নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে পুলিশ বাহিনীতে পেশাদারিত্ব কমে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুলিশকে ব্যবহার এই বাহিনীর পেশাদারিত্ব কমে যাওয়ার আরো একটি বড় কারণ। পুলিশ অপরাধ করলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়ায় এ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এছাড়া সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী ও সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে নির্যাতনের ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে পুলিশের ভূমিকা। তবে কোনোও পুলিশ সদস্যের ব্যক্তিগত দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না বলে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যত অভিযোগ যায়, এর বেশিরভাই পুলিশের বিরুদ্ধে। এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ পুলিশই তদন্ত করে যে কারণে সঠিক তদন্তের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে ন্যায়বিচারের পথটিও বাধাগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তারা। একইসাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখতে একটি স্থায়ী টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাটিও ঝুলে রয়েছে।
পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া হয়ে ওঠা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (তদন্ত) নূর খান লিটন বলেন, যখন একটি বাহিনীকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করা হবে, তখন ঐ বাহিনীর সদস্যরা মনে করবেন রাষ্ট্র কিংবা সরকার তাদের ওপর নির্ভরশীল। বাহিনীর কোনো সদস্যের মানসিকতা যদি এমন হয় যে, সরকারকে আমরাই ক্ষমতায় এনেছি ও টিকিয়ে রেখেছি, তখন ঐ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রবণতাও বেড়ে যায়।
নূর খান আরও বলেন, বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে যদি আঞ্চলিকতা ও গোষ্ঠীগত বিষয়টি প্রাধান্য পায় ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন ঐ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব বাড়বেই। বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়বে, শৃঙ্খলাও নষ্ট হবে। তিনি বলেন, সাবেক আইজিপি, সচিব ও বিচারপতিদের দিয়ে কমিটি গঠন করে বাহিনীর দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে, তাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, আইনের শাসন ও বাহিনীর সদস্যদের নিবিড় মনিটরিং না থাকায় পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কারণেও পুলিশ সাধারণ নাগরিকদের প্রতি এমন আচরণ করছে। এছাড়া, বিগত সময়ে যেসব পুলিশ সদস্য অন্যায় আচরণ ও অপরাধ করেছেন, সেগুলোর সঠিক তদন্ত ও বিচার হয়নি। ফলে প্রতিদিন অন্য সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনে উৎসাহিত হচ্ছে। এগুলো যতক্ষণ কঠোর হস্তে দমন করা না হবে, ততক্ষণ পুলিশের মানবাধিকার লঙ্ঘন থামবে না।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, পুলিশ প্রোঅ্যাকটিভ না হয়ে রিঅ্যাকটিভ হয়ে গেছে। পুলিশের মধ্যে শাস্তিহীনতাই এ ধরনের আচরণের মূল কারণ। পুলিশের অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত হয় না। আর্থিক লেনদেনে চাকরি নেয়া ও রাজনৈতিকভাবে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়টিকেও তিনি এজন্য দায়ী করেন। তার মতে, মানবাধিকার বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। এর কোনও বিকল্প নেই।
সালমা আলী আরো বলেন, পুলিশ সদস্যদের অপরাধ তদন্ত ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন থাকা দরকার। যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। পুলিশের অপরাধের তদন্ত পুলিশ দিয়ে করালে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, যখন কোনো বাহিনী রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন ঐ বাহিনীর চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে যায়। আর সেটা হলে সদস্যদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। সে কারণে পুলিশ সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনে উৎসাহিত হয়। পুলিশের নির্যাতনের শিকার সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে দেখতে গিয়ে গত শনিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের দায়মুক্তির মনোভাব গড়ে উঠেছে। তারা ভাবছে, তাদের কিছু হবে না, কোনও কিছু তাদের স্পর্শ করবে না। এমন মনোভাবের কারণে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এটাই স্বাভাবিক। এর পরিণতি কখনই ভালো হবে না। অবশ্য ডিএমপি কমিশনার সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, পুলিশের যারা অপরাধ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরাও তার কথায় আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে চাই।
সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাস ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে পুলিশের নির্যাতনের বিষয়ে ড. মিজানুর রহমান আরও বলেন, তাদের যেভাবে পুলিশ নির্যাতন করেছে, তা দেশি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদ-ে, সাংবিধানিক অধিকার ও নির্যাতনবিরোধী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ সময় তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এ দুইজনের ক্ষেত্রে অন্তত, দৃষ্টান্ত রাখুন। প্রমাণ করুন আইন সবার জন্য সমান। পুলিশের কেউ অপরাধ করলেও রাষ্ট্র তা সহ্য করবে না সেটা আমরা দেখতে চাই। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও যথাযথ জায়গায় আবেদন ও সুপারিশ করা হবে বলে জানান তিনি।
সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাস ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীর ওপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনাসহ রাজধানীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গত শনিবার সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম। আনুষ্ঠানিক এ সাংবাদিক সম্মেলনে এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, অপরাধ যেই করুক তার বিচার প্রচলিত আইন ও নিয়মে হবে। এসব বিষয়ের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য পুলিশের মধ্যে কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে।