উচ্চ আদালতে কক্সবাজারের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলার রায় কার্যকরে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকান্ড আশানুরূপ নয়। অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনীহা প্রকাশ করছে। এতে জেলার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উচ্চ আদালতে গত পাঁচ বছরে কক্সবাজারের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ৯ টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে একটি। আবার নিষ্পত্তিকৃত মামলায়ও আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছেনা।
সূত্র মতে, মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) গত পাঁচ বছরে ৯ টি কক্সবাজারের জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা দায়ের করেছে।
মামলার রায় পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় ঝিলংজা মৌজার আর.এস ৮০০১ নম্বর দাগের মোট ১২৪.৩৫ একর রক্ষিত বন ও ঘোষিত প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হতে ৫১ একর বনভূমিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য স্থানীয় জেলা প্রশাসন আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বরাদ্দ প্রদান করে। ওই বরাদ্দ বাতিল, পাহাড় ও বনজ সম্পদ ধ্বংসের বিরূদ্ধে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) পাহাড় কর্তনরোধে হাইকোর্টে ১১২১০/০৬ নং রিট মামলা দায়ের করে। ওই মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৮ জুন বরাদ্দ বাতিল, পাহাড় বা পাহাড়ের কোন অংশ কর্তন না করা, রক্ষিত বন এলাকায় সকল ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা এবং বন ধ্বংস না করতে আদেশ দিয়ে রায় প্রদান করেন। কিন্তু আদালতের রায় যথাযত বাস্তবায়ন না হওয়ায় ১২ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘বেলা’ আদালত অবমাননা মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে আদালত কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্রদান করলে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য সময় প্রার্থনা করলে আদালত সময় মঞ্জুর করেন এবং তিন মাসের মধ্যে সকল স্থাপনা উচ্ছেদ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলে অঙ্গিকার করেন কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন। তারপরও বর্তমানে ওই এলাকাতে পাহাড় ও গাছ কেটে স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। একই ভাবে কক্সবাজারের প্রধান নদী বাকঁখালী রক্ষায় ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রীট মামলা করা হয়। ওই মামলার প্রেক্ষিতে বাকঁখালী নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ, নদীতে বর্জ্য ফেলাবন্ধসহ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে রুল জারী করে হাইকোর্ট । হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হাঈদার হোসেন ও ভবানী প্রসাদ সিংহ এর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ রুল জারি করেন। আদালতের দেয়া নির্দেশনা মতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ হয়নি। বরং বর্তমানে বাকঁখালী নদীতে বর্জ্য প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ ট্রাক বর্জ্য ফেলছে কক্সবাজার পৌরসভা। একই সাথে নদীর তীরে প্রতিদিন গড়ে উঠছে নতুন নতুন অবৈধ স্থাপনা। এতে পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি কমে যাচ্ছে মৎস্য সম্পদ। ব্যাহত হচ্ছে নৌ-চলাচল।
অভিযোগ অস্বীকার করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন বলেন, ‘আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি আদালতের রায় বাস্তবায়নে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে সামান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উচ্চ আদালতের প্রতিটি রায় বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। সংবিধানের ম্যান্ডেট হলো আদালতের রায় বাস্তবায়ন। তা না হলে বিকল্প কোনো পথ থাকে না।
তিনি বলেন, জনস্বার্থে করা মামলার রায় বাস্তবায়ন বা কার্যকর না হলে আমরা আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করি। সে ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে রায় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। তিনি বলেন, জনস্বার্থে সব মামলার রায় বাস্তবায়ন হলে জনগণ উপকৃত হয়।
গত ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামের এক অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান বিচারপতি মো: তাফাজ্জাল ইসলাম বলেছেন, জনস্বার্থ মামলা নিয়ে পৃথিবীতে বিপ্লব এসেছে। জনস্বার্থ মামলার ব্যাপারে ভারতের আদালতের পাশাপাশি বাংলাদেশের আদালতও অনেক এগিয়েছে। তবে জনস্বার্থে সব মামলার রায় কার্যকর হওয়া উচিত বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। একই অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেছেন, আমরা যারা আইনজীবী, মানুষের কাছ থেকে অনেক ইনকাম করি। কিন্তু জনস্বার্থে কিছু করি না। এটি ঠিক নয়। জনস্বার্থে আমাদের কাজ করতে হবে। মানবতার সেবায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে।
এ দিকে হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ বছরে ৯ টি কক্সবাজারে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলার মধ্যে অবৈধ পাহাড়কাটা ও নির্মাণকাজ রোধ, অবৈধ জমি অধিগ্রহণ রোধ, কক্সবাজার সৈকত দখলদারদের উচ্ছেদ, বাকঁখালী নদী রক্ষা, উপকুলীয় এলাকায় প্যারাবন রক্ষা, ইসিএ এলাকায় বনভুমি দখল করে আবাসন প্রকল্প বন্ধ উল্লেখযোগ ।