এক সময় মঙ্গলও জলে মোড়া এক গ্রহ ছিল, ঠিক যেমন আমাদের পৃথিবী। কালের বিবর্তনে সেই সব সাগর-নদী তথা জলরাশি সব উবে গেছে, মঙ্গল হয়েছে লালগ্রহ; লালন ফকিরের ভাষায় বলা চলে, ‘শুষ্ক নদীর শুষ্ক সরোবর’। কিন্তু মঙ্গলের জলসম্ভার কোথায় উধাও হলো? এ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্কযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
যেমন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিঙ্গাপুরের ভূ-মানমন্দিরের বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, মঙ্গলের কোনো জলই হারিয়ে যায়নি, জমা আছে আজকের লালগ্রহের অন্দরমহলে; কৃষ্ণধূসর আগ্নেয়শিলারা সব জল শুষে নিয়ে সঞ্চিত রেখেছে তাদের শরীরে। ‘নিখোঁজ’ মঙ্গলজল নিয়ে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে রাশিয়া ও জার্মানির একদল গবেষক।
তারা বলছেন, মঙ্গলের বায়ুম-লে একটা বড় ছিদ্র রয়েছে যার ভেতর দিয়ে মঙ্গলপৃষ্ঠের জলকণারা বাষ্পরূপে বেরিয়ে যায় উঁচুস্তরে। ঠিক যেমন ভেন্টিলেটরের মধ্য দিয়ে ঘরের গরম, ভ্যাপসা বাতাস বেরিয়ে যায় বাইরে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা ১৬ এপ্রিল ২০১৯ জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারসে এক প্রবন্ধে নিজেদের গবেষণার কথা তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, ওই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বেশিরভাগ জল ছড়িয়ে পড়ে শূন্যে, অবশিষ্টরা আশ্রয় পায় মঙ্গলের দুই মেরুতে।
এই ছিদ্রটা দেখা যায় পৃথিবীর হিসেবে প্রায় প্রতি দুই বছর পর পর (এক মঙ্গলবর্ষ পৃথিবীর ৬৮৭ দিনের সমান)। পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানীরা বহুবার মঙ্গলের বায়ুম-লের উঁচুস্তরে জলীয়বাষ্পের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন। দেখা গেছে, সেই সব বাষ্প পরিযাত্রা করছে গ্রহটির দুই মেরু অঞ্চলে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এও জানেন, মঙ্গলের বায়ুম-লের মধ্যস্তর ‘বেশ ঠা-া’ অন্তত ততটুকু শীতল, যে কারণে জলীয়বাষ্প সেখানে থাকতে পারে না। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, জলবাষ্প কী করে সেই মধ্যস্তর ভেদ করে উঁচুস্তরে উঠে যায়? উত্তর মিলবে অন্তত দুটো দিক থেকে।
এক. পৃথিবীতে উত্তর ও দক্ষিণÑ দুই গোলার্ধের গ্রীষ্ম প্রায় একই প্রকৃতির। কিন্তু মঙ্গলের বেলায় ব্যাপারটা সে রকম নয়। ওই গ্রহের কক্ষপথ পৃথিবীর চেয়েও বেশি উৎকেন্দ্রী। সূর্যকে ঘিরে গ্রহরা বৃত্তাকার পথে ঘোরে না। ঘোরে বরং ডিম্বাকৃতি কক্ষপথ ধরে যেখানে কেন্দ্র থেকে পরিধির পথপার্থক্য সমান থাকে না। এটাকে বলা হয় উৎকেন্দ্রিকতা।
এর মান একের নিচে হলে সেই কক্ষপথকে বলা হয় উপবৃত্ত (এলিপস)। কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতার মান ‘এক’ হলে তা অধিবৃত্ত (প্যারাবোল) এবং একের বেশি হলে তা পরাবৃত্ত (হাইপারবোল)। পৃথিবীসহ গ্রহরা সূর্যের চারধারে ঘোরে উপবৃত্তাকার পথে। পৃথিবীর উৎকেন্দ্রিকতা ০.০১৬, মঙ্গলের ০.০৯৩৪। ফলে মঙ্গলে দুই গোলার্ধের গ্রীষ্ম দুই প্রকৃতির।
দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্মে গ্রহটা সূর্যের থেকে তুলনামূলক কাছে থাকে। ফলে উত্তর গোলার্ধের চেয়ে দক্ষিণের গ্রীষ্ম বেশ খানিকটা উষ্ণতর। এ কারণে, কম্পিউটার মডেলে গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালে মঙ্গলের মধ্যস্তরে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০-৯০ কিলোমিটার উচ্চতায় একটা ‘জানালা’ খুলে যায়। ওই জানালা বা ভেন্টিলেটারের মধ্য দিয়ে জলীয়বাষ্প উঠে যায় উঁচুস্তরে।
দুই. পৃথিবীর সঙ্গে মঙ্গলের আরেকটা তফাত ধূলিঝড়ের প্রশ্নে। প্রলয়ঙ্করী ধূলিঝড়ের ইতিহাস আছে লালগ্রহের। সেসব ঝড় সূর্যের আলোকে আড়াল করে ফেলে, আর এভাবে গ্রহটির ভূতলকে শীতল রাখে। কিন্তু যে আলো মঙ্গলপৃষ্ঠে পৌঁছে না, তা বায়ুম-লকে উষ্ণ করে তোলে। যান্ত্রিক নমুনায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এভাবে বায়ুম-লে যে প্রতিবেশ তৈরি হয়, তাতে জলীয়বাষ্প সহজে এদিক-ওদিক যাত্রা করতে পারে। তারা এও বলছেন, ধূলিঝড়ের কারণে এমনকি দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্মের চেয়েও বেশি হারে জলীয়বাষ্প উঁচুস্তরে উঠে যেতে পারে।
মধ্যস্তরের বাধা মাড়িয়ে জল যখন ওপরে উঠে যায়, গবেষকরা লিখেছেন, তখন দুটো ঘটনা ঘটে। এক. কিছু জল উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মেরুমুখী যাত্রা করে, শেষে দুই মেরুতে গিয়ে জমা হয়। দুই. উঁচুস্তরে অতিবেগুনি রশ্মির কারণে জলের মধ্যকার হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন অণুর বন্ধনে ভাঙন ধরে। ভাঙনের পর হাইড্রোজেন শূন্যে ছড়িয়ে পড়ে, পড়ে থাকে অক্সিজেন মঙ্গলের বায়ুম-লে। সাড়ে তিনশ কোটি বছর আগে মঙ্গলও ছিল পৃথিবীর মতো নীলাভ গ্রহ এক। কিন্তু ওপরের দুটো প্রক্রিয়ায়, সম্ভবত বায়ুম-লের বড় ছিদ্রটা দিয়ে সেই সব জল উবে গেছে, ইতিহাসের গহ্বরে সময় হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে।