1. arif.arman@gmail.com : Daily Coxsbazar : Daily Coxsbazar
  2. dailycoxsbazar@gmail.com : ডেইলি কক্সবাজার :
  3. litonsaikat@gmail.com : ডেইলি কক্সবাজার :
  4. shakil.cox@gmail.com : ডেইলি কক্সবাজার :
  5. info@dailycoxsbazar.com : ডেইলি কক্সবাজার : Daily ডেইলি কক্সবাজার
‘রুনাকে দাও, বিনিময়ে ফারাক্কার সব পানি নিয়ে যাও’ - Daily Cox's Bazar News
রবিবার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১১:০৪ অপরাহ্ন
নোটিশ ::
ডেইলি কক্সবাজারে আপনার স্বাগতম। প্রতি মূহুর্তের খবর পেতে আমাদের সাথে থাকুন।
সংবাদ শিরোনাম ::
কট্টরপন্থী ইসলামী দল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ: এসএডিএফ কক্সবাজারের আট তরুণ তরুণীকে ‘অদম্য তারূণ্য’ সম্মাননা জানাবে ঢাকাস্থ কক্সবাজার সমিতি Job opportunity বিশ্বের সবচেয়ে বড় আয়না, নাকি স্বপ্নের দেশ! আল-আকসা মসজিদে ইহুদিদের প্রার্থনা বন্ধের আহ্বান আরব লীগের পেকুয়ায় পুলিশের অভিযানে ৮০ হাজার টাকার জাল নোটসহ গ্রেফতার-১ পেকুয়ায় অস্ত্র নিয়ে ফেসবুকে ভাইরাল : অস্ত্রসহ আটক শীর্ষ সন্ত্রাসী লিটন টেকনাফে একটি পোপা মাছের দাম হাঁকাচ্ছেন সাড়ে ৭ লাখ টাকা ! কক্সবাজারের টেকনাফে র‍্যাবের অভিযানে ইয়াবাসহ আটক-১ নিউ ইয়র্কে মেয়র কার্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ নিয়ে কনসাল জেনারেলের আলোচনা

‘রুনাকে দাও, বিনিময়ে ফারাক্কার সব পানি নিয়ে যাও’

ডেইলি কক্সবাজার ডেস্ক ::
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৮ জুলাই, ২০১৬
  • ৪১৯ বার পড়া হয়েছে

উপমহাদেশের হৃদয় জয় করে নেওয়া এ দেশের প্রথম শিল্পী রুনা লায়লা। সিলেটে জন্ম, করাচিতে বেড়ে ওঠা, ১৯৭৪ সালে আবার বাংলাদেশে ফেরা। ১২ বছর বয়সে প্রথম ছায়াছবিতে গান। এর পর শুধু অগ্রযাত্রা। গত বছর সংগীতজীবনের ৫০ বছর পূর্ণ করলেন। এ সাক্ষাৎকারে নিজেকে মেলে ধরেছেন আদ্যোপান্ত।

মতিউর রহমান: উপমহাদেশের একজন কিংবদন্তিকে দিয়েই আমাদের আলাপ শুরু করি? লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হয়েছিল কত সালে?
রুনা লায়লা : ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে আমি ঢাকায় আসি। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে আইসিসিআর (ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার ফর রিলেশনস) আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আমন্ত্রণে ভারতে যাই। সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। প্রথম অনুষ্ঠান ছিল দিল্লিতে, দ্বিতীয়টি মুম্বাইয়ে, আর শেষটা কলকাতায়। ওই সময় আয়োজকেরা আমার কাছে জানতে চান, এমন কেউ কি আছেন এখানে, যাঁর সঙ্গে আপনি দেখা করতে চান? অথবা বিশেষ আগ্রহ আছে কারও প্রতি? যদি থাকে, তবে সেটা আমাদের বললে ব্যবস্থা করতে পারব। আমি তাদের বললাম, আমার একটা প্রত্যাশা আছে—যদি কোনোভাবে লতাজির সঙ্গে দেখা করা যায়…। ওরা তখন জানালেন, ‘তিনি তো কোথাও যান না। তা ছাড়া তিনি তো খুব চুজি। তবুও আমরা চেষ্টা করব।’ তাদের কথা শুনে আমি ধরে নিয়েছিলাম, হয়তো দেখা হবে না।
যা-ই হোক, নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠানের আগে মুম্বাইয়ের শানমুখানন্দ্ হলের ব্যাক স্টেজে রিহার্সাল করছিলাম। আমার সঙ্গে এখান থেকে গিয়েছিলেন নামকরা সংগীত পরিচালক দেবুদা—দেবু ভট্টাচার্য। তিনি কি-বোর্ড বাজাচ্ছিলেন আর পুরো সংগীত ব্যবস্থাপনাটা দেখছিলেন। তিনি ছাড়াও ছিলেন সেখানকার স্থানীয় সংগীতজ্ঞরা। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, হঠাৎ করে দেখি, ব্যাক স্টেজের দরজা দিয়ে কয়েকজন মহিলা ঢুকলেন। এর মধ্যে একজন সাদা শাড়ি পরা। তিনি আমার দিকে আসছেন। তাঁকে দেখে লতাজি লতাজি মনে হচ্ছিল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? তিনি কেন ব্যাক স্টেজ দিয়ে ঢুকবেন? এরপর সংবিৎ ফিরে পাই। দেখি লাল গোলাপ হাতে সত্যি সত্যি লতাজিই আমার দিকে আসছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি গিয়ে তাকে সালাম করলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ফুল দিলেন। এর মধ্যে মিডিয়ার লোকজন তো খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা এসে ছবি তুললেন। পরের দিন পত্রিকাগুলোয় শিরোনাম হয়েছিল, ‘ওয়ান নাইটিঙ্গেল মিটস অ্যানাদার’। আমরা সেদিন বসে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। সেদিনের অনুষ্ঠানে লতা মঙ্গেশকর, সলিল চৌধুরী, কল্যাণজি [কল্যাণজি বীরজি শাহ—কল্যাণজি-আনন্দজি সুরস্রষ্টা ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন] ছিলেন। চিত্রপরিচালকদের মধ্যে ছিলেন ঋষিকেশ মুখার্জি। তাঁরা সবাই মঞ্চে উঠে আমার সম্পর্কে বললেন। পাকিস্তান রেডিওতে তাঁরা সবাই আমার গান শুনতেন। তাই তাঁদের কাছে পরিচিত ছিলাম।
আমি লতাজিকে বললাম, আপনি আমার গান তো কখনো শোনেননি বোধ হয়। তিনি বললেন, ‘আমি তো আপনার গান অনেক শুনেছি। পাকিস্তান রেডিওতে আপনার গান বাজানো হয়, আমরা নিয়মিত আপনার গান শুনি। আপনি এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চান শুনে আমি নিজেই চলে এসেছি।’ এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা সম্মানের ব্যাপার ছিল। লতাজির সঙ্গে ওটাই প্রথম দেখা।
মতিউর : তখন তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী, ভারতের অত্যন্ত বড় শিল্পী। এই যে আপনি দেখা করতে চেয়েছেন বলে আপনার কাছে ছুটে এলেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
runa-1রুনা : তিনি অবশ্যই অনেক বড় শিল্পী। তবে আমার মনে হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বড় মানুষ তিনি। আমাদের শেখা উচিত, একজন শিল্পী আরেকজন শিল্পীকে কীভাবে সম্মান দেন। সম্মান দেন বলে সম্মান পানও। আমিও যেমন এখনো মুম্বাই গেলে বা ভারতের অন্য কোথাও গেলে কিংবা দেশে থাকা অবস্থায়ও তাঁর খোঁজখবর রাখি। তিনিও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
মতিউর : এবারও [মার্চ ২০১৬] তো গেলেন। সর্বশেষ লতা মঙ্গেশকরকে কেমন দেখলেন?
রুনা : যাওয়ার আগেই তাঁর ভাতিজা বৈজনাথ মঙ্গেশকরের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রায়ই যোগাযোগ হয়। তিনিই লতাজির সঙ্গে সব সময় আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন। তাঁকে বললাম, আমি তো আসছি। ১৫, ১৬, ১৭ [মার্চ ২০১৬]—তিন দিন থাকব। এর মধ্যে ১৫ তারিখ আমি ফাঁকা আছি। দিদির সঙ্গে কি একটু দেখা করা যাবে? বৈজনাথ বললেন, তিনি কয়েক দিন খুব অসুস্থ ছিলেন। তবু কথা বলে দেখি। পরের দিন আমাকে মেসেজ পাঠালেন, লতাজি দেখা করবেন।
আসলে নিউমোনিয়া হয়েছিল তাঁর। বেশ খারাপ অবস্থায় ছিলেন। ডাক্তার নিষেধ করেছিলেন, বাইরের কারও সঙ্গে দেখা না করতে বা বাইরে কোথাও না যেতে। কিন্তু যখন শুনেছেন আমি দেখা করতে চাই। বলেছেন, ও আসুক। ও এলে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা অনেকক্ষণ বসে গানসহ অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করলাম। এত বছর ধরে চিনি তাঁকে, তবুও এখনো তাঁর সামনে গেলে মনে হয় আমার জিবটা আড়ষ্ট হয়ে যায়। এটা হয় তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধের কারণে। তবু তিনি খুবই খোলামেলা ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে—স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসলেন, রসিকতা করলেন। পরে খুবই সুন্দর একটি শাড়ি উপহার দিলেন। আর আলমগীরের জন্য খুবই সুন্দর—কাঠের ফ্রেমের ভেতর বসানো একটি ছোট কোরআন শরিফ উপহার দিলেন। যতবারই গিয়েছি, ততবারই একটা-না-একটা উপহার দিয়েছেন। আর কখনো দেখা না করতে পারলে কোনো না কোনো উপহার পাঠিয়ে দিয়েছেন।
মতিউর : তিনি কি এখনো গান করেন? তাঁর ওই বাড়িটাতে আমি গিয়েছিলাম। তার উল্টো দিকেই তো আশা ভোঁসলের ফ্ল্যাট?
রুনা : না, এখন গান করেন না। তবে তাঁরা দুজন এখনো একই বাড়িতে থাকেন। পেডার রোডের সেই বাড়ির নাম প্রভুকুঞ্জ।
মতিউর : গানের রাজ্যে আপনার দেখা বা জানাশোনা লতা মঙ্গেশকরের চেয়ে বড় কোনো শিল্পীকে তো আপনি দেখেননি বা ভাবেন না, নাকি?
রুনা : লতা মঙ্গেশকরের চেয়ে বড় শিল্পী আর কে হতে পারে… (হাসি)?
মতিউর : আপনার কথায়, তিনি মানুষ হিসেবেও তো অসাধারণ…।
রুনা : অন্তত আমার সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক, যে আচরণ তিনি করেন, তাতে আমি মুগ্ধ। তাঁর কাছ থেকে আমি যতটা আদর-স্নেহ পেয়েছি, এমনকি যে সম্মানটা আমাকে তিনি দেন, আমাকে রুনাজি ছাড়া ডাকেনই না। নিঃসন্দেহে অনেক বড় মনের মানুষ বলেই তিনি এটা করেন। এটা বিরাট ব্যাপার। কারণ আমি তো বয়সে তাঁর অনেক ছোট।
মতিউর : আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি, লতা মঙ্গেশকর জীবনে অনেক কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমনকি তিনি তাঁর ভাইবোনদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর এক ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। এখনো কি তিনি বেঁচে আছেন? তাঁর সুর করা কোনো গান কি আপনি গেয়েছেন? তিনি তো কিছু বাংলা গানেরও সুর দিয়েছিলেন।
রুনা : হ্যাঁ, তাঁর বাবা মারা যান ছোটবেলায়। তাঁর ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর বেঁচে আছেন। তবে তাঁর সুরে কোনো গান আমি করিনি। তবে তিনি অত্যন্ত বড় মাপের একজন সংগীতস্রষ্টা। আর তাঁদের পরিবারের প্রত্যেকেই বহুমুখী প্রতিভাধর। উষা মঙ্গেশকর—গান তো গান, অসাধারণ ছবিও আঁকেন। লতাজি নিজেও ছবি আঁকেন।
মতিউর : লতা মঙ্গেশকররা তো চার বোন। লতা, আশা, উষা তো গান করেন। আরেক বোন ছিলেন। তিনি কি গান করেন?
রুনা : আরেকজন মিনা মঙ্গেশকর। তিনিও গান করতেন। এখন আর করেন না।
মতিউর : আশা ভোঁসলে ও লতা মঙ্গেশকর দুজনের সম্পর্ক ভালো কি মন্দ—এসব নিয়ে অনেক মুখরোচক কথা শোনা যেত। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন? আশা ভোঁসলে এখন কেমন আছেন? গায়িকা হিসেবে তাঁকে কেমন দেখেন?
রুনা: একসময় দুজনের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কথা শোনা গেছে। তবে এখন তো কোনো সমস্যা নেই, ঠিকই আছে। একই বাড়িতে থাকেন। আশাজির সঙ্গে অনেকবার দেখা হয়েছে। একই মঞ্চে গান করেছি। এত দিন খুব বেশি কথা বলা বা মেশার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তিন বছর আগে ‘সুরক্ষেত্র’ নামে ভারতে একটি রিয়্যালিটি শোতে বিচারক হিসেবে গিয়েছিলাম। সেখানে আশাজি ছিলেন, আমি ছিলাম আর পাকিস্তান থেকে আবিদা পারভীন ছিলেন। পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিযোগী ছিল। আমি ছিলাম নিরপেক্ষ বিচারক। সেই অনুষ্ঠানের সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তাঁর সঙ্গে অনেক কথা, জানাশোনা, গল্প, আড্ডা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে শুটিং হতো। শুটিংয়ের ফাঁকে প্রত্যেকে রুমে বিশ্রাম নিতাম। কিন্তু তিনি আমার রুমে নক করে বলতেন, ‘কেয়া কার রাহি হ্যায়।’ উত্তরে বলতাম, ‘কিছু না, বিশ্রাম নিচ্ছি।’ তিনি বলতেন, ‘ম্যায় আউঁ?’ আমি বলতাম, ‘আরে, আপনার কি অনুমতির প্রয়োজন আছে?’ মানে, তিনি আড্ডা দিতে চাইতেন। অনেকক্ষণ আড্ডা দিতেন। গল্প, কৌতুক, হাসি-আনন্দ করতাম আমরা।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, সেটে আমি ও আশাজি পাশাপাশি বসতাম। সেখানেও আমরা খুব আড্ডাবাজি করতাম। এসব দেখে ওই অনুষ্ঠানের প্রযোজক গজেন্দ্র সিং একদিন বললেন, আপনাদের আলাদা বসাতে হবে। এপিসোড শুটিং হয়ে যাওয়ার পর দেখি, আমাদের দুই পাশে দিয়ে আবিদা পারভীনকে মাঝে বসানো হয়েছে। আশাজি বললেন, এটা কী হলো? রুনাজি ওখানে কেন? গজেন্দ্র সিং বললেন, আপনারা অনেক কথা বলেন তো। আশাজি বললেন, রুনাজিকে আমার পাশে বসাতে হবে, তা না হলে শুটিংই করব না। এভাবে আশাজির সঙ্গে একটি অন্য রকম আনন্দঘন সময় কেটেছিল। এমনকি তিনি বাসা থেকে আমার জন্য খাবার রান্না করে আনতেন।
মতিউর : এবার তো ঢাকায় গুলজারের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর সঙ্গে আপনার অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
রুনা : তাঁর গান করেছি আমি, ‘দো দিওয়ানে শেহের মেঁ’। সুর করেছিলেন খুব নামকরা সুরকার জয়দেব। গানটি লেখা গুলজারজির। ছবির নাম ছিল ঘারওয়ান্দা । ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৭ সালে। ওই গানটি ফিল্মফেয়ার-এর মনোনয়ন পেয়েছিল।
মতিউর : তিনি তো গান লেখেন, সিনেমা পরিচালনা করেন, সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন…। আপনি তাঁকে কেমন দেখেন? আমার খুব পছন্দের মানুষ তিনি।
রুনা : একজন বহুমুখী প্রতিভার মানুষ তিনি। প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে তাঁর গান করেছি। এবার আমার বাড়িতে এসেছিলেন। যাঁরা তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন, ভারতে তাঁরা আমার সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন। তাঁরা জানালেন, গুলজার সাহেবকে এবার আমরা নিয়ে আসছি। বললাম, তাই নাকি? তাহলে আমার বাড়িতে তাঁকে এক বেলা খেতেই হবে। তাঁরা বললেন, তাহলে আমরা তাঁকে বলি সে কথা। ভাবলাম, আবার মাইন্ড করবেন কি না, আমি সরাসরি বললাম না। তিনি কিন্তু এত কিছু ভাবেননি। ঠিকই চলে এসেছেন আমার বাড়িতে। এসে যেভাবে সম্মান দেখালেন আমার প্রতি, এটা বলে বোঝানো যাবে না। তাঁর প্রতি আমার যে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা, তিনি তার থেকেও অনেক বেশি সম্মান আমাকে দিলেন।
মতিউর : গুলজার পরিচালিত বহুদিন আগে দেখা সুচিত্রা সেন আর সঞ্জীব কুমার অভিনীত ‘আঁধি’ সিনেমায় লতা মঙ্গেশকর আর কিশোর কুমারের গাওয়া গানগুলো ইদানীং আবার শুনছি।
রুনা: এগুলো ছাড়াও মৌসাম ছবির সব গান গুলজারজির লেখা। আর ‘আঁধি’, ‘মাচিস’সহ বেশ কয়েকটা ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি।
মতিউর : আপনার সংগীতজীবনের শুরুর আগে কি নাচের প্রতি ঝোঁক বেশি ছিল? আপনার বোনের নামে করা শিশু ওয়ার্ডটা কি এখনো আছে?
রুনা : হ্যাঁ, নাচের দিকে বেশি আগ্রহ ছিল। আর বোনের নামে শিশু হাসপাতালের ওয়ার্ডটা এখনো আছে।
মতিউর : আপনার জন্মস্থান সিলেট। আপনার বাবা কি সিলেটের মানুষ ছিলেন?
রুনা : না, আব্বা সিলেটের ছিলেন না। তিনি ছিলেন সিভিল সার্ভেন্ট। তাঁর পোস্টিং ছিল সিলেটে। আমার জন্মের পরপরই তিনি বদলি হয়ে যান পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতানে। সেখানে সবাই চলে যাই। সেখান থেকে করাচি। আসলে করাচিতেই ছিলাম আমরা।
মতিউর : আপনার সংগীতজীবনের শুরুর দিকের ওস্তাদ, শিক্ষক বা গুরু কে ছিলেন?
রুনা : আসলে আমার বড় বোন দীনা লায়লা ক্ল্যাসিক্যাল শিখতেন ওস্তাদ আবদুল কাদের আর ওস্তাদ হাবীব উদ্দিনের কাছে। আমি তো চার বছর নাচ শিখলাম। কিন্তু বাড়িতে মা আর বড় বোন দীনা লায়লা গান করতেন। শুধু বাবা গাইতেন না। তবে খুব ভালো বুঝতেন। আর খুব তারিফ করতেন। আস্তে আস্তে গানের দিকেই চলে গেলাম। গানের চর্চা করতে থাকলাম।
মতিউর : আপনার গুরু বা ওস্তাদ কারা? আপনার বোনের যাঁরা গুরু, আপনিও কি তাঁদের কাছেই শিখেছেন?
রুনা : হ্যাঁ, তাঁদের কাছেই আমি গান শিখেছি। পরে গজলের প্রশিক্ষণ নিয়েছি মেহেদি হাসানের বড় ভাই পণ্ডিত গোলাম কাদিরের কাছে।
মতিউর : মেহেদি হাসানের বড় ভাইকে কোথায় পেলেন—লাহোরে নাকি করাচিতে? মেহেদি হাসানও কি করাচিতে থাকতেন?
রুনা : তাঁরা দুজনই করাচিতে থাকতেন। রেকর্ডিংয়ের সময় আমরা চলে যেতাম লাহোরে। ছবির গান করে আবার করাচিতে ফিরতাম। কারণ, আমার স্কুল-কলেজ সব ছিল করাচিতে।
মতিউর : তাহলে সেই অর্থে সিলেটের কোনো কিছু আপনার মনে নেই?
রুনা : না, আমার মনে থাকার কথা নয়।
মতিউর : আপনার বাবা-মায়ের বাড়ি তাহলে…?
রুনা : আমার বাবার বাড়ি রাজশাহীতে। মায়ের আসল বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু তাঁরা স্থায়ী ছিলেন কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে আমার মা-বাবার বিয়ে হয়।
মতিউর : আপনার মায়ের পরিবারে কি গানের চর্চা ছিল? আপনি আসলে কার দ্বারা প্রভাবিত হলেন? মায়ের দ্বারা গানের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, না অন্য কোনোভাবে?
রুনা : মায়ের প্রভাব তো থাকেই। আসলে বোনের পাশে বসতাম। আস্তে আস্তে শিখতাম। একদিন ওস্তাদ বললেন, ওর তো গানের গলা ভালো। দ্রুত গান ধরতে পারে, বুঝতে পারে, তুলে ফেলতে পারে। ভালো গাইতেও পারে। ওকে গানের দিকেই দেন। এ জন্য গানের প্রতি আরও ভালোবাসা, মনোযোগ তৈরি হয়। গান শিখতে শিখতেই ওই সময় করাচির সব স্কুলের মধ্যে আন্তস্কুল সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। আমার নয় বছর বয়স তখন। আমি পড়তাম সেন্ট লরেন্স কনভেন্ট স্কুলে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল এটা।
এরপর আমার বয়স যখন ১২ বছর, ওই সময় একজন প্রযোজক, একজন পরিচালক ও একজন সংগীত পরিচালক এলেন লাহোর থেকে। তাঁরা একটা ছবি বানাবেন, ১২ বছরের ছেলে কণ্ঠ মেলাবে পর্দায়। বাচ্চাদের ভালো কণ্ঠ তাঁরা পাননি। মূলত তাঁরা খুঁজতে খুঁজতে করাচি রেডিওতে গেছেন। ওই আন্তস্কুল প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিল রেডিও করাচি। রেডিও থেকেই বলা হয়েছে, তিন বছর আগে একটি মেয়ে আন্তস্কুল প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। তার বাবার টেলিফোন নম্বর আছে। যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। তাঁরা বাবাকে ফোন করে কথা বললেন। বাবা রাজি হলেন না। তখন বাবা ভাবতেন, ছবিতে গান গাওয়াটা বোধ হয় ভালো না। তিনি ‘না’-ই করে দিলেন। কিন্তু তাঁরা বললেন, একটু দেখা করতে চাই। বাবা বললেন, বাসায় আসতে পারেন, কিন্তু এটা হবে না। তবে আমার একটু শখ ছিলই—সিনেমায় গান করব, রেডিওতে আমার নাম বলবে। ভাবছিলাম, একটা গান যদি গাই, তাহলে আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়। বাবা বলছেন, হবে না। কিন্তু তাঁরা বলছেন, আমরা একটু শুনি—দুই লাইন।
শুনেই তাঁরা পছন্দ করলেন। বললেন, ওর ভয়েস কোয়ালিটি তো খুব ভালো। আমরা অন্তত একটা গান করি। তারপর আর না গাইল আর। এভাবে কেমন করে যেন বাবাকে রাজি করালেন। সিনেমাটার নাম ‘জুগনু’ । পাকিস্তানি জুগনু । ‘জুগনু’ মানে জোনাকি। সম্ভবত ছবিটার একটা চরিত্রের নামই ছিল জুগনু। বাবা বললেন, ওরও যেহেতু শখ আছে। তাহলে একটা গান করুক।
ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন মঞ্জুর হোসেন। তিনি খুব কম ছবিতে কাজ করেছেন। কিন্তু অসম্ভব গুণী মানুষ ছিলেন। ভালো কাজ করতেন। তিনি আমার সম্পর্কে বলেছিলেন, ওর ভয়েস কোয়ালিটি খুব ভালো, কিন্তু ফিল্মে গাওয়ার টেকনিক তো একদম আলাদা। ওই টেকনিকগুলো আমি ওকে ধরে ধরে শেখাব। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে এক ঘণ্টা রিহার্সাল করাতেন। আবার বিকেল বেলাতেও আসতেন। ওই একটা গানের জন্যই দুই মাস সকাল-বিকেল প্রশিক্ষণ করালেন। এভাবে রিহার্সাল করতে করতে কখন যে সবকিছু ঠিক হয়ে গেল, বুঝতেও পারলাম না। এরপর একদিন রেকর্ডিংয়ে গেলাম এবং কোনো সমস্যা ছাড়াই গাইলাম।
মতিউর : তাহলে ওই প্রথম সিনেমার জন্য গান করলেন?
রুনা : এই গানের পর তো বড় বড় প্রস্তাব আসতে থাকল। বাবা তো আর না করতে পারলেন না। আর কীভাবে না করবেন? পরে ওই একই সিনেমার নায়িকার কণ্ঠে একটি দুঃখের গান গাওয়ার বিষয় ঠিক হলো। ওঁরা বললেন, গান গাওয়ার সময় কান্নার ভাব করতে হবে। ১২ বছর বয়সে আমি তো এত বুঝতে পারি না। গান গাওয়ার সময় এমন কান্না শুরু করলাম, কাঁদতে কাঁদতে আর গানই রেকর্ডিং হয় না। সবাই খুব স্নেহ করছেন। কেউ কেউ চকলেট, কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে আসছেন। কেউ মাথায় হাত দিচ্ছেন ইত্যাদি। এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম কেন, জানি না।
মতিউর : গানের একটা-দুইটা লাইন কি মনে আছে?
রুনা : গানের কথা ছিল এ রকম, ‘মারনাভি নেহি আহসান, জিনাভি কায়ামত হ্যায়’। আসলে গানের কথাগুলো শুনে আমার কান্না শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরে খুব সফলভাবে রেকর্ডিং হলো। একটু কান্না-কান্না ভাবও থাকল গানের মধ্যে।
মতিউর : তাহলে করাচিতে স্কুল শেষ করলেন?
রুনা: এরপর কলেজে ভর্তি হলাম। ১৯৭৪ সালে আমরা এখানে চলে এলাম। বাংলাদেশে এসে বহিরাগত শিক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলাম।
মতিউর : আমার খুব প্রিয় একটা বিষয় নিয়ে একটু বলি। আপনি গান শেখা শুরু করলেন, সহজেই গান ধরতে পারতেন, সুরটা রপ্ত করতে পারতেন। আবার আমরা শুনেছি, অনেক গায়ক খুব বড় শিল্পী হয়েছেন—কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়—তাঁরা সেই অর্থে ছোটবেলা থেকে গান শিখে শিখে বড় হননি। গান শিখে যাঁরা বড় হন, তাঁদের থেকে এই ধরনের প্রতিভার পার্থক্যটা কেমন হয়? আসলে কীভাবে তাঁরা এমন গান করতে পারেন?
রুনা: প্রতিভাটা ঈশ্বরপ্রদত্ত হতেই হবে। আপনি যতই শেখেন, একজন শিল্পীকে প্রতিভাবান হতেই হবে। আপনি কৌশল রপ্ত করতে পারেন, কিন্তু আবেগটা, অনুভূতিটা বা সুরের স্টাইলটা একদমই সহজাত প্রতিভা। প্রতিভা নিয়েই মানুষের জন্ম হয়; জোর করে সেগুলো হবে না। সেই সহজাত প্রতিভার জোরেই তাঁরা এত বড় শিল্পী হতে পেরেছিলেন। আমিও শুনেছি, কিশোরদা নাকি বলতেন, তিনি কখনো গান শেখেননি।
মতিউর : বাংলা ও আধুনিক, হিন্দি বা রবীন্দ্রসংগীত—সব ধরনের গান তিনি করতেন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় পুরুষ কণ্ঠের যত রবীন্দ্রসংগীত, সব একমাত্র কিশোর কুমারের।
রুনা : সব, সব ধরনের গান করতেন তিনি। একেবারে ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা ছিল তাঁর।
মতিউর : অর্থাৎ চর্চা আর শেখার পাশাপাশি ভেতরে সহজাত প্রতিভা থাকতেই হবে, তা-ই তো?
রুনা : আসলে তেমন কিছু না থাকলে অত বড় হওয়া সম্ভব না। তবে প্রশিক্ষণ-চর্চাও অবশ্যই দরকার এবং এটা সারা জীবন ধরে দরকার।
মতিউর : আপনি কি এখনো আগের মতো নিয়মিত সকালে-বিকেলে চর্চা করেন? নতুন একটা গান বা কোনো একটা অনুষ্ঠানের আগে মানসিক কী ধরনের প্রস্ত্ততি নিতে হয়?
রুনা : হ্যাঁ, এখনো চর্চা করি। তবে একেবারে নিয়ম মেনে চর্চা করা হয় না এখন। একটা বিষয় বুঝতে হবে, যত দিন যায়, নতুন নতুন গান আসে আর মানুষের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। ফলে আমাদের ওপর সব সময় একধরনের চাপ থাকে। আর সেই কারণে প্রতিনিয়ত নিজেকে আরও নতুন করে তৈরি হতে হয়। একই কারণে নিজের মধ্যে একধরনের তাড়না থাকে, আরও ভালো করতে হবে, আরও ভালো করতে হবে। মঞ্চ ছাড়া অন্য কোথাও গান করলে বা এখনো কোনো রেকর্ডিং করার সময় মনে হয়, অমুক জায়গা আরেকটু ভালো হলে বোধ হয় ভালো হয়, ওই লাইন আরেকটু চেষ্টা করলে সম্ভবত আরও ভালো হবে ইত্যাদি। সেই কারণে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত ছাড়ি না। দিন দিন মানুষের চাহিদা বেড়ে যায়; তখন ভাবতে হয়, এর থেকে খারাপ আর করা যাবে না, বরং ভালো করতে হবে। সংগত কারণে চাপও বেড়ে যায়।
মতিউর : রেকর্ডিংয়ের সময় রি-টেক করার সুযোগ পান, বারবার করার জন্য। কিন্তু যখন মঞ্চে গান করেন, তখন তো সুযোগ পান না। সেটা তাহলে কীভাবে হয়?
রুনা : এ ব্যাপারে বলি, অনেকে বলেন, আপনার এখনো টেনশন হবে কেন? আমি বলি, এখন আরও নার্ভাস লাগে। আগে অত লাগত না। কারণ, আগে অত বুঝতাম না। দর্শক-শ্রোতা বেড়ে যাওয়ার কারণে চাপটা বেড়ে গেছে। মানুষ এখন আমাকে কীভাবে নেবে, না জানি কী ধরনের দর্শক-শ্রোতা থাকেন, আমার গান তাঁদের পছন্দ হবে কি না—এসব ভাবতে হয়। এটা তো পাল্টে ফেলার উপায় নেই। যা হবে, একবারেই হবে। এ জন্য টেনশনটা বেশি লাগে।
মতিউর : ইদানীং একটা বিষয় নিয়ে আমরা তর্কবিতর্ক করি; রেকর্ডিংয়ের সময় আপনারা সংশোধনের সুযোগ পান, মঞ্চে সেটা ম্যানেজ করে ফেলেন অভিজ্ঞতা দিয়ে। কিন্তু যাঁরা ক্রিকেট খেলতে যান, এক সেকেন্ডের ভুলে কিন্তু সব শেষ। গালি খেতে খেতে জীবন শেষ।
রুনা : এটা শুধু তাঁদের ক্ষেত্রে নয়, আমার ক্ষেত্রেও কিন্তু হতে পারে। আমি এখন যদি স্টেজে ভুলভাল একটা গান গেয়ে আসি, লোকে বলবে, রুনা লায়লা আর আগের মতো নেই, শেষ।
মতিউর : আপনারা নিরন্তরভাবে প্রশিক্ষণ, চর্চা, সাধনা ইত্যাদি করেছেন ভালো থেকে আরও ভালো করার আগ্রহ থেকে। এখন অনেকে বলে থাকেন ‘স্টেজে মেরে দেব’ কিংবা মঞ্চে উঠলেই হয়ে যাবে। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু ইদানীং শুনি কণ্ঠস্বরও নাকি প্রযুক্তির মাধ্যমে ঠিকঠাক করে ফেলা যায়। এটা ভালো হলো, নাকি খারাপ হলো? এ বিষয়ে কী বলবেন? আপনাদের যে চেষ্টা ও একাগ্রতা ছিল, এখন কি তার চেয়ে কম করেই লোকজন বড় শিল্পী হতে পারে?
রুনা : আমাদের সময়ে এমনও হয়েছে যে, রেকর্ডিং সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হয়ে ভোর ছয়টায় শেষ হয়েছে। একটা গানের রেকর্ডিংয়ে আগে দীর্ঘ সময় লাগত। লাহোরে এমনও হয়েছে যে, বড় বড় প্রোডাকশনে ১০০ থেকে ২০০ জন মিউজিশিয়ান দিয়ে গান রেকর্ড করা হতো। সবাইকে নিয়ে সবকিছু ঠিক রেখে একটা ‘পারফেক্ট টেক’ নেওয়া ছিল কঠিন। এ সময়ে সবাইকে সমান তৎপর থাকতে হতো, যেন কারও কোনো ভুল না হয়। প্রথম দিকে মুম্বাইতে যখন লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি বা জয়দেবজির গান করেছি, সব লাইভ রেকর্ড হয়েছে—পুরো অর্কেস্ট্রার সঙ্গে। এভাবে সবাই মিলে গাওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। এখন গান কী, সুর কী, আমরা কিছুই জানি না। আগে তো দুই থেকে তিন দিন রিহার্সাল হতো সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে। পুরো অর্কেস্ট্রার সঙ্গে রিহার্সাল হতো। তারপর গান রেকর্ডিং হতো। তখন বোঝা যেত গানের কোথায় একটু ছাড়তে হবে, কোথায় যোগ করতে হবে, কোথায় কেমন অভিব্যক্তি হবে। অন্তত তিন-চার দিন ধরে আমরা এটা নিয়ে গবেষণা করতাম। তাতে আমরা ভীষণভাবে গানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতাম।
এখন গানের কথা ও সুর অনেক ক্ষেত্রে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা স্টুডিওতে যাই। একজনকে বলা হয় গান লেখো। ওইটার সুর করা হয়। আবার বলা হয়, আমরা লাইন লাইন করে নিয়ে নেব। শিল্পী এক লাইন করে গায়। এভাবে গান করা খুব সহজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে গানের ক্ষেত্রে আমরা কোনো আবেগ পাচ্ছি না। এক লাইন করে গাইলে কোনো আবেদন তৈরি হয় না, অনুভূতি আসে না। সরাসরি গাওয়ার মধ্যে যে কঠিন ব্যাপার থাকে, সেটা এখন নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। শেষ বিচারে দেখা যাচ্ছে, ওই সব পুরোনো দিনের গানই কিন্তু মানুষ শুনছে। আর সেসব শিল্পীই টিকে যাচ্ছেন।
মতিউর : আগেকার গানগুলোর মধ্যে যে চিরন্তন ব্যাপার ছিল—পুরোনো বাংলা, হিন্দি, উর্দু গানে, সেই তুলনায় এখনকার গান ও শিল্পীরা যে হারিয়ে যাচ্ছেন; গানও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গান তেমন একটা স্থায়ীও হচ্ছে না। এর কারণ কি হতে পারে এমন, আগে শিল্পীদের তৈরি ও প্রস্ত্ততির ঘাটতি ছিল না বলে সেসব টিকে আছে এখনো?
runa-3রুনা : এটা যে শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে তা না, এই উপমহাদেশে প্রায় একই প্রবণতা চলছে। আগে গান কম্পোজিশনের সময় প্রযোজক, পরিচালক, গীতিকার, এমনকি যার ওপর চলচ্চিত্রায়ণ হবে, তিনিও থাকতেন। তখন একটা গানের জন্য অনেকের অংশগ্রহণ থাকত। এখন গানের কথা লিখে পাঠিয়ে দেয়। কখনো এসএমএস করে দেয়—প্রথম অন্তরা ওটা, এটা দ্বিতীয় অন্তরা ইত্যাদি। সবকিছু এত দ্রুততানির্ভর হয়ে গেছে, কারও আসলে সময় নেই। সবাই ব্যস্ত।
মতিউর : সময় নেই, ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। কিন্তু এভাবে গান যা হচ্ছে, তা কি স্থায়ী হবে? এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করবেন?
রুনা : এত ব্যস্ততার মধ্যে অনেক কিছু হলেও শিল্প কতটা হয়, সে প্রশ্ন সব সময় থেকে যায়। তবে এর মধ্যেও কিছু ভালো গান এখনো যে হচ্ছে না, তা নয়। অনেকে জাতীয় পুরস্কারও পাচ্ছেন। কিন্তু একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে। সেই অনুভূতিও নেই, সেই একাগ্রতাও অনেক কমে গেছে। এখন যাঁর যাঁর মতো এসে তাঁর কাজ করে চলে যান। মিউজিশিয়ান আসেন। কেউ বেহালা বাজিয়ে চলে যান, কেউ বাঁশি বাজিয়ে চলে যান। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয় না। আরও অদ্ভুত লাগে যে দ্বৈত গানের ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয়, আমি হয়তো এখন গান গাইব, অথচ আমার সহশিল্পী কে, জানি না। ভারত-পাকিস্তানেও একই ঘটনা ঘটছে। আমি আমারটা গেয়ে চলে গেলাম। সহশিল্পী কে জানি না। পরে রেকর্ডিং বেরোলে বুঝি, ও আচ্ছা, আমার সঙ্গে ও গেয়েছে।
মতিউর : এতে তো অবশ্যই একটা পার্থক্য হওয়ার কথা?
রুনা : পার্থক্য তো হয়ই। পশ্চিমা দেশগুলোতেও এ রকম হচ্ছে। আসলে আমরা সবাই অলস হয়ে গেছি। কেউ পরিশ্রম করতে রাজি না। আমরা যেভাবে খেটেছি, সে রকমটা এখন কেউ ভাবেই না।
মতিউর : আপনার শিল্পীজীবনের একটা সময় কেটেছে করাচি ও লাহোরে। ওই সময় ওখানে আহমেদ রুশদি নামে একজন শিল্পী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে একত্রে অনেক গান করেছেন। ওই সময়ের সেরা গায়ক, মিউজিক ডিরেক্টর কাদের কথা আপনার মনে পড়ে?
রুনা : অধিকাংশ কাজ করেছি নিসার গজনি সাহেবের সঙ্গে। আরও ছিলেন এম আশরাফ, এ হামিদ, বাবা চিশতি—এমন আরও অনেকে।
মতিউর : ওই সময় বাঙালিদের মধ্যে রবীন ঘোষ ছিলেন একজন ভালো সুরকার। তাঁর সুরে কোনো গান করেছেন?
রুনা : তাঁর সুরে অনেক গান করেছি। তিনি অনেক পাকিস্তানি ছবিতে সুর দিয়েছেন। তাঁর গানগুলো অনেক সুন্দর; এখনো মানুষ পছন্দ করে। তাঁর একটা গান ‘হামে খো কার বহোত পাচতাওগে’ পাকিস্তানিরা এখনো ভুলতে পারে না।
মতিউর : মানুষটাকে আমি খুব পছন্দ করতাম। আপনি রবীন ঘোষকে কীভাবে দেখেন?
রুনা : ভীষণ ভালো একজন মানুষ ছিলেন। অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ। রবীন ঘোষ করাচিতে ছিলেন দীর্ঘদিন। আমাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন। শবনম বউদির ‘চান্দা’ ছবিটি যখন মুক্তি পায়, তখন তিনি করাচিতে যান। ওই সময় প্রথম দেখা হয়েছে রবীন ঘোষের সঙ্গে। তারপর তো তাঁর সুরে অনেক গান করলাম, অনেক কাজ করলাম। রবীন ঘোষের সুরে গাওয়া আমার বেশির ভাগ গান শবনম বউদির ছবিতে।
মতিউর : সংগীত পরিচালক হতে হলেও কি অনেক গান জানতে হয়, সুর জানতে হয়? বাদ্যযন্ত্রগুলোর ব্যবহার জানতে হয়? আমি তো মনে করি, শুধু জানলেই হয় না, এখানেও তো প্রতিভার একটা ব্যাপার রয়েছে। আমি তো রবীন ঘোষ ও তাঁর ভাইদের জানতাম। তিনি কি অতটা চর্চা করে সেগুলো আয়ত্তে এনেছিলেন বলে মনে করেন?
রুনা : অবশ্যই জানতে হয়। আর রবীন ঘোষের ক্ষেত্রে সহজাত প্রতিভার একটা ব্যাপার তো ছিলই। পরে তিনি সেটাকে আরও শাণিত করেছেন। এখানেও চর্চার বড় একটা ক্ষেত্র রয়েছে। কারণ, লেখাপড়া করে না গেলে আপনি তো হলে গিয়ে পরীক্ষাটা দিতে পারবেন না।
মতিউর : ওই সময় যাঁদের সঙ্গে গান করেছেন, আপনার সমসাময়িক শিল্পী কারা ছিলেন? আমরা জানতাম, নাহিদ নিয়াজি বলে একজন গায়িকা ছিলেন পাকিস্তানে।
রুনা : তিনি আমার চেয়ে সিনিয়র ছিলেন। আমি যখন গাওয়া শুরু করলাম, তখনো তিনি গেয়েছেন। এরপর আস্তে আস্তে লন্ডনে চলে গেলেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে। আমার সমসাময়িক ছিলেন মালা, আইরিন পারভিন, পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে মেহেদি হাসান—তাঁর সঙ্গে অনেক গান গেয়েছি। একসঙ্গে রেকর্ড করেছি, মঞ্চে গেয়েছি। এ ছাড়া গুলাম আলী ছিলেন। তবে মেহেদি হাসানের সুরে কোনো গান করা হয়নি।
মতিউর : ওই সময়ের বিখ্যাত একজন শিল্পী নূরজাহান। তাঁর সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ বা জানাশোনা ছিল? একটু বেশি বয়সে নায়ক এজাজকে তিনি বিয়ে করেছিলেন।
রুনা : হ্যাঁ, যোগাযোগ ছিল, তবে সেটা খুব বেশি নয়। আমাদের সময়ে ম্যাডাম নূরজাহান একটা আলাদা স্তরে ছিলেন। লতাজিও তাঁকে দিদি বলেন। খুব সম্মান করেন তাঁকে। তিনি লতাজির চেয়েও সিনিয়র ছিলেন।
মতিউর : ওই সময়ের নায়ক-নায়িকাদের কার কার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব বা ভালো সম্পর্ক ছিল?
রুনা : ওই সময় যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী, জেবা, ওয়াহিদ মুরাদ, নাদিম—বাংলাদেশের চিত্রপরিচালক এহতেশাম সাহেবের মেয়ের জামাই।
মতিউর : নাদিম কি পরে পাকিস্তানে সফল হয়েছিলেন?
রুনা : খুবই সফল হয়েছিলেন। শবনম আর নাদিম পরে চুটিয়ে কাজ করেছেন। লাহোরে গেলে শুনতাম, পাকিস্তানিরা সব বলত, রবীন ঘোষ, শবনম, রুনা লায়লা, নাদিম—বাঙালিতে সব ভরে গেছে।
মতিউর : যেহেতু আপনি ১৯৭১-’৭২-’৭৩-এ ছিলেন, ওই সময়ের পরিবেশটা কেমন ছিল? এখন কেমন মনে হয়? তখন তো আপনি মোটামুটি জানাবোঝার মধ্যেই ছিলেন।
রুনা : তখন ব্যাপারটা এমন ছিল, কোনো ছবিতে যদি নারী কণ্ঠের ছয়টা গান থাকত, তাহলে ম্যাডাম নূরজাহান অবশ্যই একটা গাইতেন আর বাকি পাঁচটা আমি গাইতাম। আমি শুধু উদু‌র্ ভাষার ছবিতেই গান গাইনি; পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, গুজরাটি—পাকিস্তানি মোটামুটি সব অঞ্চলের ছবিতে গান গেয়েছি।
মতিউর : বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রেক্ষাপটটা একটু বলবেন?
রুনা : বাবা যেহেতু সরকারি চাকরি করতেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁকে বিকল্প দেওয়া হলো—পাকিস্তানে থাকবেন, নাকি বাংলাদেশে চলে যাবেন? বাবা সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, চলে যাব। বড় বোন দীনা লায়লার ওখানে বিয়ে হয়েছে। ওরা বলল, তোমার ক্যারিয়ার তো এখন তুঙ্গে। তুমি চাইলে বোনের সঙ্গে থেকে যেতে পারো। তার আগে বাংলাদেশে আমার বেশি দিন থাকা হয়নি। মাঝে মাঝে বেড়াতে এসে এক সপ্তাহ বা দশ দিন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে আবার ফিরে গিয়েছি। কিন্তু কেন যেন মনে হলো, এখানে থাকব না। চলে যাব। ওদের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত আমাকে রাখার চেষ্টা করেছিল। কারণ ওদের চলচ্চিত্রের অধিকাংশ গান আমিই গাইতাম। ওরা কতৃ‌র্পক্ষের কাছে গিয়ে বলল, ‘রুনা লায়লা চলে গেলে চলচ্চিত্রশিল্পের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, সব গান আমরা তাঁকে দিয়েই গাওয়াচ্ছি ইত্যাদি। যেভাবে হোক, তাঁকে আটকান। তাঁর বাবা, পরিবারের সবাই যাচ্ছে, যাক। কিন্তু রুনা লায়লাকে রাখতেই হবে।’ কিন্তু কতৃ‌র্পক্ষ বলল, ‘তিনি যদি স্বেচ্ছায় যেতে চান, আমরা তো জোর করে রাখতে পারব না।’ তারপর ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফ্লাইটে আমরা সবাই চলে এলাম।
মতিউর : ১৯৭৪ সালের কোনো একসময়ে অভিসার সিনেমা হলে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেখানে আমি ছিলাম। মালেকার বড় ভাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন। তিনি যাবেন না বলে কার্ডটা আমাকে দিয়েছিলেন। আপনার একক অনুষ্ঠান ছিল সেটা। অনেকগুলো গান করেছিলেন। সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে অনেক গান গেয়েছিলেন। ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’ গানটি গেয়েছিলেন শেষে।
রুনা : ওটা বোধ হয় একটি চ্যারিটি অনুষ্ঠান ছিল। কী একটা কাজের জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল। এরপর বন্যার্ত মানুষের ত্রাণের জন্য বেশ কয়েকটা প্রদর্শনী করেছিলাম। ওই সময় চ্যারিটি প্রোগ্রাম অনেক করেছি। এ ছাড়া বড় বোন ক্যানসারে মারা গেলে শিশু হাসপাতালে তাঁর নামে ওয়ার্ড করার জন্য ঢাকায় তিনটা, চট্টগ্রামে তিনটা অনুষ্ঠান করেছিলাম।

মতিউর : তিনি কি মারা যাওয়ার সময় পাকিস্তানেই ছিলেন?
রুনা : করাচিতেই ছিলেন। চিকিৎসা হয়েছে লন্ডনে। আমরা সবাই লন্ডনে গিয়েছিলাম। চিকিৎসকেরা বললেন, আর কিছু করার নেই। তখন আমরা চলে এলাম। এত তাড়াতাড়ি যে মৃত্যুর দিকে এগোবে, এটা আমরা ভাবতে পারিনি। আমরা দুই বোন ছিলাম আর একটাই ভাই। ভাইটা এখানেই থাকে।
মতিউর : পাকিস্তানের বিখ্যাত অভিনেতা জিয়া মহিউদ্দিনের সঙ্গে আপনি শো করেছিলেন। তিনি কি বেঁচে আছেন? এখনো কি পাকিস্তানেই থাকেন?
রুনা : হ্যাঁ, জিয়া মহিউদ্দিন বেঁচে আছেন। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। তখন জানতাম, তিনি পিআইএ আর্টস একাডেমির প্রধান। অনেক দিন ধরে যোগাযোগ নেই। কিন্তু বেঁচে আছেন, এটা জানি। তাঁর সঙ্গে অনেক কাজ করেছি। মঈন আখতার ছিলেন—খুব প্রতিভাবান, খুব নামকরা, তাঁর সঙ্গেও কাজ করেছি। ওই সময়ে সংগীতের একটি দুর্দান্ত সময় ছিল পাকিস্তানের। আমার ওই সময়টাকে ওরা বলে, দ্যাট ওয়াজ দ্য গোল্ডেন পিরিয়ড অব পাকিস্তান।
মতিউর : জিয়া মহিউদ্দিন পশ্চিমা দেশেও পরিচিত। আমি যত দূর জানি, ‘গান্ধী’ ছবিতেও তিনি কাজ করেছেন। শহীদ সোহ্‌রাওয়াদীর ছেলে রাশেদ সোহ্‌রাওয়ার্দী ‘গান্ধী’ ছবিতে জিন্নাহর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
রুনা : বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’তেও অভিনয় করেছেন জিয়া মহিউদ্দিন।
মতিউর : পাকিস্তান তো তখন গান ও অভিনয়ে ভালো ছিল। আপনি কি মনে করেন সংগীত, নৃত্য বা সাংস্কৃতিক চর্চার দিক থেকে বর্তমানে পাকিস্তান সেই পর্যায়ে আছে?
রুনা : ওদের গানগুলো কিন্তু ভালো হয়। ওদের গানের বিষয় খুব ভালো হয়।
মতিউর : করাচিতে ‘বাজমে লায়লা’ নামে একটা অনুষ্ঠান ছিল।
রুনা : করাচি টেলিভিশনে আমার একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘বাজমে লায়লা’। সেটি ছিল নতুন একটা কনসেপ্ট। সেটা প্রতি দুই সপ্তাহ পর হতো। ভিন্ন ধাঁচের পাঁচটি গান থাকত। প্রতিটি গানের ছিল আলাদা সুরকার। প্রতিটি গানের জন্য পোশাক, মেকআপ, হেয়ার স্টাইল, গয়না ইত্যাদি বদলাতে হতো। পাকিস্তানিরা তো খুব রক্ষণশীল। তাই ওই অনুষ্ঠান নিয়ে প্রথম দিকে ওদের দ্বিমত ছিল। ওদের বললাম, আমি টিনএজার। আমি এমনিতেই প্যান্ট-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াই। আমি জিনস পরি, ম্যাক্সি পরি। আমি তো আপত্তিকর কিছু পরব না। আমরা ফ্রেন্ডরা তো তেমন ড্রেসই পরতাম। অবশ্য এখনকার তুলনায় তখন বেশ আধুনিকই ছিল ওরা। ওদের বললাম, প্যান্ট-শার্ট, টি-শার্ট পরে তো সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি ওভাবেই গান করব। যদি রাজি থাকো করব, তা না হলে করব না। পরিকল্পনাটা কিন্তু আমারই। প্রযোজক ছিলেন বেশ প্রগতিশীল। তিনি বললেন, একটা চেষ্টা করে দেখা যাক না। অনুষ্ঠানটি প্রচারের পর যেন ফেটে পড়ল মানুষ। প্রচণ্ড সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। মানুষ ভীষণভাবে উপভোগ করল। কারণ, গানের সঙ্গে যে পারফরম্যান্সও হতে পারে, এই কনসেপ্ট তো ওদের ছিল না। আমার ধারণাটি ছিল সে সময়ে সম্পূর্ণ নতুন। অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল।
মতিউর : সম্ভবত বাংলাদেশেও এই পরিবর্তনটা আপনি এনেছিলেন।
রুনা : কেবল বাংলাদেশ না, ভারতেও এই পরিবর্তনে আমার ভূমিকা ছিল। ১৯৭৪ সালে ওদের দূরদর্শন টেলিভিশনে যখন প্রথম গাইলাম তখন ওরাও অবাক হলো। বলল, এ রকম তো আগে আমরা কখনো দেখিনি। আর এখন তো গানের সঙ্গে পারফরম্যান্স ছাড়া চলেই না। এখন ভাবছি, ওই ধরন বদল করে এখন আমি স্থির হয়ে গাইব। [হাসি]
মতিউর : সময়, পরিবেশ, রুচি, স্টাইলের সঙ্গে সমাজ ও জীবনের যে পরিবর্তন হয় এটাকে কীভাবে দেখেন?
