হয়েছেঃ
“Nationals such as the Kachin, Kayah, Karen, Chin, Burman, Mon, Rakhine or Shan and ethnic groups as have settled in any of the territories included within the State as their permanent home from a period anterior to 1185 B.E., 1823 A.D. are Burma citizens”
এর অর্থ হলো, “যে-সকল নৃজাতি যথা কাচিন, কেয়াহ, কারেন, চিন, বার্মান, মন, রাখাইন বা শান ও জনজাতিসমূহ এই রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত কোনো এলাকায় ১১৮৫ বার্মাব্দ বা ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ স্থায়ী আবাস হিসেবে বসতি স্থাপন করেছে, তারাই বার্মার নাগরিক।”
উপরের নাগরিকত্বের সাংজ্ঞায় যে-৮টি নৃজাতির উল্লেখ আছে, তাদের অধীনে মোট ১৩৫টি জনজাতি তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে অস্বীকৃত তালিকাতে আছে ৬টি জনজাতি, যাদের মধ্যে রোহিঙ্গা একটি।
রোহিঙ্গাদের মতো, ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরও একটি অস্বীকৃত জনজাতি আছে, যারা পানথাই নামে পরিচিত। এঁরা মূলতঃ হুই জাতি লোক। হুই হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হান জাতির মানুষ, যাঁরা উত্তরাঞ্চলীয় বার্মা বা আপার বার্মায় স্থায়ী।
বার্মার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে (যা এককালে আরাকান নামে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে অস্তিত্বমান ছিলো) রোহিঙ্গা ছাড়াও ইসলাম ধর্মাবলম্বী কামেইন বা কামান জনজাতির মানুষের বাস করেন, যাঁরা মূলতঃ মুঘল বংশোদ্ভূত।
উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে, রাখাইন প্রদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গারা সাংবিধানিকভাবে বার্মার স্বীকৃত নাগরিক না হলেও, কামান জনজাতির লোকেরা স্বীকৃত নাগরিক। স্বভাবতঃ প্রশ্ন উঠতে পারে, একই অঞ্চলে বাস করার পর কামান জনজাতির মুসলমানগণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত হলেও রোহিঙ্গা জনজাতির মুসলমানেরা স্বীকৃত নয় কেনো?
উপরে প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এই যে, রোহিঙ্গারা হচ্ছেন সেই বাঙালী, যাঁদেরকে এক সময় ইউরোপীয় পর্তুগীজ ও আরকানী রাখাইন বা মগ দস্যুগণ বাংলা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে দাস-ব্যবসার স্বর্গরাজ্য আরাকানে দাস জনগোষ্ঠিতে পরিণত করেছিলো।
ইতিহাসে স্বল্পজ্ঞাত ও হতভাগ্য এই বাঙালীদের একটি অংশকে আফ্রিকার দাস-বাজারে বিক্রি করা হয় এবং অন্য অংশকে রাখাইন বা মগদের কৃষিকাজ-সহ বিভিন্ন শ্রমঘন উৎপাদন ও গার্হস্থ্য কাজে ব্যবহার করা হয়। পর্তুগীজ ও মগদের হাতে বাংলার মাটিতে বাঙালীর আক্রান্ত, লুণ্ঠিত ও মগের দেশে দাসায়িত হওয়ার বিভীষিকাময় স্মৃতির অপভ্রংশ এখনও ‘মগের মুল্লুক’ হিসেবে বংলাভাষায় টিকে আছে।
আমি আমার পরবর্তী লেখায় দেখাবো কীভাবে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে আরাকানে বাঙালীর বসতি স্থাপিত হলেও ইংরেজদের বার্মা বিজয়ের পর ব্রিটিশ বাংলা থেকে ব্যাপক সংখ্যক বাঙালীর আরাকানের গিয়ে বসতি স্থাপনের বিষয়টি বার্মার জাত্যাভিমানী শাসক গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি, আর সেখান থেকেই সমস্যার সূচনা। প্রসঙ্গতঃ ইংরেজদের বার্মা প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো ১৮২৪ সালে। আর, সেই কারণেই বার্মার নাগরিকত্ব আইনের ১৮২৩ সালকে ‘কাট-অফ পয়েণ্ট’ বা বিচ্ছেদ বিন্দু হিসেবে ধরা হয়।
অর্থাৎ, ইংরেজদের সাথে বার্মার যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে বার্মার পরাজিত হওয়ার সুবাদে যাঁরা সেখানে বসতি স্থাপন করেছেন, তাঁরা সবাই দেশটির নাগরিকত্ব আইনের বহিরাগত। বর্তমান মায়ানমার সরকার তাই জাতিসঙ্ঘের কাছে প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, বার্মায় থাকার জন্য বিবেচিত হতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে বাঙালী আত্মপরিচয়ের ঘোষণা দিতে হবে।
প্রশ্ন হতে পারে, রোহিঙ্গারা যদি বাঙালী হন, তাহলে তাঁরা নিজেদেরকে বাঙালী হিসেবে দাবী না করে রোহিঙ্গা হিসেবে দাবী করছেন কেনো? আমি আমার এ-লেখার পরবর্তী পর্বে এই প্রশ্নের উত্তর-সহ বাঙালীর দাস হওয়ার কাহিনীর ওপর আলোকপাত করবো।