আফ্রিকার আকাশরাজ্য বলে পরিচিত লেসোথোর রাজধানী মাসেরু শহর থেকে আমরা খুব একটা দূরে নই। এদিকে গ্রাম বা জনপদের কোনো নিশানা দেখি না। প্রকৃতি এখানে এমন নির্জন হয়ে আছে যে— আমি, আমার ভ্রমণসাথী হলেন ও আমাদের সাংস্কৃতিক গাইড কবিয়াল তাংকিসানের পদচারণের শব্দ দীর্ঘ ঘাসে বয়ে চলা বাতাসের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে সড়সড় করে বাজে। পাহাড় এখানে পিছু হটে জায়গা করে দিয়েছে দিগন্তপ্লাবী প্রান্তরকে। স্থানে স্থানে বেজায় রকমের খোলামেলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা কালচে, ধূসর ও ফিকে গোলাপি রঙের শিলা পাহাড়গুলোকে প্রকৃতির বৈঠকখানায় সাজিয়ে রাখা ভাস্কর্যের মতো দেখায়। ঘণ্টাখানেক আগে এইডস রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কবিয়াল ভাইরাল ড্রাগ নিয়েছেন। তার দেহে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে; শ্বাসকষ্টে তার বুকে হাঁপরের ওঠানামার শব্দ হয়। তিনি একটি শিলা পাহাড়ের দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লে হলেন তাকে আরো দু-তিনটি ওষুধ খেতে দেয়। এ যাত্রায় রওনা হওয়ার সময় তাংকিসানের জার্মান গার্লফ্রেন্ড রোজমেরি হলেনকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি ওষুধ খান বটে, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরকে ড্রাগ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রোজমেরির বিরুদ্ধে হালকা বিষোদ্গার করে হলেনের হাতের ‘লোনলি প্লানেট’ বইটি দেখিয়ে তাকে মাতৃ সম্বোধন করে বলেন, ‘হেই বিউটিফুল মামা, রিড, টেল মি— এ বইয়ে শ্বেতাঙ্গ লেখক আমাদের রাজাকে নিয়ে কী লিখেছে?’
হলেন লোনলি প্লানেট থেকে লেসোথো রাজ্যের ইতিহাসের চ্যাপ্টার পড়তে শুরু করে। ১৮২০ সালের কথা। আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চলের জুলু সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণবাদী আক্রমণে যখন নাটাল এলাকা থেকে দলে দলে শরণার্থীরা দিগ্বিদিক ছুটছিল, তখন বাসোটো গোত্রের দলপতি মশোশো উদ্যোগ নেন কলেডন নদীর কাছাকাছি লেসোথো রাজ্য গড়ে তোলার। সামান্য এক জনগোষ্ঠীর প্রধান হলেও হিম্মত ও সমর প্রতিভা দুই-ই ছিল তার। ১৮৬৪ সালে দলপতি মশোশো অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের ওলন্দাজদের বংশধর উপনিবেশবাদী বুয়ারদের সামনাসামনি লড়াইয়ে পরাজিত করেন। তার পর কূটনৈতিকভাবে জুলুদের সঙ্গে আপসরফা করে ব্রিটিশদের উপনিবেশ কেইপ কলোনির সাহায্য প্রার্থনা করেন। কলোনির ইংরেজ প্রশাসক সহযোগিতায় গড়িমসি করলে তিনি প্রতিনিধি পাঠান সরাসরি লন্ডনে। অবশেষে বিলাতের রাজা মশোশোর শাসনের অধিকার স্বীকার করে তার দেশকে প্রটেক্টরেট বা আশ্রিত রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। সে অবধি ছোট্ট এ দেশটির দেখভালের দায়িত্বে আছেন তার উত্তরপুরুষরা। বর্তমানে তারই এক প্রপৌত্র দ্বিতীয় লিটসাই শাসনতান্ত্রিক রাজা হিসেবে দেশ চালাচ্ছেন। লেসোথোর এ ইতিহাসে কিঞ্চিত গৌরব আছে। তাদের এ ছোট্ট দেশ কখনো ইউরোপীয়দের সরাসরি উপনিবেশ হয়নি। ইতিহাস শুনে কবিয়াল তাংকিসান চাঙ্গা হয়ে উঠে বলেন, ‘ইয়ে মামা, হোয়াইটম্যান ডোন্ট নো— রাজা মশাশো চলাচলের জন্য ব্যবহার করতেন সিক্রেট রোড। চলো, আমি তোমাদের সে পথে নিয়ে যাব মানুষখেকো সম্প্রদায়ের গ্রামে।’ তিনি তার লাঠিতে বাঁধা শুকনো সব গাছের গোটা ঝনঝন করে বাজিয়ে আগে বাড়লে আমি ও হলেন খানিক ইতস্তত করে অবশেষে তাকে অনুসরণ করি।
