কিশোয়ার লায়লা:
আমাদের দাদাবাড়ি কুমিল্লার ময়নামতি। কুমিল্লা শহরেও আমাদের একটা দাদাবাড়ি ছিল। পঞ্চাশের দশকে আমার দাদা সন্তানদের বিশেষ করে তাঁর মেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধার জন্য শহরের বাদুড়তলায় ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ঠিক পেছনেই বাড়ি করেন। ঐ বাড়িতে থেকেই আমার বাপ-চাচা-ফুপিরা পড়াশুনা করেন। আমিও আমার স্কুল জীবন শেষ করি ঐ বাড়িতে থেকে।
ফয়জুন্নেসা স্কুলের পাশ ও পেছনের বিশাল এলাকায় মুসলিম বাড়ি ছিল হাতেগোনা। ৪/৫টি। আমার আলহাজ্ব দাদা পঞ্চশের দশকে একটা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় জায়গা কিনে বাড়ি করেন। ঐ বাড়িটি ছিল অনেকটা দ্বীপের মতো। চারপাশে হিন্দু পরিবার আর মাঝে আমরা। আমাদের জানালা থেকে হাত দিয়ে যাদের বাড়ির দেয়াল স্পর্শ করা যেতো তারা ছিল একেবারে খাঁটি ব্রাহ্মণ। ঠাকুরবাড়ি হিসাবেই নামডাক ছিল সে বাড়ির।
আমাদের বাড়ির গেইটের পাশের লাগোয়া বাড়িতে থাকতো হিন্দু ধর্মের তথাকথিত শ্রেণী বিন্যাসের নিচের স্তরের একটি পরিবার।
সন্ধ্যা নামলে একদিকে মাগরিবের আযান অন্যদিকে কাঁসার ঝনঝনানি আর উলু ধ্বনি। কখনো আযান আগে, কখনো উলুধ্বনি আগে। একসাথে খুব একটা হতো না।
বিশেষ করে আযান শুরু হয়ে গেলে কোন এক বিশেষ কারণে হিন্দু পরিবারগুলো উলুটা একটু পরেই শুরু করতো। আর আগে উলু হয়ে গেলে বুঝে যেতাম এখনই আযান পড়বে। কারণ আযানের সাথে আমাদের পড়ার টেবিলে যাওয়ার সম্পর্ক ছিল। আর পূজার সময় আমাদের বাড়িটিকে মনে হতো অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রেতপুরী। কারণ চারপাশের আলোর ঝলকানিতে আমাদের বাড়ির রং হতো ফিকে। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা ঢাক- ঢোল আর উলুধ্বনিতে একাকার হয়ে থাকতো পুরো পাড়া। মণ্ডপে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেতাম। ঠাকুরবাড়ির পূজার প্রসাদও খেয়েছি বেশ কয়বার। পূজাকে আলাদা কোন উৎসব মনে হতো না। আপন আপন লাগতো।
তপন দিদি নামের একজন বড়ো নৃত্যশিল্পী আছেন কুমিল্লায়। তাঁর কাছে নাচ শিখতাম। (অপ্রাসঙ্গিক তথ্য, অভিনয়শিল্পী তারিনও আমার সাথে একই স্কুলে পড়তো এবং এই দিদির কাছেই নাচ শিখতো। বয়সে আমার এক বছরের ছোট) মনে আছে, নাচ শিখতে গেলে পাশের ঘরের কোণায় রাখা ছোট পূজার ঘরটি দেখতে আমরা প্রায়ই পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারতাম। দিদির রান্না ঘরে আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। পূজা এলেই দিদি দাওয়াত করতেন আর দল বেঁধে তা খেতে যেতাম। যত রাতের লগ্নই হোক না কেন দিদির মেয়েদের বিয়েতে পরিবারসহ যেতে ভুল হয়নি কখনো।
নিরামিষ (দিদিরা বলতেন লাবড়া) যে এত মজার হতে পারে তা আজ পর্যন্ত জানতাম না সেই দিদির বাড়িতে না খেলে। মনে আছে, বিয়েতে দাওয়াত করতে এসে দিদি, মা-চাচীদের আশ্বস্ত করে বলতেন, আমার ছাত্রীদের পরিবারের জন্য মুরগী/ছাগল হোটেল থেকে কাটিয়ে (হালাল জবাই) এনেছি। তখন অবশ্য হালাল-হারামের বিষয় জানা ছিল না।
আজ ফেইসবুকে তুমি হিন্দু, আমি মুসলিম, তোমার ধর্ম খারাপ-আমারটা ভাল এসব সংবাদ পড়তে পড়তে পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো। আমার ছোটকাল তো খুব বেশি আগের কথা না। এই তো সেদিন ফেলে আসলাম! তখন কী এসব হিন্দু-মুসলিম খেলা খেলতাম আমরা? বা আমাদের বাপ-দাদারা? তাঁরাও কী এতো হিসাব নিকাশ করতো?
আমাদের চার ভাই বোনের জীবনের প্রথম শিক্ষক ছিলেন ভূপেন্দ্র স্যার। শুধু শিক্ষক নন, ঊনি আমাদের পরিবোরেরই একজন ছিলেন। আমাদের বিদ্যা বুদ্ধির বেশিরভাগ অবদানই ঊনার। স্যারের হাত ধরেই আমরা যেতাম শহরের টাউন হলের বৈশাখী মেলায়। ডুগডুগি, মুড়ি-মুড়কি, তরমুজ আর তালপাতার সিপাই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম আমরা।
এখন সব আটকে গেছে দুটো শব্দে। সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু। আমার যতদূর মনে পড়ে, শব্দ দুটি লসাগু-গসাগু অংক করার সময় প্রথম শিখেছিলাম। কিন্তু এখনকার কেজি’র বাচ্চারাও শব্দ দুটির পার্থক্য শিখে গেছে। ধর্মের পার্থক্যে মানুষকে চিনতে শিখে যাচ্ছে তারা।
এই শিক্ষা নিয়ে তো আমরা বড়ো হইনি। কই আমরা তো ভালোই ছিলাম। আর ভালো ছিলাম বলেই আজ এ ধরনের খবরগুলো মেনে নিতে পারি না। অবাক হই। সত্যিই- যায় দিন ভাল- আসে দিন খারাপ। কিন্তু এতোটা খারাপ যারা করছে তার আসলে কী চায়?
কিশোয়ার লায়লা
সাংবাদিক, টরন্টো