চারপাশে বিশ্বকাপ ডামাডোল। কে থাকছে, কে থাকছে না, কার প্রস্তুতি কেমন চলছে- এ নিয়েই অজস্র আলোচনা। অথচ পঞ্চাশ ওভারি ফরম্যাট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখা মুমিনুল হক ওইসব আলোচনায় নিতান্তই ‘ব্রাত্য একজন’। কেন এমন ঘটল? পেছন ফিরে মুমিনুল দেখেন মানুষের কথায় অযাচিত প্রভাবিত হওয়ার ভুল মনস্তত্ত্ব। মানুষ বলত, তিনি টেস্ট ক্রিকেটার। শুনতে শুনতে বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন তিনি নিজেও। সেই ভুল বিশ্বাসের স্রোতে ভেসে ছিটকে গেছেন ওয়ানডে থেকে। তবে এতদিনে ভুল বুঝতে পেরেছেন কক্সবাজারের এ বাঁহাতি তরুণ। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন নতুন করে- ক্রিকেট মাঠে, পারিবারিক জীবনেও।
প্রশ্ন: বিয়ে করছেন, কেমন যাচ্ছে নতুন জীবন?
মুমিনুল: নতুন ভাবে সবকিছু শুরু করতে হচ্ছে। সংসারে নতুন মানুষ এসেছে। মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতে হবে। একটা বন্ধন গড়ে উঠবে। একেক জন বিয়েকে একেকভাবে ব্যাখ্যা করে; কিন্তু আমার কাছে খুবই আনন্দের। উপভোগ্যও। আমি দেখি এভাবে, আমার পরিবারে নতুন কেউ আসছে। মানুষ যখন বিয়েসাদি করে তখন জীবনটা আরও সুন্দর হয়। পরিপূর্ণ হয়। শেয়ারিং, কেয়ারিং অনেক কিছু হয়। দায়িত্বও বাড়ে। ওই দায়িত্বটা ক্রিকেটেও ভালো কজে দেয়।
প্রশ্ন: আপনি এমনিতেই সুশৃঙ্খল একজন মানুষ। বিয়ের পর নিশ্চয়ই খেলা এবং খেলার বাইরে দায়িত্বের পরিধিও বেড়ে যাবে?
মুমিনুল: অবশ্যই। কারণ পরিবার হওয়ার পর মানুষ অনেক দায়িত্বশীল হয়। সময়মতো সবকিছু করতে হয়। পেশার প্রতি দায়িত্ব বাড়ে। আমি বিশ্বাস করি, বিয়ে আমার ক্রিকেট জীবনকেও এগিয়ে দেবে। কারণ, খেলা নিয়ে ভালোমন্দ শেয়ার করার মতো একজন মানুষকে সার্বক্ষণিক কাছে পাব।
প্রশ্ন: ছয় বছর হলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে আছেন। ক্যারিয়ারটা কি ঠিক পথেই আছে?
মুমিনুল: টেস্টে ঠিক আছে। মোটামুটি ভালোই যাচ্ছে। তবে ওয়ানডে খেলতে পারলে ভালো হতো। নিজের কাছেও ভালো লাগত। সেক্ষেত্রে টেস্টে আরও বেশি ধারাবাহিক হওয়ার সুযোগ হলেও হতে পারত। সব মিলিয়ে বলব, আমার ক্যারিয়ার ঠিক পথেই আছে।
প্রশ্ন: টেস্টের গড় বলে, দীর্ঘ পরিসরে দেশের এক নম্বর ব্যাটসম্যান আপনি?
মুমিনুল: গড় দেখে সেটা হয়তো অনেকেই বলবে; কিন্তু জিনিসটা আমি ওভাবে দেখি না। তামিম ভাই, সাকিব ভাই, মুশফিক ভাইরা অনেক বড় ক্রিকেটার। গড়ে পিছিয়ে থাকলেও টেস্টে উনাদের অবদান অনেক বেশি। তবে সবার দোয়া থাকলে, চেষ্টা করব ক্যারিয়ারকে আরও ভালো একটা জায়গায় নিয়ে যেতে।
প্রশ্ন: দেশের পক্ষে সবচেয়ে কম ইনিংসে বেশি টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড আপনার, ৮টি সেঞ্চুরি আছে। টানা ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ডও আপনার। এগুলো কতটা প্রেরণা দেয়?
মুমনিুল: চেষ্টা করি ইনিংসগুলো বড় করতে। সব সময় বড় হয় না। এখন টেস্টে আমার গড় ৪১। চেষ্টা করব পঞ্চাশে নিয়ে যেতে। একটা দিক থেকে ভালো যে, ৫০ গড় নেই। এতে রানের ক্ষুধাটা থাকে। আর সেটা করতে হলে নিয়মিত ভালো খেলার চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। বড় ইনিংস খেলতে হবে। আর যে রেকর্ডগুলো আছে, তা অবশ্যই প্রেরণা দেয়।
প্রশ্ন: শুরুর দিকে আপনার টেস্ট গড় ছিল ৫৫। কমে গেল কেন?
মুমিনুল: টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম দিক দিয়ে ৫০ বা ৬০-৭০ গড় রাখা যায়। ওটা ধরে রাখা কঠিন। সে চেষ্টা আমি করিনি তা না। এখন যেখানে আছি, সেখান থেকে ৫০ গড়ে যেতে হবে। সেটা পারলে বাংলাদেশের টেস্ট জয়ে আমার অবদান বেশি থাকবে। আর দলের জন্য যত বেশি বড় ইনিংস খেলতে পারব, ততই ভালো লাগবে।
প্রশ্ন: আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার তো ওয়ানডে দিয়ে শুরু। তাহলে এখন কেন পিছিয়ে গেলেন?
