কোনওভাবেই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। এতে খানিকটা বিব্রত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) খুব বেশি কাজ দিচ্ছে না। প্রতি তিনমাস পর পর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠক হলেও কমানো যাচ্ছে না অনিয়ম ও দুর্বলতা।শুধু তাই নয়,সুশাসনের অভাবে দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে ব্যাংকগুলো।বিশেষ করে গত তিন মাসে মূলধন ঘাটতি,খেলাপি ঋণ ও লোকসানি শাখা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সোমবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী,জনতা,অগ্রণী ও রূপালী-এই চার ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে খেলাপী ঋণ নিয়ন্ত্রণ,ঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ, কমপ্লায়েন্স পরিপালন,মূলধন শক্ত অবস্থানে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তন করে উন্নয়নমূলক কৃষি, এসএমই ও ছোট উদ্যোক্তাদের বেশি ঋণ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
গেল বছরের সেপ্টেম্বরভিত্তিক আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজি হাসান।বৈঠকে চার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন,এই চার ব্যাংকের সঙ্গে এটি মূলত: সমঝোতা চুক্তি বা এমওইউ-এর নিয়মিত বৈঠক।এমওইউ-এর আলোকে সেপ্টেম্বরভিত্তিক পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে এই বৈঠক হয়েছে।
বৈঠক প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা নিয়ে এখনও ভাল বলার সুযোগ আসেনি।ব্যাংকগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলতা রয়েছে যা সমাধান করতে বলা হয়েছে। বিগত দিনে ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন ধরণের নির্দেশনার পরও মূলধন ঘাটতি,খেলাপি ঋণ ও লোকসানি শাখা বেড়েই চলেছে।তবে কিছু বিষয়ে দু’একটি ব্যাংক ভাল করেছে। ভাল বিষয়গুলো ধরে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে আসতে পারেনি তাদেরকে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী সব শর্ত পরিপালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বৈঠক প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন,কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের বৈঠক মূলত: এমওইউ-এর আলোকে সেপ্টেম্বরভিত্তিক পর্যালোচনা বা পারফরমেন্স নিয়ে আলোচনা।তিনি বলেন,এমওইউ-এর শর্ত পূরণে জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈঠকে আমাদের পারফরমেন্স নিয়ে কথা হয়েছে।চার ব্যাংককেই আরও ভাল করতে বলা হয়েছে।যে সব অর্জন আমরা করেছি,আরও বেশি অর্জন করতে হবে। মূলধন ঘাটতি,খেলাপি ঋণ ও লোকসানি শাখা কমিয়ে আনতে বলা হয়েছে।এছাড়া, যে সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি,সেসব ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যাতে আমরা ভাল করি সে জন্য বলা হয়েছে।নিয়মকানুন মেনে ঋণ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এদিকে এই ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম,দুর্বল ব্যবস্থাপনা,রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সুশাসনের অভাবের কারণে ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে চলে গেছে।সার্বিক আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে গেল বছরের ১৮ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত এই চার ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগের ঘটনা এই প্রথম।
প্রতি বছরের মতো গত বছরও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এসব ব্যাংকের পরিচালন ব্যয়, মূলধন পর্যাপ্ততা,ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা,ঋণ বিতরণ,খেলাপি ঋণ আদায়,লোকসানি শাখা কমানোসহ বেশকিছু বিষয় নিয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)সই হয়। এমওইউ-এর আলোকে গেল বছরের ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।এজন্য সেপ্টেম্বরভিত্তিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মূলধন ঘাটতি : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,সেপ্টেম্বরপ্রান্তিক শেষে সোনালী ব্যাংকের মুলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৫ কোটি টাকা।জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৬৩ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৭৪ কোটি টাকা। গেল জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা।একই সময়ে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৫৫৪ কোটি টাকা;আর জনতা ব্যাংকের ছিল ৩৪৫ কোটি টাকা।
লোকসানি শাখা: গত বছরের জুন শেষে লোকসানি শাখা ছিল ২৪৬টি। সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে ৩০৩টিতে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের লোকসানি শাখা বেড়ে হয়েছে ১৩০টি, জনতা ব্যাংকের ৭২টি, অগ্রণী ব্যাংকের ৭২টি এবং রূপালী ব্যাংকের ২৯টি হয়েছে।
খেলাপি ঋণ : সেপ্টেম্বর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭২০ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ২২ দশমিক ২ শতাংশ। জুন শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ।জুন শেষে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫২২ কোটি টাকা।সেপ্টেম্বর শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। একই সময়ে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
উল্লেখ্য, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।এমওইউতে খলাপি ঋণ আদায়,ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা,লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো,ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন,অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও সুপারভিশনের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।তিন মাস পরপর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন করা হয়।