স্কুল ও কলেজ একসঙ্গে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবাসে যাওয়া-আসার পথে ক্লাস এইটের নিম্নিকে (ছদ্মনাম) নানা উপহারে কাছে টানে কলেজ পড়ুয়া সোনিয়া (ছদ্মনাম)। নিম্নির জন্মদিনে সারপ্রাইজ পার্টি, ঈদে দামি পোশাকে আপন করে নেয় সে। নিরাপত্তার খাতিরে সোনিয়ার সঙ্গে শপিংয়ে পাঠাতে দ্বিধা করেন না নিম্নির ব্যস্ত অভিভাবকরা। সেই সুযোগে সোনিয়া তার বয়সী অন্য কলেজের ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় নিম্নির। এরপর একসঙ্গে কৌতূহলবশত মাদক নেওয়া শুরু হয় তার। অভিভাবকরা তার পরিবর্তন দেখতে পান, কিন্তু বুঝতে পারেন না, আসলে কী ঘটছে।
এক পর্যায়ে সোনিয়া নিম্নিকে পরামর্শ দেয় ‘ফান’ হিসেবে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে নামি-দামি হোটেলের বলরুমে যাওয়ার। নিম্নি দেখে প্রায় সব আড্ডায় পরিচিত ছেলেমেয়েরা (তার থেকে বয়সে বড়) ‘স্বাধীনভাবে’ মিশছে। বাবা-মাকে লুকিয়ে সোনিয়ার বাসায় রাত কাটানোর নামে সেই আড্ডার ছেলেদের সঙ্গে রাত কাটায় আরেক বন্ধুর ফাঁকা বাসায়। আর তার দুমাস পর নিম্নির মা আবিষ্কার করেন মেয়ে মা হতে চলেছে।
নিম্নির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সেই গ্রুপে কলেজপড়ুয়া কিছু আপু তাদের ক্লাসের এবং একটু ওপরের ক্লাসের মেয়েদেরও এই রকম ছোট ছোট দলে টেনেছে। তাদের অনেকেই একাধিকবার ভ্রূণহত্যা ঘটিয়েছে সেই আপুদের সহায়তায়।
রাজধানীজুড়ে চলছে একধরনের মাদক ও যৌনতার ছোবল। প্রথমে কৌতূহল বশত এবং পরে সেই ফাঁদে পড়ে কিশোরী মেয়েরা একসময় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। পরিবারে বাবা-মা বিষয়টা জানার পর তাদের শাসন করতে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করছে।
১১ সেপ্টেম্বর রাত। ক্লাস নাইনে পড়া শেফালি (ছদ্মনাম) আত্মহত্যার চেষ্টা করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে। বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে গভীর রাতে এ হাসপাতাল সে হাসপাতালে ঘুরে ভর্তি করাতে না পেরে রাজধানীর অখ্যাত এক হাসপাতালে লাখ টাকার বিনিময়ে ভর্তির সুযোগ পান। শেষপর্যন্ত মেয়েকে বাঁচিয়ে বাসায় ফিরিয়ে নেন তারা। এ সব ঘটনায় হাসপাতালগুলো পুলিশকে না জানানোর শর্তে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় বলেও জানা গেছে।
শেফালির অভিভাবক জানান, তার মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়ার পর তারা জানতে পারেন মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা। বাসায় ফিরে মেয়ের ঘর, ল্যাপটপ তোলপাড় করলে জানতে পারেন এতদিন খেয়াল না করায় মেয়ের সম্পর্ক হয় একাধিক ছেলের সঙ্গে এবং তারা অভিজাত এলাকার হোটেলে ঘোরাঘুরি করত, নিয়মিত সিসা নিত। এ সবই মেয়ের ফেসবুকের চ্যাটবক্স থেকে বেরিয়ে আসে। বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এই অভিভাবক বলেন, অন্য কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমরাই সময় দিতে পারিনি। ভেবেছি, আমাদের সময়ের মতোই এখনও সবকিছু সহজ-সরলভাবেই চলে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলে তারা জেনেছেন, কলেজের আপুদের মাধ্যমেই তারা ‘লাইফ এনজয়’ করার এই পথ খুঁজে পেয়েছে। সঙ্গের ছেলেরা কম-বেশি সবাই কলেজ শেষ করেছে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর সবকিছুর শুরুতে আছে নেশা। যা শিশু-কিশোরদের ওপরই আঘাত হানছে বেশি। এক জরিপে দেখা যায়, দেশের মোট মাদকাসক্তের শতকরা ৪০ ভাগই শিশু-কিশোর। সমাজের উঁচু শ্রেণি থেকে শুরু করে নিম্ন শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সব শিশুই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। আর মাদকাসক্ত হওয়ার পর নেশার জায়গা ও দ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের মেয়েরা জড়িয়ে পড়ছে যৌনসম্পর্কেও।
মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের এক জরিপে দেখা যায়, ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়ে শিশুরা মাদকাসক্ত হচ্ছে বেশি। ঢাকা বিভাগে এ হার ১৭ শতাংশেরও ওপরে।
রাজধানীর বনানী, গুলশান, ধানমণ্ডির বেশ কয়েকটি খাবারের দোকানের আড়ালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সিসা গ্রহণ করে। ২০১৩ সালের ৩০ আগস্ট ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের একটি সিসা বারে অভিযান চালানো হয়। পরে ওই বার বন্ধ করে দেওয়া হয়। ছেলে শিশুদের পাশাপাশি বহু মেয়েশিশুও মাদকাসক্ত। এদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরিন বলেন, আমার মনে হয় এসব নিয়ে সিরিয়াসলি গবেষণা করার সময় এসেছে এবং কিভাবে আমাদের এই প্রজন্মকে কারিকুলামের মধ্য দিয়ে যৌনশিক্ষা দেওয়া যায় সেদিকটি নিয়েও উদ্যোগী হওয়া দরকার। একদিকে আমরা যৌন বিষয়ে আলাপ লুকিয়ে করা বা একেবারেই না করার চেষ্টা করি, আরেকদিকে আমাদের সন্তানেরা সেটা সঠিক বয়সের আগে চর্চা শুরু করে দিচ্ছে, কখনও কখনও ফাঁদে পড়ে জীবন ধ্বংস করছে। এটার দায় আমাদেরই নিতে হবে।
বর্তমান প্রজন্মের এ অস্থিরতার জন্য সামাজিক বাস্তবতাকেই দায়ী করলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আসিফ। তিনি বলেন, যার জন্য মুক্ত মাঠ নেই, যার সামনে সুস্থ কোনও পারিবারিক সম্পর্কের উদাহরণ নেই, তার জন্য যেকোনও ফাঁদে পড়া খুব সহজ। অভিভাবকরা সন্তানদের সময় না দিলে, তাদের জন্য যে বয়সে যা দরকার, সেটা সঠিক সময়ের আগে সামর্থ্য আছে বলেই দিয়ে দিলে, সন্তানের ভেতর একধরনের ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়। যা সন্তানটিকে এরোগেন্ট করে তুলতে পারে।