রুনা : জীবন ও সমাজের এই পরিবর্তন তো হবেই। কিন্তু আমাদের যে শেকড়—আমাদের লোকগান, আমাদের রাগসংগীত—এগুলোকে তো কখনো অবজ্ঞা করতে পারব না। এগুলোই আমাদের ঐতিহ্য।
মতিউর : আপনার মধ্যে এটা কোত্থেকে এল? এই দমা দম মাস্ত কালান্দার—এই নেচে নেচে গান করা, পারফর্ম করা।
রুনা : এটা আমার ভেতর থেকে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। নাচ শিখেছি বলে এর একটা প্রভাব পড়েছে কি না জানি না। তবে যেটাই করি, আমি কিন্তু চিন্তা করে করি না, যে এটা আমাকে করতে হবে। আপনা-আপনিই চলে আসে। গান গাওয়ার আগে-পরে কখনো কোনো কিছু চিন্তা করি না। গানের মুডের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সবকিছু তৈরি হয়। আরেকটা কারণ হতে পারে, আমি অনেক পশ্চিমা শিল্পীদের গান শুনতাম, ভিডিও দেখতাম। ওই সময়ে ইরানে একজন অত্যন্ত আধুনিক শিল্পী ছিলেন। নাম গুগুশ খানুম। তখন ইরান খুব আধুনিক। গুগুশ খানুম খুবই অত্যাধুনিক পোশাক পরে গান করতেন। তখন ইরানের সঙ্গে একটি সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি হয়েছিল। আমার কিছু গান ইরানে পাঠানো হয়েছিল, আর ইরানের গুগুশ খানুমের কিছু গান আমাদের এখানে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু আমি তাঁর পারফরম্যান্সে খুব অভিভূত ছিলাম। আমি অনেকের কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়েছি। তারপর নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছি। কাউকে কপি করিনি কখনো। কিন্তু গ্রহণ করেছি। এমনকি এখন যেসব তরুণ শিল্পী গান করছেন, ওঁদের গানও শুনি। শিল্পের ক্ষেত্রে ছোট-বড় বলে কিছু নেই। ওঁদের কাছ থেকেও শেখার আছে। কোনো কিছু ধরে রাখতে হলে আসলে জীবনব্যাপী শিখতে হয়। সব সময় সামনে এগোনোর চেষ্টা করতে হয়।
মতিউর : পাকিস্তানে থাকাকালে কোনো বাংলা গান করতেন কি?
রুনা : তখন ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে বাংলা গান রেকর্ডিং করা হতো। সেখানে প্রথম বাংলা গান করি ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’—দেবু ভট্টাচার্যের সুরে গেয়েছিলাম। এরপর ‘আমি নদীর মতো কত পথ ঘুরে’, ‘ওই দুলছে দেখো দোলনচাঁপা দুলছে’—এ রকম অনেক গানই রেকর্ডিং করেছিলাম। সেগুলো ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে বাজানো হতো। একবার লাহোরে বারী স্টুডিওতে গান রেকর্ড করছিলাম, তখন একবার সুবলদা ও পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম গিয়েছিলেন গান ডাবিং করতে। তাঁরা আমাকে বললেন, আপনি একটা সিনেমার জন্য বাংলা টাইটেল সং গেয়ে দেবেন? ওটা ছিল স্বরলিপি সিনেমার। সেটাই ছিল বাংলা ছবিতে আমার প্রথম গাওয়া। গানটি ছিল ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে…’।
মতিউর : লাহোরেই প্রথম বাংলা সিনেমার জন্য গাইলেন?
রুনা : লাহোরেই গেয়েছিলাম। এরপর ঢাকায় এসে প্রথম সত্য সাহা দাদার সুরে খন্দকার ফারুক আহমেদের সঙ্গে গাইলাম জীবনসাথী ছবিতে। ওটাও টাইটেল সংই ছিল, ‘ও আমার জীবনসাথী’…।
মতিউর : আপনি যখন ফিরে এলেন দেশে, তখন পরিবেশ-পরিস্থিতি আপনার জন্য কেমন ছিল? অনুকূল ছিল? স্বাধীনভাবে সবকিছু করতে পেরেছিলেন, নাকি কোনো ধরনের বাধা, আপত্তি, অসুবিধা ছিল?
রুনা : অনেক দিক থেকে অনেক রকম বাধা ছিল। কিন্তু আমার প্রতি মানুষের বিরাট একটা সমর্থন ছিল। কারণ, মানুষ খুব খুশি হয়েছিল, আমার এত অর্জন, ব্যাপক সম্ভাবনা আর সেখানে প্রতিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সবকিছু ছেড়ে দিয়ে দেশের টানে চলে এসেছি। সেই কারণে খুব সম্মান পেয়েছি আমি। যেখানে যেতাম, সেখানেই মানুষের শ্রদ্ধা পেতাম। এরপর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই আমাকে সমর্থন করেছেন। কাজ করেছি তাঁদের সঙ্গে।
মতিউর : তেমন কারও নাম মনে আছে, যাঁরা আপনাকে সমর্থন করেছেন?
রুনা : সুরকার সত্য সাহা, যিনি প্রথম ছবিতে গাওয়ান। এ ছাড়া প্রায় সবাই এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন। একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন। কিছু বাধাবিঘ্ন সব সময় থাকে। কিন্তু আল্লাহ আছেন ওপরে; আর প্রতিভা থাকলে কেউ আটকাতে পারেন না।
মতিউর : ঢাকায় আসার পর সিনেমায় গান শুরু করলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও কি একই স্টাইলে গান করতেন?
রুনা : এখানেও অনেকে বলল, এসব হবে না। এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। এখানে এটা চলবে না। আমি বললাম, এটাই আমার স্টাইল। আমি সেভাবে গান না করলে তো আমার ইমেজটা নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, যেসব গান গাইতাম পাকিস্তানে, সেসব এখানকার লোকজনও দেখত। এভাবে গেয়েই আমি অভ্যস্ত। এরা বলল, মানুষ এটা গ্রহণ করবে না। বললাম, আমি আমার মতো করি, মানুষ যদি কিছু বলে তো আমাকেই বলবে। আপনাদের তো বলবে না। যা-ই হোক, গান করলাম। প্রচারিত হলো। মানুষ তো ভীষণ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করল। আমি জনপ্রিয়তা পেলাম।
মতিউর : আপনি একই সঙ্গে রেডিও, টেলিভিশন, মঞ্চ ও সিনেমায় নিজেকে তুলে ধরলেন। ভারতে যাওয়া-আসা শুরু করলেন কবে থেকে?
রুনা : আগেই বলেছি, ১৯৭৪ সালে প্রথম ভারতে যাই এবং গান করি।
মতিউর : একসময় একটা কথা শুনেছিলাম যে, কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লাহ বলেছিলেন, তোমরা রুনা লায়লাকে আমাদের দাও আর কাশ্মীর নিয়ে নাও। এই কথার কি আসলে কোনো ভিত্তি ছিল?
রুনা : এটা আবদুল্লাহ সাহেব বলেননি। বলেছিলেন খুশবন্ত সিং। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন। তিনি কিন্তু খুব কম সময়ই প্রশংসা করতেন। সব সময় সমালোচনা করতেন। কিন্তু একবার আমার একটা কনসার্টে এসেছিলেন—সম্ভবত দিল্লিতে। পুরো অনুষ্ঠানে ছিলেন। কোনো মন্তব্য করলেন না। আমার সঙ্গে দেখাও করেননি; কোনো কথাও বলেননি। কিন্তু তাঁর পত্রিকায় আমাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছিলেন। এর মধ্যে ছিল, রুনা লায়লার গান শুধু শোনারই বিষয় না, দেখারও ব্যাপার আছে। তার পুরো অনুষ্ঠানটি দেখেছি। আমি শুধু একটা কথাই বলব বাংলাদেশ সরকারকে, ‘প্লিজ গিভ আস রুনা লায়লা, অ্যান্ড টেক অল দ্য ওয়াটার অব ফারাক্কা।’
শেখ আবদুল্লাহ ওই সময় কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে নিয়েও বড় একটা ঘটনা আছে। সম্ভবত ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সাল হবে। তখন শ্রীনগরে কোনো হাসপাতাল ছিল না। চিকিৎসা করতে চণ্ডীগড় বা দিল্লিতে যেতে হতো। তিনি একবার নিজের হাতে আমাকে চিঠি লিখলেন, ‘শ্রীনগরে একটা হাসপাতালের জন্য তহবিল গঠন করতে চাই। আপনি একটা গানের অনুষ্ঠান করে দেবেন? আপনার যা পারিশ্রমিক, তা আমাকে জানিয়ে দেবেন—আমি সেভাবে আয়োজন করব।’
আমি উত্তরে লিখলাম, ‘আপনি এত বড় একজন মানুষ হয়ে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন এত ভালো একটা কাজের জন্য, এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের। আমি কোনো পারিশ্রমিক নেব না। কোনো পেমেন্টের প্রশ্নই আসে না। আমি আসব আর বেড়িয়ে যাব—আপনার হাসপাতালের জন্য অনুষ্ঠানে গান করব।’ তিনি আরেকটা চিঠিতে লিখলেন, ‘ইউ অ্যান্ড ইয়োর হোল ফ্যামিলি আর করডিয়েলি ইনভাইটেড টু কাম অ্যাজ মাই গেস্ট।’ সেই চিঠিতেই তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘এখানকার অনেক শিল্পীকে আমি বলেছি, কেউ পারিশ্রমিক ছাড়া অনুষ্ঠান করতে রাজি হননি। আপনি অন্য দেশের শিল্পী হয়ে আমার দেশের মানুষের জন্য তহবিল গঠনে গান করতে রাজি হয়েছেন—বিনা পারিশ্রমিকে গান করবেন। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।’ এরপর মা-বাবাসহ আমরা সবাই গেলাম। বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লালগালিচা অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাঁর অতিথিশালায় আমাদের রাখলেন। তাঁর ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন। আমাদের সবাইকে অনেক কিছু উপহার দিলেন।
যা-ই হোক, সেখানে দুই দিন অনুষ্ঠান করলাম। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হলো একটা মিলনায়তনে। সেই মঞ্চে এত সুন্দর করে আমার সম্পর্কে তিনি বললেন, কখনোই চিন্তা করতে পারি না, একজন মানুষ সম্পর্কে কীভাবে এত ভালো করে বলা যায়। দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠান হলো স্টেডিয়ামে। সেখানে অনেক লোকসমাগম হলো। ওই অনুষ্ঠান এবং আমার নিরাপত্তার জন্য সেখানে চৌদ্দ শ মাউন্টেইন পুলিশ নিয়োজিত ছিল। এখনো কলকাতায় যারা কাশ্মীরি শাল বিক্রি করে, তাদের কেউ কেউ আমাকে দেখে বলে, ‘আপনাকে আমরা অনেক দোয়া দিই।’ কেন, কী হলো? তারা বলে, ‘আপনি যে আমাদের জন্য হাসপাতাল করে দিয়েছেন। আপনার নামটা সেই হাসপাতালে লেখা আছে। আমরা যখনই সেখানে যাই, খুব দোয়া দিই।’ আমি মনে করি, এটা একটা বিরাট পাওয়া।
মতিউর : আমরা অনেক কথাই শুনেছি লোকমুখে। কিন্তু এতটা বিস্তারিত জানতাম না, বিশেষ করে আবদুল্লাহ আর খুশবন্ত সিংয়ের কথার পার্থক্য যেটা করলেন। আচ্ছা, সবচেয়ে ভালো সম্মান কি তাহলে এটাকেই বলা যায়, শেখ আবদুল্লাহ যেটা করলেন? আর ফারুকের সঙ্গে পরে আর দেখা হয়েছে?
রুনা : হুম, ঠিকই বলেছেন, অবশ্যই বড় সম্মান এটা। ফারুকের সঙ্গে পরে অনেকবার দেখা হয়েছে। ফোন নম্বর দিয়েছিলেন, যোগাযোগ হয়।
মতিউর : ওই সময়ে কত টাকা উঠেছিল সেই অনুষ্ঠান থেকে, আপনার কি কোনো ধারণা আছে?
রুনা : এটা আসলে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে তারা ওই টাকায় হাসপাতাল তৈরি করেছিল এবং আমার নামটা উৎকীর্ণ করে লেখা আছে ‘ডোনেটেড বাই রুনা লায়লা’।
মতিউর : সেই থেকে শুরু করে মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, বেঙ্গালুরু—পৃথিবীতে এমন কোনো বড় শহর কি বাকি আছে, যেখানে আপনি গান করেননি।
রুনা : না, কোনো বড় শহরই বোধ হয় বাকি নেই।
মতিউর : কিন্তু ১৯৭৪ সালে এখানে আসার পর পাকিস্তানে আর গেলেন না…।
রুনা : হ্যাঁ গিয়েছি। তবে এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর যাওয়া হয়নি। সর্বশেষ আমি গিয়েছিলাম করাচিতে লাক্সের পঞ্চাশ বছর আর ওদের চলচ্চিত্রশিল্পের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে। ওখানে আমাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কী সম্মান যে আমাকে দেখিয়েছিল, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমার সেরা ছয়টি গান নিয়ে একটি মেড্লি করা হয়েছিল। একজন নায়িকা ছিলেন। তিনি গানের ওপর নাচলেন। অগণিত দর্শক ছিল অনুষ্ঠানে। গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব দর্শক দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান জানাল। আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল সেদিন। কিছু কিছু ব্যাপার থাকে, মন ছুঁয়ে যায়। সেদিন আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, মানুষ জীবনে অনেক টাকাপয়সা উপার্জন করে। কিন্তু সম্মানটা, কেউ টাকা দিয়ে কিনতে পারবে না। এই ভালোবাসা অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা যায় না।
মতিউর : আপনার গাওয়া সব গানের মধ্যে এই গানটি সবচেয়ে জনপ্রিয়—তারপর এটা, এরপর এটা, এভাবে বলতে পারেন? সে ক্ষেত্রে ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’ গানকে কি সবার আগে রাখবেন?
রুনা : ভারতে তো আমার নামই দিয়েছে ‘দমা দম গার্ল’। এই গানটা যখন আমি ভারতে প্রথম গাই, তখন কল্পনাও করিনি, গানটা এতটা জনপ্রিয় হবে। এখন তো প্রায় সব শিল্পীই এটা গান।
মতিউর : গানটি কে লিখেছেন?
রুনা: শাহবাজ কালান্দার নামে পাকিস্তানের সিন্ধুতে একজন বড় পীর ছিলেন। তাঁর মাজারে ওরসের সময় গানটি গাওয়া হতো। তবে কে কখন কোথায় কীভাবে লিখেছেন, সুর করেছেন, কেউ জানে না। গানটা সেখান থেকেই পাওয়া। এটা বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্নভাবে গেয়েছেন—সেটা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। আমি আমার একটা স্টাইলে গেয়েছি। এই গানটি এতই জনপ্রিয় ছিল, পাকিস্তানের সবাই যার যার মতো গেয়েছে। এটা যখন এখানে বা ভারতে বা পাকিস্তানে নিজস্ব স্টাইলে গাইলাম, মানুষ খুব ভালোভাবে গ্রহণ করল।
মতিউর : অভিসার সিনামা হলের সেই অনুষ্ঠানটিও এই গানটি দিয়েই শেষ করেছেন।
রুনা : এটা সব সময় শেষেই গাই। কারণ এটা একটু আধ্যাত্মিক ধাঁচের গান।
মতিউর : বাপ্পি লাহিড়ীর করা সুপারুনা ডিস্কের কথা কি বলবেন? জনপ্রিয়তার দিক থেকে কি সেই ডিস্কটাই সবচেয়ে এগিয়ে?
রুনা : ডিস্ক হিসেবে হতে পারে, কিন্তু গান হিসেবে ‘মেরা বাবু স্যায়ল-সাবিলা’ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এ ছাড়া পাকিস্তানে ‘দিলদারকে’, ‘আপ দিলকে আঞ্জুমান মে’, বাংলাদেশে ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘শিল্পী আমি’, ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘যখন আমি থাকব না’, ‘বৃষ্টিভেজা রাতে’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট’, ‘বন্ধু, তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’, ‘বাড়ির মানুষ কয়’, ‘ইস্টিশনের রেলগাড়িটা’—এ রকম বেশ কিছু গান আছে খুব জনপ্রিয়। আমি কলকাতায় গিয়ে বাংলা ও হিন্দি গানগুলো আবার রেকর্ড করিয়েছি।
মতিউর : পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি ভাষায় গান করলেন, ভারতেও তো আপনি আধুনিক গান, গজল—সব ধরনের গান করলেন। ভারতের কতগুলো ভাষায় করলেন?
রুনা : ভারতে হিন্দি আর উদু‌র্—দুই ভাষায়ই গেয়েছি। গজল তো উদু‌র্তেই হয়। আর সিনেমার গান হিন্দি বা উদু‌র্তেও গেয়েছি।
মতিউর : সিনেমার গানের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে, ভারতে না পাকিস্তানে বেশি গেয়েছেন?
রুনা : পাকিস্তানে অনেক বেশি গেয়েছি। এখানেও অনেক গেয়েছি।
মতিউর : আপনার গাওয়া গানের সংখ্যা কত হতে পারে?
রুনা : ঠিক মনে নেই। তবে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সব মিলিয়ে সিনেমাসহ ১০ হাজার হতে পারে।
মতিউর : লতা মঙ্গেশকরেরটা সংখ্যার দিক থেকে ৫০ হাজারের কথা শোনা যায়। এটা হতে পারে, নাকি?
রুনা : হতে পারে। তিনি চল্লিশের দশক থেকে শুরু করেছেন গান গাওয়া।
মতিউর : পাকিস্তানের ক্রিকেটার হানিফ মোহাম্মদের কথা মনে আছে? আমি তাঁর আত্মজীবনী পড়েছি। ১৯৫২ বা ’৫৩ সালে ভারতে খেলতে গেছেন। একদিন সকালে দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। দরজা খুলে দেখেন লতা ও আশা মঙ্গেশকর দুই বোন। আমি খুব অবাক হয়েছি, তিনি তখনো বড় শিল্পী, একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন।
রুনা : তাঁদের মধ্যে অহংকার নেই। তিনি পাকিস্তানে যেতে পারবেন না বলে ম্যাডাম নূরজাহানকে দেখতে যেতেন সীমান্তে। ম্যাডাম নূরজাহান লাহোরের কাছাকাছি ওয়াগা সীমান্তে আসতেন, আর লতাজি মুম্বাই থেকে যেতেন।
মতিউর : কিছুদিন আগে উৎপলা সেনের লেখা পড়লাম। তিনি ঢাকার মেয়ে, কিন্তু কলকাতায় গিয়ে গান করেছেন। তিনি একবার মুম্বাই গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকর সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, যেন ট্রেনে করে তিনি ঠিকভাবে কলকাতায় ফিরতে পারেন। সঙ্গে লোক দিয়ে দিয়েছিলেন, খাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন—সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
রুনা : মেহেদি হাসান সাহেব যখন গেলেন মুম্বাইয়ে, লতাজিই তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তারপর তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেছেন, বিরিয়ানি খাইয়েছেন। বিষয়গুলো তিনি হাতছাড়া করতেন না।
মতিউর : মোহাম্মদ রফিকে নিয়ে কোনো স্মৃতি আছে?
রুনা : তাঁর সঙ্গে একটা গান করেছিলাম বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে। স্টুডিওতে ঢুকেই দেখি মোহাম্মদ রফি সাহেব রিহার্সাল করছেন। আমাদের তো আগে থেকেই রিহার্সাল করা ছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। এত বড় একজন শিল্পী। তাঁকে সালাম করে বললাম, আপনার সঙ্গে গান গাইব, এটা একটা স্বপ্নের মতো লাগছে আমার কাছে। আমার স্বপ্ন ছিল, কখনো যদি কোনো দিন আপনার সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু হবেই যে, সেটা কোনো দিন ভাবতে পারিনি। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। এটা খুব সম্মানের ব্যাপার, আপনার সঙ্গে গানটি গাইছি। তিনি বললেন, ‘না, না। এটা আপনি কী বলছেন? আপনার সঙ্গে গান গাইতে পারব, এটা আমার জন্যও অনেক বড় সম্মানের।’ আমি কিন্তু ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছি।
মতিউর : মুম্বাইতে আর কার সঙ্গে গান করেছেন? তালাত মাহমুদ, জগজিৎ সিং—এঁদের সঙ্গে কি গান করেছেন?
রুনা : জগজিৎ সিংয়ের সঙ্গে এমনি গানের অনুষ্ঠান করেছি। ভূপিন্দর সিংয়ের সঙ্গে গেয়েছি।
মতিউর : আর কার কার সঙ্গে অনুষ্ঠানে গেয়েছেন?
রুনা : রফি সাহেব, আমি, কিশোরদা—তিনজন মিলে কলকাতার নেতাজি স্টেডিয়ামে দুবার করে শো করেছি।
মতিউর : রফির কথা বললেন, কিশোর কুমারকে আপনি কেমন দেখেছেন?
Runa-Laila20রুনা : কিশোর কুমার পুরো অন্য এক জগতের মানুষ ছিলেন—সব সময় খুব হাসিখুশি। মজা করতেন। দুষ্টুমি করতেন। একবার নেতাজি স্টেডিয়ামে গান করব। স্টুডিওতে ঢুকে আয়োজকদের বলছি, কিশোরদা কোথায়? তিনি দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ লাফ দিয়ে চিৎকার করে বলছেন, ‘নমস্কার, নমস্কার।’ আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেছি। তিনি বলছেন, ‘ভয় পাইছেন, ভয় পাইছেন?’ এটা হচ্ছে তাঁর বৈশিষ্ট্য। এভাবে দুষ্টুমি-পাগলামি করতেন। মানুষও এই পাগলামি খুব উপভোগ করত। কিশোর কুমারের স্টেজ পারফরম্যান্স ছিল সাংঘাতিক। তিনি তো মঞ্চে নেচে-লাফিয়ে-শুয়ে গান করতেন। গাইতে গাইতে হঠাৎ মঞ্চে শুয়ে পড়তেন। তবে তাঁর আর আমার একসঙ্গে গান গাওয়া হয়নি। দুর্দান্ত প্রতিভাবান ছিলেন। আর রফি সাহেব, যাঁকে বলে সত্যিকারের ভদ্রলোক। জীবনে কোনো সময় মনে হয় কারও সঙ্গে রাগ করেননি, জোরে কথা বলেননি। এত সুন্দর মিষ্টি করে কথা বলতেন, ভাবাই যায় না। আসলে বড় মানুষগুলো এমনই হন।
মতিউর : সলিল চৌধুরীর সঙ্গে কোনো কাজ করেছেন?
রুনা : তাঁর সঙ্গে কেনো কাজ করা হয়নি। কিন্তু দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। কী যে প্রতিভাবান লোক ছিলেন!
মতিউর : জানেন বোধ হয় রাজনৈতিক গান, দেশাত্মবোধক গান দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর সংগীতজীবন।
রুনা : জানি। কঠিন তাঁর গানগুলো। নিজেই লিখতেন, সুর করতেন। তাঁর অনেক গান লতাজি গেয়েছেন। তাঁর স্ত্রী সবিতা চৌধুরীও গান করতেন। মেয়ে অন্তরাও গান গায়।
মতিউর : বাংলাদেশে আপনি আসার আগে থেকেই যাঁরা গান করেছেন, তাঁদের কীভাবে দেখেন?
রুনা : আমার আগে গান করতেন ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম, ফরিদা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন। পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে আবদুল আলীম, মাহমুদুন নবী, খন্দকার ফারুক আহমেদ। তাঁরা অনেক সিনিয়র ছিলেন। তারপরও তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। তাঁরা সবাই কোনো না কোনোভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখনো দিচ্ছেন। যেমন লতাজি-আশাজি-ম্যাডাম নূরজাহানের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত হই।
মতিউর : আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়েছিল?
রুনা : তাঁর সঙ্গে কোনো গান করার সুযোগ হয়নি। তবে তিনি আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। আমরা যখন করাচিতে ছিলাম, তখন তিনি দেবু ভট্টাচার্যের ওখানে থাকতেন। প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো ছিলেন। তাঁকে আলতাফ মামা বলে ডাকতাম। খুব আদর করতেন আমাদের। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানার সুযোগ পাইনি। আমি তখন অনেক ছোট। তবে এমনটা হয়েছে, তিনি মঞ্চে হারমোনিয়াম বাজিয়েছেন, আমি গান করেছি। মাকে বলতেন, ও কিন্তু বড় শিল্পী হবে।
মতিউর : দেবু ভট্টাচার্যকে তো আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। তিনি খুব অনালোচিত। তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু আমরা জানি না। আমার খুব জানার আগ্রহ তাঁর সম্পর্কে।
রুনা : দেবু ভট্টাচার্য করাচিতে থাকতেন। ভারতে থাকতে সলিল চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন। ভারতের বিখ্যাত একজন বংশীবাদক পান্নালাল ঘোষের ছাত্র ছিলেন। ওই সময়ে তিনি পাকিস্তানের অনেক ভালো উর্দু ছবিতে কাজ করেছেন।
মতিউর : তিনি কি ঢাকা থেকে গেলেন করাচিতে, নাকি ভারত থেকে?
