ইশরাত জাহান ঊর্মি:
সেইদিন অন্ধকার করে বৃষ্টি নামছিল। আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায় কাকভেজা। কৃষি ব্যাংকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি।
তুমুল কিশোরী। বৃষ্টি দেখি। বৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখি, বারান্দার কোণার মধ্যে লোকটা বসা। আধ ময়লা সাদা গেঞ্জি আর ধুতী, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মনে রাখার বড় দায়। জীবনে কত বড় বড় ঘটনাও ভুলে গেছি। আবার ছোট ছোট কিছু ঘটনা কেন এতোটা গেঁথে থাকে আমি বুঝতে পারি না। এটা কি আমার কোন সমস্যা? কিন্তু খুব গেঁথে আছে।
কম করে হলেও বছর বিশেক আগের কথা। ধুতী আর গেঞ্জি পড়া ম্লান চোখের লোকটি। সেই বিকাল।
তসলিমা নাসরিনের “লজ্জা” তখন খুব আলোচনায়। ছোট্ট একটা থানা শহর আমাদের। তাও হিন্দু অধ্যুষিত। বাবা-মা বা পরিবারের কেউই কখনও হিন্দুরা যে আলাদা জাতের, আলাদা পাতের এরকম কিছু আমাদের ভেতরে ঢোকায়নি। জানিনা উল্টো কী বিচিত্র কারণে আব্বুর বন্ধুরা সব হিন্দু, আম্মুরও সব প্রিয় দিদি আর মাসীমারাই। ভাইয়ার বন্ধুরা হলো গৌতমদারা। স্কুলে আমিও একটু হিন্দু মেয়েদের বেশি ভালোবাসতাম, নামের কারণে। সুপর্ণা, স্বরলিপি, লিপিকা, কী সুন্দর বাংলা নাম ওদের! মুসলমানরা বাংলা নাম কেন রাখে না এনিয়ে একটু গোপন দু:খ ছিল। পূজায় সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিমাকে একটা প্রণাম করে ফেলার বাচ্চামো ছিল। তখন তো সরল আর গরলহীন ছিল জীবন।
তো সেইসময় “লজ্জ্বা” খুব আলোচনায়। কোনদিন জাতপাত আলাদা না মানারাও বলতে শুরু করলেন,
” হিন্দুরা কী এদেশে থাকে না কি? যতো যা কিছুই করুক, ইন্ডিয়াতে ওরা গোপনে গোপনে ঠিকই সব নিয়ে যায়।”
বাবরী মসজিদ উসকে দিয়েছিল এসব আলোচনা আর “লজ্জা”। ওই বয়সে কি খুব রাজনীতি সচেতন ছিলাম? মনে হয় না। কিন্তু কেন যেন ঐ ঘোলা চোখের লোকটাকে চেপে ধরি আমি।
: দাদু, আপনি আমাকে বলেন তো, কেন আপনারা ইন্ডিয়া চলে যান?
লোকটা কেবল এড়ায়। হয়তো ভাবে, এইটুকু মেয়ে, এইসব কেন জানতে চায়। আমি কিন্তু ছাড়ি না। আবারও জানতে চাই। বলেন তো,
: কেন? কেন যান ইন্ডিয়া?
লোকটা মাত্র দুইটা বাক্য বলে, আজও বুকের ভেতর গেঁথে আছে বাক্য দুইটা।
” গরু চুরি করে নিয়ে যায়, মেয়েছেলে ঘরে রাখা যায় না, ভয় দ্যাখায় খালি…”
কী নিদারুণ বাক্য দুটো! কেউ কি বুঝতে পারেন কী নিদারুণ দুটো বাক্য শুনেছিল কিশোরী একটা মেয়ে!
কৃষকের হালের গরু আর ঘরের মেয়ে যদি না পায় নিরাপত্তা, তাহলে সে কী দেশ ধুয়ে পানি খাবে? তাই তারা চলেই যায়। ওই ম্লান চোখের গরীব লোকটা যেমন যায়, অনেক বড়লোক, বিশাল বাড়ি আর ভরভরন্ত সংসারের প্রদ্যুত কাকু- যে দুদিন আগেও বাসায় দাওয়াত খেয়ে গেছে ঈদের, শুনি, রাতের অন্ধকারে না কী চলে গেছে ইন্ডিয়া!
তার এক মেয়ে পিউ, কাকীমা, কী যে অপূর্ব সুন্দরী! এসব গল্প, উপন্যাস নয়। সত্যি, সত্যি। কেন যায় তারা? ইন্ডিয়া তাদের খুব ভালো লাগে, ধর্ম তারা খুব ভালোবাসে! আর আমি যে স্বরস্বতী পূজায় এতো ফল কাটলাম, এতো পলাশ ফুল খুঁজে আনলাম স্কুলের পূজায়? আমার কথা একবারও না ভেবে নীলিমা দে’রা হাওয়া হয়ে গেল!
যত দিন গেছে ধীরে ধীরে বুঝেছি, আমি আর আমার মতো আরও কেউ কেউও ভয়ংকর সংখ্যালঘু। সংখ্যালঘুত্ব আসলে ধর্ম দিয়ে ঠিক হয় না। চিন্তা আর ভাবনার জায়গায় বিচরণ করে সংখ্যালঘু আর গুরুর ধারণা।
কিন্তু এটাও তো ঠিক, “বাংলাদেশের এই হিন্দুরা সরকারি ও বেসরকারি অনেক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত। গান, নাচ, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, প্রচারমাধ্যম, রাজনীতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। সমাজে সবক্ষেত্রে তাদের অবস্থা সম্মানজনক।”
— এই ভাবনারও আসলে মানে নেই কোন। ওই যে গরু চুরি যাওয়া আর মেয়ের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা হিন্দুরা এই সর্বক্ষেত্রে অবস্থান করাদের মধ্যে নেই। একজন গরীব মুসলমান আর গরীব হিন্দুর মধ্যে পার্থক্য আছে, অবশ্যই আছে, স্বীকার করেন আর না করেন।
আর রানা দাশগুপ্ত’র মতো হিন্দু নেতারা? বাংলাদেশের হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক হবেন না, এমন কথা তো কোথাও লেখা নাই। সাম্প্রদায়িকতা সব মানুষের ভেতরেই আছে। আমি ভাবি, এই যে এমন একটা সর্বব্যাপী যুদ্ধর মধ্য দিয়ে, মুক্তির যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা দেশ পাওয়া, একটি মুক্ত-স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখা, সেই দেশটি এতোটা মিসিং কেন মুসলমান-হিন্দু, সর্বোতভাবে সবার মন থেকে?
একটা ছোট্ট দেশের মধ্যে এতোগুলো “দেশ”-এর ধারণা নিয়ে কিভাবে একটা জীবন পার করে দিচ্ছে মানুষ? এতো এতো বিভক্ত ভাবনা, এতো এতো বিভক্ত চেতনা নিয়ে এই দেশটি, বাংলাদেশ নামের খুব মধুর আর বিধূর দেশটি শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে?