তথ্যপ্রযুক্তি, নতুন নতুন আবিষ্কার, শিল্পোন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন এসব কিছু মূল ভিত্তি গবেষণা। যারা আজ বিশ্বে উন্নয়নের শিখরে তারা নতুন নতুন গবেষণার ফলেই প্রকৃতি জয় থেকে শুরু করে নিজেদের উন্নত জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তারা গবেষণায় মেধা, সময় এবং অর্থ সম্পদের ব্যবহার করেছে অকাতরে।
গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় নতুন জ্ঞানের, যা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে অবদান রাখে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম।
বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিগত উন্নতিতে, নিজস্ব পণ্য উৎপাদন, দেশের সমস্যা সমাধানে নিজেদেরই অবদান রাখার জন্য, সর্বোপরি সার্বিক উন্নতি সাধন এবং বিশ্বে মর্যাদার আসন প্রাপ্তির প্রয়োজনে চাই উন্নত মানের গবেষণা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের আগ্রহ না থাকায় প্রতিবছর গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ফেরত যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গবেষণার অর্থ ব্যয় না হওয়ারও বেশ কিছু কারণ আছে। তবে বড় কারণ হচ্ছে অদক্ষতা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান দক্ষতার সাথে গবেষণা চালাতে পারেন না। আরো একটি কারণে গবেষণার টাকা ফেরত যায়-অনেক গবেষণার কাজে দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে বরাদ্দ খরচ করার আগ্রহ থাকে না। যার অভার রয়েছে দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে। সূত্র মতে জানা গেছে, বিদেশিরা নতুন কোনো প্রকল্প বা বিধিমালা করার আগে পর্যাপ্ত গবেষণা করে। নতুন এই প্রকল্প বা বিধিমালার প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়। আর প্রকল্প বাস্তবায়ন বা আইন করার আগে তো রীতিমতো মহা আয়োজন করে বসে। কিন্তু দেশে কোনো নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে বা জনগণের কি লাভ হবে তা কখনো করা হয় না। বরং এসব প্রকল্প বা বিধিমালা হয় গোপনে। থাকে না কোনো গবেষণা। যার কারণে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের মাঠে নামতে হয় সংশ্লিষ্টদের।
সূত্র মতে, সরকারের প্রায় সব মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ দফতরের জন্যই গবেষণা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু গবেষণায় সংশ্লিষ্টদের আগ্রহের অভাবে বছর শেষে অধিকাংশ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি বরাদ্দ ফেরত যায়। তবে হাতেগোনা কিছু প্রতিষ্ঠান গবেষণা খাতে অর্থের ব্যবহার করছে। বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় ও দফতরের গবেষণা অর্থ ফেরত যাওয়ায় ওসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের যোগ্যতা, দক্ষতা ও মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ কোনো একটা দফতর খারাপ করলে কেন খারাপ করছে তা গবেষণায় বের হয়ে আসে। ভালো করলেও গবেষণা হয়। ঐসব কারণেই প্রতিবছর গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু ব্যবহার না হয়ে ঐ বরাদ্দ ফেরত যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জনপ্রশাসন হচ্ছে সরকারের সাধারণ বাজেট-ব্যয়ের বড় খাত। অথচ এই মন্ত্রণালয়টিই গবেষণায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। আর স্বাস্থ্য বাজেটের গবেষণা খাতে বরাদ্দ খুবই কম। অথচ ঐ অপ্রতুল বরাদ্দের অর্ধেকও খরচ হয় না। তাছাড়া শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণার টাকা বছরের পর বছর অব্যয়িত থাকছে। শুধু গবেষণা যাদের কাজ সেসব প্রতিষ্ঠান খরচ করলেও বরাদ্দের পুরোটা কাজে লাগাতে পারে না। আবার এই জাতীয় কিছু প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যয়ই নেই। এজন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে এদেশের সরকারের পার্থক্য হচ্ছে গবেষণায়।
সূত্র জানায়, বিগত ৭ বছরে স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে খুবই কম। আবার ব্যয় হয়েছে সেই অপ্রতুল গবেষণা অর্থের অর্ধেকেরও কম। ঐ সময়ে স্বাস্থ্য খাতের গবেষণায় মোট বরাদ্দ ছিল ১০৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। ঐ খাতে সবচেয়ে বেশি গবেষণা ব্যয় হয় জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (নিপোর্ট)। ৭ বছরে প্রতিষ্ঠানটির জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি খরচ করতে পেরেছে ২৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণার বাজেট ছিল ২৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা কিন্তু ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ডিজিএইচএস ও বিএমআরসির জন্য বরাদ্দ ছিল ১৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা আর ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। এনসিডিসির গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা কিন্তু ব্যয় হয়েছে ২ কোটি টাকা। আইপিএইচএনের গবেষণায় বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা আর ব্যয় হয়েছে ২ কোটি টাকার কিছু বেশি।
সূত্র আরো জানায়, শিক্ষা গবেষণার জন্য পুরনো শিক্ষা বোর্ডগুলো প্রতিবছরই বরাদ্দ পায়। কিন্তু তারা ঐ টাকা খরচ করতে পারে না। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গবেষণা বাবদ তাদের জন্য বরাদ্দ করা টাকা দুই অর্থবছর ধরে ফেরত দিচ্ছে। এবারো ঢাকা বোর্ডের নামে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু গত অক্টোবর পর্যন্ত ঐ টাকায় হাত দিতে পারেনি ঢাকা বোর্ড। আর রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের জন্য গত ৫ বছর শিক্ষা গবেষণায় কোনো বরাদ্দই ছিল না। তবে এ বছর ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলেও গত অক্টোবর পর্যন্ত ঐ বাবদ কোনো টাকা খরচ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টও গত ৫ বছর গবেষণা খাতের কোনো টাকা খরচ করতে পারেনি। এবারো তাদের নামে এক লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তবে তারা এখন পর্যন্ত এক টাকাও খরচ করা যায়নি। একইভাবে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) চলতি বছর শিক্ষা গবেষণার জন্য ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু গত অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি একটি টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। তবে গতবারের বরাদ্দের পুরোটাই খরচ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যানবেইসের একজন কর্মকর্তা। তাছাড়া জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) গত ৪ বছরে গবেষণার জন্য বরাদ্দ পেয়েছে ১১০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করতে পেরেছে। আর চলতি বছর ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ পেলেও গত অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দেড় লাখ টাকা খরচ করা সম্ভব হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশ ইউনেসকো জাতীয় কমিশন ৩ বছর ধরে শিক্ষা গবেষণার টাকা পেলেও খরচ করতে পারছে না। গবেষণার টাকা খরচ করতে পারেনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটও। দু’বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি বরাদ্দ ফেরত দিচ্ছে। চলতি বছরও ঐ প্রতিষ্ঠানকে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত ঐ টাকায় হাত দেয়া যায়নি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের জন্য গত অর্থবছরে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা আর খরচ হয়েছে মাত্র ৫১ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত একই অবস্থা ছিল ঐ বোর্ডের গবেষণা খাতে। আর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণা খাতে গত পাঁচ বছরে বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা কিন্তু ব্যয় হয়েছে ৯৮ লাখ টাকা। তাছাড়া গবেষণার টাকা ব্যয় করতে পারে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতর-অধিদফতরগুলোও। তবে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। একইভাবে শিক্ষা-গবেষণাবিষয়ক খাত নেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতর, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড, সিলেট শিক্ষা বোর্ড, দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড, বরিশাল শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, মন্ত্রণালয় অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণার টাকা খরচ করতে না পারলেও মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের টাকা ঠিকই খরচ হয়েছে। গত পাঁচ বছরে শিক্ষা গবেষণা খাতে জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৬ কোটি টাকা। তার মধ্যে ২৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে দফতরগুলো গবেষণা করতে পারলে ভালো হয়। কারণ তাতে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করে বলে সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া সহজ। ফলে দফতরগুলো গবেষণা করলে যথাযথ সমাধান মেলে। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক সংস্থা কৃষি বিষয়ে গবেষণা করে এবং ব্যয়ের হারও অনেক বেশি। তারপরও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজস্ব বিষয়ক গবেষণার জন্য বরাদ্দের অর্ধেকও খরচ করতে পারে না। গত ৬ বছরে সংস্থাটির জন্য এ বিষয়ে বরাদ্দ ছিল ৮৩২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। অথচ খরচ করেছে চার ভাগের এক ভাগ। উন্নয়ন ও কর্মসূচি সংক্রান্ত গবেষণা-বাজেটের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছে তারা। তাছাড়া গবেষণা খাতের জন্য বরাদ্দ করা টাকা খরচ করতে পারেনি পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটও। আর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের গবেষণা খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। তার মধ্যে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সুপারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউিট, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, তুলা উন্নয়ন বোর্ড গবেষণা বরাদ্দের প্রায় পুরোটাই খরচ করে।
তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই। আর এই জন্য দেশের সরকারি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে একটি কাঠামোয় এনে গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। সরকারকে যেমন দেশের বাজেটের আরেকটু বেশি অংশ গবেষণায় বরাদ্দ করতে হবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নির্দিষ্ট রূপরেখা দিতে হবে- এর গবেষণা খাতে অর্থব্যয়ের কাঠামো তৈরিতে।