রুনা : ভারত থেকেই গেলেন।

মতিউর : খুব অস্বাভাবিক না? হিন্দু একজন সংগীত পরিচালক, ওই সময়ে করাচিতে গেলেন, ভারত ছেড়ে…।
রুনা : আসলে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে অনেক পরে। তাই তিনি কখন কোথা থেকে গিয়েছেন, সেটা বিস্তারিত জানি না। তবে আমরা তো তাঁকে অনেক নামকরা সংগীত পরিচালক হিসেবে পেয়েছি। একবার এক প্রযোজক একটি ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য দেবু ভট্টাচার্যকে প্রস্তাব করেছেন। তখন তিনি সংগীত পরিচালকদের মধ্যে সেরা। ওই সময় বেশ কয়েকটি ছবিতে আমার গাওয়া গান জনপ্রিয় হয়েছে। প্রযোজক ঠিক করেছেন আমাকে দিয়ে তাঁর ছবির গান গাওয়াবেন। তিনি বললেন, ‘না, নতুন শিল্পী দিয়ে আমার গান হবে না। আমি খুব কঠিন গান বানাই। ও তো বাচ্চা মেয়ে। ও কী গাইবে?’ তিনি বাতিলই করে দিলেন। গাওয়াবেন না আমাকে দিয়ে। প্রযোজক বললেন, ‘ও তো বেশ নাম করেছে। ওর গান হিট হচ্ছে একটার পর একটা। আমি চাইছি, ও গানটি করুক।’ পরে রাজি হলেন। তবে বুঝলাম, তিনি আমাকে পছন্দ করছেন না। তখন দেবু ভট্টাচার্যের পছন্দের শিল্পী ছিলেন আইরিন পারভিন, রেহানা ইয়াসমিন প্রমুখ। বললেন, ‘আমি এদের দিয়েই গান গাওয়াই, অন্য কোনো শিল্পীকে দিয়ে গাওয়াই না। প্রযোজক জোর করছে বলে তোমাকে দিয়ে গাওয়াব। কিন্তু এটাতে আমার মত নেই।’ মুখের ওপর এই কথা বলে দিলেন। শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি গানটি শোনালেন। একপর্যায়ে গানটি যখন তুললাম, তিনি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর বললেন, ‘আমি আসলে ভুল বলেছিলাম। তুমি পারবে।’ তারপর ওখানে-এখানে তাঁর অনেক কাজ করেছি।
মতিউর : পরে কি তিনি ঢাকায় এসেছিলেন?
রুনা : হ্যাঁ, আমরা তো একসঙ্গেই এসেছি।
মতিউর : তিনি মারা গেলেন কবে, কোথায়?
রুনা : ঢাকা মেডিকেলে মারা গেছেন। মারা যাওয়ার সময় খুব খারাপ অবস্থায় ছিলেন। মারা যাওয়ার সময় পাশে কেউ ছিল না। মোহাম্মদপুরের কোনো এক জায়গায় থাকতেন। শেষ দিকে এমন হয়েছে, চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে পারছিলেন না। অথচ খুব গুণী মানুষ ছিলেন। এখানে তেমন কোনো কাজ বা সম্মান দেওয়া হয়নি। একধরনের নোংরা রাজনীতি তখনো ছিল, যে কারণে বাইরে থেকে এসে ইন্ডাস্ট্রিতে ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। আমার অনেকগুলো হিট গানের সংগীতায়োজন ছিল তাঁর। সাবিনার ওই গানটি তো সুপারহিট, ‘ইট্টুসখানি দেখো, একখান কথা রাখো…’, আমার গাওয়া ‘আমি নদীর মতন কত পথ ঘুরে’, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ ইত্যাদি বিখ্যাত গান তাঁর সুর করা।
মতিউর : বাংলাদেশের সংগীত পরিচালকদের মধ্যে গত ৩০-৪০ বছরের মধ্যে কাদের আপনি খুব সফল মনে করেন?
রুনা : আমি তো সিনিয়র-জুনিয়র সবার সঙ্গে কাজ করেছি। আবদুল আহাদের কথা বলা যায় (তাঁরটা অবশ্য ছবির গান না)। রেডিওতে গেয়েছি ‘হাতেরই কাঁকন’, ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে, তুমি এলে’। সুবল দাসের অনেক গান গেয়েছি। তার মধ্যে ‘যখন থামবে কোলাহল’, ‘যখন আমি থাকব না’, ‘পান খাইয়া ঠোঁট’, ‘শিল্পী আমি’, ‘বৃষ্টিভেজা রাত’ প্রভৃতি। এ ছাড়া সত্য সাহা, খন্দকার নূরুল আলম, আলম খান, আনোয়ার পারভেজ, আলী হোসেন, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলসহ আরও অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি। নতুন প্রায় সবার সঙ্গে কাজ করেছি।
মতিউর : শাহনাজ রহমতুল্লাহ কি বয়সে আপনার চেয়ে বড়, নাকি…? তিনি তো স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানেও গান করেছেন।
রুনা : সমসাময়িক হবেন। পাকিস্তানেও অনেক গান করেছেন তিনি। সেখানে জনপ্রিয়ও ছিলেন। তিনি তো বেশ কিছু জাতীয়তাবাদী গানও গেয়েছিলেন।
মতিউর : শিল্পী হিসেবে তাঁকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রুনা : অবশ্যই অনেক গুণী শিল্পী। কিন্তু কেন জানি হঠাৎ করেই গান ছেড়ে দিলেন এবং আর গাইতে চান না। আমার মনে হয়, প্রতিভা থাকলে সেটা সবার সঙ্গে শেয়ার করা উচিত।
মতিউর : আপনার ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম, ফরিদা ইয়াসমীন ছাড়া আর কাদের কথা বলবেন?
রুনা : এরপর সাবিনা ইয়াসমীন, রওশন আরা মুস্তাফিজ, আবিদা সুলতানা, মিতালি মুখার্জি-পরে মুম্বাই চলে যান, শাম্মী আখতারসহ আরও বেশ কয়েকজন আছেন। পুরুষদের মধ্যে মাহমুদুন নবী, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, সৈয়দ আবদুল হাদী, মোহাম্মদ খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর-এঁদের সবার সঙ্গেই কাজ করেছি। তরুণদের মধ্যে আগুনের সঙ্গে অনেক গান গেয়েছি। কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির সব গানই হিট হয়েছিল। এ ছাড়া আইয়ুব বাচ্চু, এস আই টুটুল, বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গেও গান করেছি।
মতিউর : আপনাকে নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কে যেন?
রুনা : ভারতের কয়েকজনই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন বি আর চোপড়া, রাজ কাপুর প্রমুখ। রাজ কাপুর সাহেব একবার ফোন করেছিলেন। তখন তো ট্রাঙ্ক-কল করতে হতো। হঠাৎ একদিন অপারেটর বলছে, আপনার একটা ট্রাঙ্ক-কল আছে। কোত্থেকে? বলছে, ‘বোম্বে থেকে।’ সে কথা বলতে পারছে না। বললাম, ফোন করেছে কে? বলে, ‘রাজ কাপুর! রাজ কাপুর সাহেব ফোন করেছেন!’ বলে সে হাঁপাচ্ছে-এতটাই উত্তেজিত ছিল। ভয়ে ভয়ে গিয়ে ফোন ধরলাম। বলছেন, ফোন করলাম আপনাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। বোম্বেতে আসেন। বললাম, আসব, কিন্তু কী ব্যাপারে! গান করাবেন? বললেন, গানও করবেন, আবার অন্য একটা আলাপও করব-সেটা ছবির ব্যাপারে। ঘটনাটা ঢাকায় আসার পর, তবে ১৯৭০-এর দশকেই। তাঁকে বললাম, ছবিতে তো অভিনয় করব না। তবে গান-টান হলে আসতে আপত্তি নেই। বলছেন, আসুন, আমার অতিথি হয়ে থাকবেন। আমার বাড়িতে থাকেন বা হোটেলে থাকেন, আপনি যেখানে থাকতে চান, থাকবেন। পরে আর যাওয়া হয়নি। তিনি কয়েকবারই আমাকে অভিনয়ের জন্য অনুরোধ করেছেন। পরেও দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে কিন্তু কাজ আর করা হয়নি।
মতিউর : একটা দারুণ পরিবার পৃথ্বীরাজ কাপুর, রাজ কাপুর, শাম্মি কাপুর, শশী কাপুর…। এঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
রুনা : শশী কাপুরের সঙ্গে ভালো খাতির ছিল। আসলে শশী কাপুর খুব পছন্দের ছিল ছোটবেলা থেকেই, যাকে বলে ক্রাশ! আমি ভাবিনি কখনো দেখা হবে। একবার ভারতে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানাল। এটাও ১৯৭০-এর দশকেই। ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড তখন তো বেশ বড় অ্যাওয়ার্ড। কারণ, তখন একটাই অ্যাওয়ার্ড ছিল। ওই অনুষ্ঠানে প্রথমে গান গাইলাম। এরপর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। আমি অতিথিদের সারিতে সামনে বসে আছি। সবাই সেখানে। অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না-যত সেলিব্রিটি আছেন, সবাই সামনের দর্শকসারিতে পাশাপাশি বসা। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো সেরা গায়ক কিশোর কুমার। তিনি দেশে নেই। তাঁর পুরস্কার গ্রহণ করবেন অশোক কুমার দাদামণি এবং পুরস্কারটি দেবেন রুনা লায়লা! এর মধ্যে শশী কাপুরসহ যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা মঞ্চে বসা। আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি, আমি পুরস্কার দেব! তবু উঠে গেলাম। দাদামণিকে পুরস্কারটি দিলাম। তিনি কিছু বললেন। এরপর যখন আমি মঞ্চ থেকে নেমে আসছি, হঠাৎ কে যেন আমার হাত ধরে টান দিল! ঘুরে দেখি শশী কাপুর! আমি তো ফিট হয়ে যাওয়ার অবস্থা! ভাবছি স্বপ্নের নায়ক কোত্থেকে! পেছন থেকে হাত ধরে টানছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। বললেন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বললাম, সিটে যাচ্ছি। না, না, আপনি আমাদের সঙ্গে মঞ্চে বসেন। বললাম, আপনারা তো পুরস্কার বিজয়ী, আমি তো না। আমি কেন বসব। বললেন, তাতে কিছু যায় আসে না, ‘চেয়ার লাও!’ পরে তাঁর পাশে বসালেন। আমি তো পাথর হয়ে গেলাম, নড়াচড়া করতে পারছি না, এমন অবস্থা! [হাসি] সেই স্বপ্নের মানুষ, এখন এত কাছে! এটা বিরাট ব্যাপার ছিল আমার জন্য।
মতিউর : রাজ কাপুর, শাম্মি কাপুর, শশী কাপুর…।
রুনা : শশী কাপুর তো এখন অসুস্থ। এখন তো পুরো হুইলচেয়ারে আবদ্ধ হয়ে গেছে।
মতিউর : আমি ওঁর খুব ভক্ত। মানুষ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবেও খুব ভালো।
রুনা : সবচেয়ে সুন্দর ছিলেন দেখতে। কাছ থেকে মনে হয় একদম বিদেশি। কী করে এত সুন্দর হতে পারেন একজন মানুষ! একবার আমি কানাডায় অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি। দেখি একই হোটেলে শর্মিলা ঠাকুর, শশী কাপুর, নাদিমসহ সবাই। শশী কাপুর তো খবর পেয়েই, ‘আ কাহাঁ সে রুনাজি, আইয়ে না, মিলতে হ্যায়, চায়ে পিতে হ্যায়।’
মতিউর : এভাবে ক্রাশ খেয়ে গেলেন, সে ব্যাপারে কিছু বললেন না যে, ছোটবেলা থেকেই…[হাসি]।
রুনা : মনে মনেই প্রেম ছিল। তবে বলতে আর সাহস হয়নি [হাসি]। একবার বোম্বে গেলাম অনুষ্ঠান করতে। তাজ হোটেলে উঠেছি। হঠাৎ ফোন করলেন শশী কাপুর, ‘কী করছেন?’ বললাম, ‘কিছু না, রুমেই আছি।’ বললেন, ‘নিচে লবিতে আসেন, চা খাই।’
মা আছেন আমার সঙ্গে। খুব ভয়ে ভয়ে বললাম, শশী কাপুর লবিতে অপেক্ষা করছেন। মা তো রেগে গেলেন, ‘একা কেন যাবে?’ বললাম, ‘লবিতে যাব তো, আর কোথাও যাব না।’ মা বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। বেশিক্ষণ বসবে না।’ তখনো তো বিয়ে হয়নি আমার। নিচে চা খাচ্ছি। একটা বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা রিলিজ হয়েছে বা হবে, সে উপলক্ষে একটা পার্টি ছিল। আমি দেখছি অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চনসহ সবাই ভেতরে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় অমিতাভ হাত নাড়ছেন শশী কাপুরকে দেখে। আর বলছেন, কী হচ্ছে! শশী অমিতাভকে বলছেন, ‘তোমরা একটু ম্যানেজ করো। আমি একটু পরে আসছি।’ অমিতাভ উত্তরে দিলেন, ‘তুমি যাও, আমি বসছি।’
মতিউর : অমিতাভের সঙ্গে পরে আর দেখা হয়েছিল?