মুমিনুল: গত কয়েক বছর আমার মনের ওপর দিয়ে অনেক চাপ গেছে। কোচ (হাথুরুসিংহে) হয়তো ওয়ানডেতে আমাকে চাননি। এর পরও কিছু ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে ওই সময়ে আমাকে নিয়ে যে কথাগুলো হয়েছে। সবাই বলত, আমি শুধুই টেস্ট খেলব। বারবার বলত। এই চাপটা আমি নিতে পারিনি। মাথার মধ্যে বিষয়টি গেঁথে গিয়েছিল। যেটা পরে চাপে পরিণত হয়। আমি স্বাভাবিক খেলা থেকে ছিটকে পড়ি। এখন আমার চ্যালেঞ্জ হলো, ওই বাধা থেকে বেরিয়ে ওয়ানডে দলে ঢোকা। এজন্য আমাকে সীমিত পরিসরের ক্রিকেটে ভালো খেলতে হবে। আশা করি সেটা পারব।
প্রশ্ন: ২০১৫ বিশ্বকাপে দলে ছিলেন। শ্রীলংকার বিপক্ষে ম্যাচও খেলেছেন। এবার তো বিশ্বকাপ দলের আলোচনাতেও নেই?
মুমিনুল: এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমি একটা জিনিস সব সময় বিশ্বাস করি, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। এটাও জানি, আমি যদি ঠিক পথে থাকি তাহলে আবার সুযোগ আসবে। আমার জীবনে আরও অনেক সুযোগ আসবে। এখন আমার যা বয়স, ফিট থাকলে আরও ১২ বছর ক্রিকেট খেলতে পারব। সুযোগ আসবেই। এবার বিশ্বকাপে যেতে পারছি না এটা নিয়ে পড়ে থাকলে আমার অন্য কাজগুলোও বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন: যে মেন্টাল ব্লকের কথা বললেন, সেটা কি কেটেছে?
মুমিনুল: না, এখনও কিছুটা আছে। মাথার ভেতরে গেঁথে আছে। আস্তে আস্তে ওখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছি। কারণ মেন্টাল জিনিসটা খুব কঠিন রোগ। সাধারণ রোগ ওষুধ খেলে ঠিক হয়; কিন্তু মাথায় কোনো কিছু গেঁথে গেলে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে। সবাই যখন বলেছে আমি শুধু টেস্টের খেলোয়াড়, তখন আমার চিন্তা চেতনা টেস্টকেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিল। ওয়ানডের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন চিন্তা করছি সব ধরনের ক্রিকেটে ভালো খেলার। আমার বিশ্বাস, আমি পারব।
প্রশ্ন: ঢাকা লিগ বা বিপিএলেও আপানার পারফরম্যান্স প্রত্যাশিত হচ্ছে না?
মুমিনুল: ওই যে বললাম, মনস্তাত্ত্বিক বাধা। আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ওয়ানডে দিয়ে। সেই আমি একটা সময়ে ওয়ানডে খেলাটাই ভুলে যেতে বসেছিলাম। কারণ মানসিক চাপ। ভুলটা আমারই, অন্যদের কথায় এত গুরুত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। উচিত ছিল নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলা।
প্রশ্ন: এক ফরম্যাটে খেলে ধারাবাহিক ভালো খেলা কতটা কঠিন। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দলে?
মুমিনুল: খুবই কঠিন। কারণ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকতে হয় কবে খেলা হবে। ওয়ানডে বা টেস্ট যে কোনো এক ফরম্যাটে যখন খেলবেন তখন ওই খেলোয়াড়কে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। টেস্ট তো বেশি থাকেও না। ওয়ানডে একটু বেশি থাকে। বছরে পাঁচটা টেস্ট হয়, আজকে একটা খেললেন, আবার পাঁচ মাস পর আরেকটা খেলতে হয়। তখন পারফর্ম করা কঠিন হয়। ভালো খেলতে না পারলে দল থেকে বাদ পড়তে হয়। অসীম মানসিক শক্তি না থাকলে ওই জায়গায় টিকে থাকা কঠিন।
প্রশ্ন: এ কারণেই কি নিউজিল্যান্ডে ভালো হয়নি?
মুমিনুল: আমি তা বলব না। অন্য অনেক কারণ থাকতে পারে। হয়তো আমার প্রস্তুতি পর্যাপ্ত ছিল না। হয়তো বোলারকে রিড করতে পারিনি। টেকনিক্যাল ঝামেলার কারণও থাকতে পারে।
প্রশ্ন: দল তো আপনার কাছে সব সময় বড় ইনিংস চায়?
মুমিনুল: এটা স্বাভাবিক। বেশি কিছু চায় না। আপনি যখন সবার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাবেন, যখন বোঝা যায় সবাই আপনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন সেই দায়িত্ব পালন করা সহজ হয়। আমার কাছ দল যখন বেশি কিছু চায়, তখন আমারও মনে হয় আমাকে ভালো করতে হবে।
প্রশ্ন: এক বছরের মধ্যে ওয়ানডে দলে দেখার সুযোগ আছে?
মুমিনুল: এই রকম টার্গেট আমি করি না। আবার বাংলাদেশ দলের কথা বলাও যায় না। একটা সিরিজ বা টুর্নামেন্টে ভালো খেললেই সুযোগ চলে আসতে পারে।