এবার আমাদের নামতে হয় টাট্টু ঘোড়া চলাচলের জন্য তৈরি একটি ট্রেইল ধরে। পাহাড়ের নিচে কুয়াশায় ছাওয়া একটি শ্যামল প্রান্তর। এদিকে হাওয়া বয় হুহু করে। মাঝে মধ্যে দেখা হয় একটি-দুটি নিঃসঙ্গ রাখাল। সঙ্গে তাদের সওয়ারি সব টাট্টু ঘোড়া। তারা কম্বলে শরীর মুড়িয়ে চরিয়ে বেড়াচ্ছে গরু ও লোমশ ছাগল। আমরা একটি বৃহত্ গাছের নিচে এসে থামি। বৃক্ষটির কাণ্ড ঢাকা পড়েছে নানা আকারের পাথরের ছোটবড় চাইয়ে। আশ্চর্য হই গাছটিতে তিন ধরনের পাতা দেখে। এখান থেকে খানিক দূরে শিলা পাহাড়ের দেয়াল খুঁড়ে তৈরি এক সারি গুহাঘর। তাংকিসানের বাচনিতে জানা যায়, ১৫০ বছর আগেও এসব গুহায় বাস করত ক্যানিব্যাল বা মানুষখেকো আদিম সম্প্রদায়ের ক’টি পরিবার। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রাজা মশোশো একবার এ গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার নির্দেশে তারা মানুষের মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সবজিভোজী হয়। অনেক দিন এ গুহাগুলো অযত্নে পড়ে ছিল। কিছুদিন আগে বর্তমান রাজার বৈমাত্রেয় বোন, যিনি লেসোথোয় পর্যটন শিল্পের বিকাশে অত্যন্ত উদ্যোগী রাজকুমারী হিসেবে পরিচিতা, মানুষখেকোদের বংশধরদের ডেকে এনে আবার গুহার পত্তনি দিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য এদিকে পর্যটকদের আগমন বাড়ানো। এককালের মানুষখেকোরা আজকাল রুটিফুটি, ভাত-তরকারি খাচ্ছে— এসব বিজ্ঞাপন দিয়েও ফায়দা কিছু হয়নি। পর্যটকরা এদিকে পা বাড়াতে একদম নারাজ। আমি ও হলেন গুহা অবধি গিয়ে তার সামনে খেলতে থাকা কম্বল গায়ে শিশুদের সঙ্গে কথা বলি। কবিয়াল তাংকিসান এখানেও একটি জুতসই গাছের তালাশ পান। গাছের নিচে বসে তিনি পাইপে দাকখা পুরে কষে দম দেন। বাতাসে ছড়ায় শুষ্ক মঞ্জরির মাদক সৌরভ।
তাংকিসান দাকখা সেবন শেষে ধুন ধরে ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। তার পর ধড়মড় করে জেগে উঠে হলেনকে মিঠে জবানে বলেন, ‘বিউটিফুল মামা, অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ দিয়ে রোজমেরি আমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না। শরতের প্রারম্ভে যখন ড্রাকেনসবার্গ পর্বত থেকে উড়ে আসবে সাদা মেঘদল, আকাশে উড়বে পরিব্রাজক পাখির ঝাঁক, হাঁপানির ক্রমাগত টানে আমার শরীর হয়ে আসবে মাতৃ উদরে শুয়ে থাকা শিশুর মতোই কুঁকড়ে থাকা, আমি কায়ক্লেশে বেঁচে থাকব সন্ধ্যা অবধি, তার পর আকাশে দ্বিতীয়ার সরু চাঁদ দেখা দিতেই আমি বালিমো বা পূর্বপুরুষদের হাত ধরে চলে যাব ওপারে।’ স্বগোতক্তি শেষ হতেই তিনি দাকখার জ্বলন্ত পাইপ এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এ গাছের ছায়ার সঙ্গে এবং শুষ্ক মঞ্জরির প্রতিটি পাপড়ি ও রেণুতে যোগাযোগ আছে ভিন্ন এক বিশ্বের, এখানে বসে দাকখা খেয়ে খোদ মশোশো জেনে নিয়েছিলেন তার ভবিতব্য, বিশ্বাস না হলে তোমরা দম দিয়ে দেখতে পারো, কীভাবে খুলে যায় ভিন্নলোকের খিড়কি দুয়ার।’ অন্যলোকের খিড়কিপথে খানিক উঁকি দিতে আমার বাসনা হয় বটে, কিন্তু হলেন যেভাবে তাকিয়ে আছে, তাতে কাজটি পারিবারিক শান্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক নিরাপদ মনে হয় না।
বিকালের আলো ক্রমাগত লুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের আড়ালে আবডালে। হাঁটতে হাঁটতে অবসন্ন লাগে, তাই আমরা গেস্টহাউজের রোন্ডাবেলে ফিরতে চাই, কিন্তু তাংকিসান ছন্নছাড়া গতিতে জোর কদমে হাঁটেন খানিক খোলা ফিকে গোলাপি রঙের এক এবড়ো খেবড়ো পাথুরে প্রান্তরের দিকে। তার ভাবগতিক দেখে মনে হয়, তিনি আমাদের আজই লেসোথো সংস্কৃতির অন্দরমহলে ঢুকিয়ে ছাড়বেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাদামি রঙের ঘন ঘাসের ফাঁকে একটি পায়ে চলা পথ উলুবোড়া সাপের মতো এঁকেবেঁকে উঠে গেছে ঊর্ধ্বে, তার শেষে রীতিমতো ঝুলে আছে একটি গ্রাম। আমরা ওখানে পৌঁছতেই দেখি— গাঁয়ের বারোয়ারি আঙিনায় শোরগোল করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে একটি বালিকার সদ্য ঋতুমতী হওয়ার অনুষ্ঠান। মেয়েটিকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার কিশোরীরা। তাদের দেহে বস্ত্র অতিস্বল্প, নিরাভরণ ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে সবুজ, নীল, হলুদ ও লোহিত বর্ণের একাধিক পুঁতির মালা। কেবল যাকে নিয়ে অনুষ্ঠান, তার বুক ঢাকা কচ্ছপের খোলের বন্ধনীতে। খানিক দূরে এক বৃদ্ধ ‘থামো’ বলে এক তারের বাদ্যযন্ত্রে টুংটাং ধ্বনি তুলছেন। তাংকিসান যেন এ আসরের আমন্ত্রিত শিল্পী, এমন ভঙ্গিতে তিনি তার পাশে বসে ঝোলা থেকে বের করে বাজাতে শুরু করেন ‘লিকোলুলো’ নামের বাঁশরী। পাড়ার অল্প বয়সী ছেলেরাও এসে যোগ দেয়। তাদের বুক ও মুখ খড়িমাটির সাদা রঙে চিত্রিত বলে তরুণদের মামদো ভূতের মতো দেখায়। ছেলেরা দু’বাহু ঝাঁকিয়ে ‘যু-যো-যো’ করে শব্দ তুললে সারা আঙিনা যেন ভরে ওঠে অজস্র মৌমাছির গুঞ্জনে। এ শব্দ সংক্রমিত হয় কিশোরীদের দেহে। অতিঢিমে তালে তাদের দেহ নৃত্যে লীলায়িত হলে একজন নারী ‘নগাকা’ অলঙ্কারের বাক্স খুলছেন, এরূপ ডেলিকেট ভঙ্গিতে ঋতুমতী বলিকার কাঁচুলি খুলে নেন। নৃত্যরতা কিশোরীরা উলুধ্বনি দিয়ে তাদের স্টেপের দ্রুততায় বৃত্তাকারে পরস্পরের কাছাকাছি এসে চারদিকে ধুলা উড়িয়ে তৈরি করে ফুটন্ত ফুলের আকৃতি। নারী নগাকা এবার পালক দিয়ে বালিকাটির স্তনে শিশির মাখিয়ে দেন। অতঃপর তিনি গোলাপি কাদামাটি দিয়ে আল্পনার মতো করে আঁকেন দুটি ফুল্ল নকশা।
আঁধার নেমে আসছে বলে আঙিনায় জ্বেলে দেয়া হয় একটি হ্যাজাকবাতি। ছেলেমেয়েরা পর পর দুটি বৃত্ত রচনা করে ঋতুমতী বালিকাটিকে কেন্দ্রে রেখে নেচে যাচ্ছে তুমুল ছন্দে। তার চিত্রিত স্তন ঘিরে তখন ঝলমল করছে সবুজ-নীল-হলুদ ও ডগমগে লোহিত বর্ণের পুঁতির মালা। কচ্ছপের দুটি খোল দিয়ে সবাইকে পরিবেশন করা হচ্ছে ভেষজগন্ধী পানীয়। না খেয়ে উপায় নেই, তাই খানিক গলায় ঢালি। সদ্য নারী হওয়া মেয়েটি এবার খিলখিল করে হেসে একা একা নেচে যাচ্ছে বৃত্তের অভ্যন্তরে।
হ্যাজাকবাতিটির চারপাশে ওড়ে একরাশ পোকা। আমি তাদের উড্ডীন রেখার দিকে তাকিয়ে থাকি। কোথায় যেন কী উলটপালট হয়ে যায়। নিমেষে মুছে যায় সব নৃত্য দৃশ্যপট। ঠিক বুঝতে পারি না আমি, কোথায় আছি? মনে হয়, নিজ গাঁয়ের বাজারের পথ ধরে হাঁটছি। গরু হাঁটার পাশে গাছের ডাল থেকে ঝুলছে জ্বলন্ত হ্যাজাক। উজ্জ্বল এ আলোকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে জড়ো হয়েছে বেশকিছু মানুষ। এক ফেরিওয়ালা শাহ আব্দুল করিমের বাউলা গান শেষ করে উদ্যোগ নিচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ বলে একটি টনিক বিক্রির। বাতির দম ফুরিয়ে গেলে সে উবু হয়ে বসে তাতে পাম্প করে। তার মাথার ওপর উড়ে বেড়ায় একরাশ আলোভুক পোকা।