রুনা : হয়েছিল। তাঁর অগ্নিপথ ছবিতে একটি গান করেছিলাম-লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের সুরে। ওই সময়ে দেখা হয়েছিল। ওটার যখন প্রিমিয়ার করা হলো কলকাতায়, তখন আমি সেখানে ছিলাম। সেখানে দেখা হয়েছে। খুব ব্যস্ত ছিলেন। খুব বেশি কথা হয়নি।
মতিউর : মুম্বাইতে কতগুলো সিনেমায় গান করেছেন?
রুনা : খুব বেশি না। সাত-আটটা ছবিতে গান করেছি।
মতিউর : কলকাতায় কোনো সিনেমায় গান করেছেন?
রুনা : কলকাতায় বেশ গান করেছি। গত বছরও একটা ছবিতে গান করেছি। ছবির নামটা ভুলে গেছি।
মতিউর : এই উপমহাদেশের বাইরে ইউরোপ-আমেরিকাসহ কতগুলো দেশে আপনি গান করেছেন? আপনার কোনো ধারণা আছে? আর বাইরে গান গাওয়ার সবচেয়ে ভালো স্মৃতি কোথায়-কেনেডি সেন্টার, অ্যালবার্ট হল, ম্যাডিসন স্কয়ার?
রুনা : প্রায় সব দেশেই গান করা হয়ে গেছে। রাশিয়াতেও গান করে এসেছি। লন্ডনের অ্যালবার্ট হলে বহুবার গান করেছি। উপমহাদেশের বাইরে প্রথম কনসার্টই ছিল আমার কেনেডি সেন্টারে। আপনি গেলে দেখতে পাবেন, আমার পোস্টারটা এখনো লাগানো আছে, এশীয় শিল্পীদের মধ্যে আমিই প্রথম সেখানে গান গেয়েছি। জিমি কার্টারের আসার কথা ছিল। তিনি আসতে পারেননি, তাঁর স্ত্রী আর তাঁর এক ছেলে এসেছিলেন। তাঁরা মঞ্চে এসে আবার আমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। বিশাল এক আয়োজন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার একবার বলছিলেন, ‘আমরা এমনিতেই গিয়েছিলাম কেনেডি সেন্টার দেখতে। সেখানে আপনার নাম দেখলাম।’ তাঁর মেয়ে তখন ওয়াশিংটন থাকত। এ ছাড়া নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার, লিংকন সেন্টারসহ বহু সম্মানজনক জায়গায় গান করেছি। গান করেছি ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামেও। এই স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল বাঙালিরা। ভারতীয় শিল্পীরাই ছিলেন। সেটা বিরাট আয়োজন ছিল। বার্মিংহাম এনইসি ইনডোর স্টেডিয়ামে গান করেছি। এরপর সিডনি অপেরা হাউসে গান করেছি তিনবার।
মতিউর : কাশ্মীরের কথা একটু আগে বললেন। এ রকম দেশের বাইরে আরও কোনো অনুষ্ঠান করেছেন, যেখানে সামাজিক ও কল্যাণকর কাজের জন্য তহবিল সংগ্রহের আয়োজন ছিল?
রুনা : অনেক জায়গায় করেছি। বাংলাদেশে, ভারতে, পাকিস্তানে-অনেক দেশেই দরিদ্র মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহে বিনা পারিশ্রমিকে গান করেছি।
মতিউর : সামাজিক দায়বোধ থেকে ভালো কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করার একটা প্রবণতা আপনার মধ্যে আছে।
রুনা : আমরা তো অটিস্টিক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুদের সংগঠন সুইড-বাংলাদেশ, রমনা ব্রাঞ্চের জন্য কাজ করি। আমি ও আলমগীর সাহেব দুজনই ওটার সঙ্গে যুক্ত আছি। ওদের তহবিল তৈরি করে দিয়েছি। অনেক শিল্পীই অনেক সহযোগিতা করেছেন সেখানে। নাটকের, নাচের, সিনেমার, গানের-সবাই মিলে আমরা অনুষ্ঠান করলাম। প্রতিটি স্পনসরকে আমি নিজে ফোন করে অনুদান নিয়েছি। অনেক টাকা উঠেছে। ওই টাকাগুলো এখন ফিক্সড ডিপোজিটে আছে। ওখান থেকে ওদের খরচ চালানো হয়। তারপর ইউএন-এআইডিতে আমরা দুজনই ছিলাম। চার বছর ধরে আমি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এইচআইভি-এইডস বিষয়ে সার্কের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর। সেখানে এইচআইভি আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করি। কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম দিল্লিতে। সেখানে ওদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। তারপর বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েছি, যেখানে এইডস-আক্রান্ত রোগীরা থাকেন, সেখানে গিয়েছি। তিন দিন ছিলাম। প্রতিদিন কোনো না কোনো সেন্টারে গিয়েছি। আমার মনে হয়, এগুলো আমাদের দায়িত্ব। আমরা এত পাচ্ছি মানুষের কাছ থেকে, তাদের তো কিছু দেওয়া উচিত, কিছু না-কিছু করা উচিত; যতটা সম্ভব। আমি মনে করি, যাদের সমাজে একটু গ্রহণযোগ্যতা আছে, তাদের এই কাজগুলো করা উচিত। কেননা, তাদের কথা মানুষ বেশি শোনে।
মতিউর : অনেকে করেন, অনেকে করেন না। আমরা আপনারটা জানি। আমরা খুব মূল্য দিই এর। আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ, আপনি নিজে থেকে এগুলো করেন।
রুনা : ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় মা-বাবা জিজ্ঞেস করতেন, বড় হয়ে কী করবে তুমি? বলতাম, বড় হলে অনেক টাকা আয় করব। সব টাকা দিয়ে গরিবদের খেলনা কিনে দেব। এটাই ছিল আমার স্বপ্ন। ওই স্বপ্নেরই খানিকটা পূরণ করার চেষ্টা করছি।
মতিউর : আমরা আবার গানের দিকে ফিরে যাই, আপনার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী কে?
রুনা : অনেকে। একটা নাম বলা যাবে না। লতাজি আছেন; আশাজি, ম্যাডাম নূরজাহানও প্রিয়। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার-এঁরা সবাই আমার প্রিয়। বাংলাদেশে ফিরোজা বেগম, ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম, আবদুল আলীম আরও অনেকে।
মতিউর : ইংরেজি গান যাঁরা করেন, এঁদের মধ্যে কে প্রিয়?
রুনা : সেলিন ডিওন; কয়েক বছর আগে যে মারা গেলেন হুইটনি হাউস্টন, যিনি ‘আই উইল অলওয়েজ লাভ ইউ’ গানটা গেয়েছেন। তাঁর মেয়ে ববি ব্রাউনও মারা গেল প্রায় একইভাবে। ইংরেজি গানের শিল্পীদের মধ্যে এঁদের গান ভালো লাগে। এ ছাড়া জনপ্রিয় গান গেয়েছেন শার্লি ব্যাসি।
মতিউর : শাকিরার গান কেমন লাগে?
রুনা : শাকিরার গানও ভালো লাগে।
মতিউর : আপনি আপনার জীবনে কাদের সেরা মানুষ মনে করেন? সেরা মানুষ হিসেবে কাদের দেখেছেন, শুনেছেন, জেনেছেন?
রুনা : আমার জন্য সেরা মানুষ আমার বাবা-মা। বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ ইমদাদ আলী আর মা আমিনা লায়লা। এরপর আমার বোন দীনা লায়লা। তিনি আমাকে অনেক সমর্থন-সহযোগিতা করেছেন। তাঁর কথা খুব মনে পড়ে। তিনি সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তবে আজকের রুনা লায়লা হওয়ার পেছনে একমাত্র অবদান আমার মায়ের। মা যদি লেগে না থাকতেন, আমি আজ হয়তো কিছুই হতাম না।
মতিউর : আপনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। আপনার প্রিয় লেখক কে বা কারা?
রুনা : এইন র‌্যান্ডের বই অনেক পড়েছি-একটু সিরিয়াস ধরনের বই আরকি। আবার গোয়েন্দা গল্পের বইও পড়েছি। সব ধরনের বই, সব ধরনের লেখকের বইই পড়ি। ওভাবে বাছাই করে পড়ি না।
মতিউর : গান রচয়িতাদের মধ্যে বাংলা, হিন্দি, উর্দু ভাষার কাকে কাকে পছন্দের শীর্ষে রাখবেন?
রুনা : হিন্দিতে গুলজার সাহেব। তিনি অবশ্য হিন্দি-উদু‌র্-দুটো ভাষাতেই লেখেন। পাকিস্তানের ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। আহমেদ ফরাজ-‘রনজিশ হি সহি’ গজলটা তাঁর লেখা। আর এখানে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, রফিকুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মনিরুজ্জামান মনির, কবির বকুল প্রমুখ। এ ছাড়া সৈয়দ শামসুল হক আছেন-অবশ্য তাঁর একটাই গান করেছি আমি।
মতিউর : জানতে আগ্রহ হয় সিনেমা পরিচালকদের মধ্যে কারা আপনার পছন্দের-হিন্দি ও উদু‌র্ ভাষায়?
রুনা : কঠিন প্রশ্ন। পাকিস্তানে হাসান তারেক, পারভেজ মালিক, সুলেইমান। মুম্বাইতে ঋষিকেশ মুখার্জি, বাসু চ্যাটার্জি প্রমুখ।
মতিউর : সংগীত পরিচালকদের মধ্যে কারা প্রিয়?
রুনা : পাকিস্তানে রবীন ঘোষ, নিসার বাজমে; মুম্বাইয়ে লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, মদন মোহন, জয়দেব, শঙ্কর জয় কিষাণ, বাপ্পী লাহিড়ী। বাংলাদেশের নামগুলো আগেই বলেছি।
মতিউর : আপনার গান গাওয়ার বয়স পঞ্চাশ তো বছর হয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর পরেও আপনার এত জনপ্রিয়তার কারণ বা ভিত্তিটা কী?
Runa-Laila2রুনা : জীবনের শুরুতে এত যে মেহনত করেছি, এত যে চেষ্টা করেছি, এত যে চর্চা করেছি, যেটা এখনো করে চলেছি, সেটার ফল এটা। আল্লাহরও বিরাট রহমত এটা। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবার দোয়া-আশীর্বাদ-ভালোবাসাও অনেক দূর নিয়ে গেছে। মা-বাবার দোয়া, আমার পুরো পরিবারের সমর্থন-অনুপ্রেরণা-এসবের কারণেই এখনো মানুষ আমাকে সমানভাবে গ্রহণ করেন।
মতিউর : আমি মনে করি একজন মানুষকে বড় হতে হলে তার ভেতরের মানুষটাকে অনেক বড় হতে হয়। যে তার সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ বজায় রাখে, যে মানুষকে সাহায্য করে, সে তার কাজেও বড় হয়। আপনি কী মনে করেন?
রুনা : আমি মনে করি, বড় হতে হলে একজন মানুষকে, সেটা শিল্পী হোক আর যেকোনো পেশারই হোক, তাকে প্রথমেই ভালো মানুষ হতে হবে। মনটা একদম নিষ্পাপ হতে হবে। তা না হলে হবে না। অন্যের প্রতি সহানুভূতি-মায়া-মমতা-দরদ থাকতেই হবে। এটা না থাকলে তো মানুষের ভেতরের শিল্পীও বেরোবে না।
মতিউর : একজন শিল্পীর দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থাকা দরকার। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রুনা : দেশের প্রতি অবশ্যই দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা থাকতে হবে। বিদেশে গেলে প্রথমেই বলি, রুনা লায়লা ফ্রম বাংলাদেশ। এটাই আমার পরিচয়। এভাবে আমার পরিচয় দিতে হবে। কারণ, আমি বাংলাদেশের শিল্পী, আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, মঞ্চে আমি বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে এসেছি। যেখানেই যাই, আমি এটাই করি। আমি মনে করি, এই বোধটা থাকতেই হবে।
মতিউর : যদি বলা যায়, এই দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে গান করলেন, আপনি কী পেলেন?
রুনা : অনেক কিছু পেয়েছি। জনপ্রিয়তা, স্বীকৃতি, সম্মান, ভালোবাসা, দোয়া-এটাই তো পরম পাওয়া।
মতিউর : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
রুনা : যেভাবে কাজ করছি, সেটা ধরে রাখতে চাই। চেষ্টা করব নতুন কিছু করার। একটা কথা আছে, ম্যানি মোর মাউন্টেনস টু ক্লাইম্ব।
মতিউর : কোনটাকে বড় করে দেখেন-জনপ্রিয়তা, মানুষের ভালোবাসা, না জাতীয় পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার বা এ রকম কিছু?
রুনা: স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া বা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া অবশ্যই আলাদা সম্মান; যেহেতু এটা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তবে মানুষের ভালোবাসা ছাড়া আজ এই জায়গায় আসতে পারতাম না। আমি রুনা লায়লা হতে পারতাম না।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

এ জাতীয় আরো খবর
© All rights reserved © 2020 Dailycoxsbazar
Theme Customized BY Media Text Communications