শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় বন্ধুদের নিয়ে ভরপেট খাওয়া-দাওয়ার পর বিল হলো ২৮০০ টাকা। সাথে সরকারের কোষাগারের জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট ৪২০ টাকা। মোট ৩২২০ টাকা বিল দেওয়া হলেও ভ্যাটের টাকা সরকার পাবে না, কারণ ভুল করে এনবিআরের দেওয়া মূসকের চালান কপি নেয়নি ক্রেতা। আর এতে করে ভ্যাটের ১৫ আনাই থেকে যাচ্ছে মালিকের পকেটে। দেখা গেল ভ্যাটের নাম করে নেওয়া বাকি এক আনা টাকা মাসোহারা বাবদ খরচা করতেই হয়ে যাচ্ছে কার্যোদ্ধার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এনবিআর-এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং রেস্তোরাঁ মালিকদের যোগসাজশে ভ্যাটের টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে না। বিনিময়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের জন্য আছে মাসোহারার ব্যবস্থা। ভ্যাট যা আসে তার চেয়ে ঢের কম টাকায় কর্মকর্তাদের সাথে ‘সেটেলমেন্ট’ হয়ে যায়।
রিসালাত বারী নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি সম্প্রতি ইয়েলো সাবমেরিন ক্যাফের বনানী শাখায় গিয়েছিলেন খেতে। খাবার খাওয়ার পর গোল বাঁধলো দাম পরিশোধ করতে গিয়ে। রেস্তোরাঁ থেকে একটি কম্পিউটারাইজড বিলের কপিতে ১৫ শতাংশ হারে ৬৬.৫৩ টাকা ভ্যাট ধার্য করে। কিন্তু ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নম্বরের জায়গায় লেখা- SDFGHJKLSADASDASD ASDASD যা প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন নম্বর নয়। চালানের কপি চাইলে রেস্তোরাঁর কর্তৃপক্ষ যেন আকাশ থেকে পড়ে।
এ অভিজ্ঞতার বিবরণ জেনে প্রতিবেদক ওই ক্যাফেতে গিয়ে কেন চালান কপি দিতে পারছেন না জানতে চাইলে ম্যানেজার বলেন তারা ভ্যাট রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেছেন কিন্তু এখনও নম্বর পাননি। তাহলে ভ্যাট বাবদ নেওয়া টাকাটা কোথায় যাচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেন কয়দিন পর পর এনবিআর-এ গিয়ে ভ্যাটের টাকা দিয়ে আসেন। এর ভিত্তি কী, কেন টাকা দেন? এমন প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে পাওয়া যায়নি।
নামিদামি রেস্টুরেন্টে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) থাকে। তাতে ছাপানো ক্যাশমেমোতে লেখা থাকে ভ্যাটের পরিমাণ। এতে ভোক্তা সন্তুষ্ট হলেও ওই ইসিআর আসলে একটি ভাউচার প্রিন্টার ছাড়া কিছুই নয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট-এর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মান। তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশের সকল ইসিআর একটি অনলাইন নেটওয়ার্কে সংযুক্ত। ইসিআরে ভ্যাটের যে টাকা প্রিন্ট হবে সেই টাকা সরকারের খাতায় লেখা হয়ে যাবে এবং সরকার তা আদায় করতে পারবে। আমাদের এখানে এ ব্যবস্থা নেই। বিকল্প হিসেবে এখানে এনবিআর একটি ভ্যাট চালান বই দিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা ভেজাল খাদ্যবিরোধী মোবাইল কোর্ট করেন। তারা যদি ভ্যাট চালান বই রাখা ও ক্রেতাকে তা প্রদানের বিষয়টিও দেখে তাহলে সরকারের কোষাগারে কিছু টাকা আসবে। এ ছাড়া ইসিআর নেটওয়ার্ক স্থাপন করাও জরুরি।
ভ্যাট ফাঁকি প্রতিরোধে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। ‘ভ্যাট চেকার’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপস রয়েছে, যা দিয়ে মুহূর্তে এনবিআর থেকে ভ্যাট চালানের তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত থাকায় বিষয়টির সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ভোক্তার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে যখন, তখন সেটা সরকারকে দিতে আপত্তি কোথায়? তিনি আরও বলেন, সরকার ২০০৬ সালে ইসিআর বাধ্যতামূলক করেছিল। যদিও বাস্তবায়নের দিকে নজরদারির অভাবে সে উদ্যোগে ভাটা পড়ে।
ধানমণ্ডির রেস্তোরাঁ সই’তে এ প্রতিবেদকের সামনে মাহমুদুল হক নামের এক ভোক্তা চালানের কপি চান। পরে তাকে নীল রঙের চালান কাগজে বিল লিখে দেওয়া হয়। মাহমুদুল বলেন, আমরা আসলে সংকোচ আর চক্ষুলজ্জায় কিছু বলি না। কিন্তু চালানের কপি চাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা স্বেচ্ছায় জিনিসটা দিতে শুরু করে।
তিনি আরও বলেন, অভ্যাসটা এমন দাঁড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা ভ্যাট না দেওয়াকে অধিকার বলে মনে করছে। অন্যদিকে চালানপত্র চাওয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ করাটাও অমূলক। ভ্যাট আপনি দিচ্ছেন সরকারকে, এর সাথে দোকানের কোনও সম্পর্ক নেই।
রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরের রেস্তোরাঁ রেড টমেটোতে চালান চেয়ে দীর্ঘসময় তর্ক করতে দেখা যায় ভোক্তা আরিফ রহমানকে। প্রায় আধাঘণ্টা তর্কের পর তাকে চালানের কাগজ দেওয়া হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে করা আয়ের টাকা থেকে প্রতিনিয়ত সরকারকে ভ্যাট দিচ্ছি, কিন্তু সে টাকা সরকার পর্যন্ত যাচ্ছেই না! ব্যবসায়ী ধনী হচ্ছে, বিপরীতে দেশ গরিব হচ্ছে, এটা হতে পারে না ।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এক হিসাব মতে ঢাকায় দিনে ভ্যাটযোগ্য যত পণ্য বিক্রি হয় তা থেকে সরকারের দিনে আয় হওয়ার কথা ১৫০ কোটি টাকা। যদিও সরকার এই টাকার খুব নগণ্য অংশই কোষাগারে নিতে পারে। দক্ষ মনিটরিং আর কিছু অসৎ লোক মাসোহারার কারণেই তা হয় না বলে জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, আমরা যদি ভ্যাটের ১৫ শতাংশ ঘরে আনতে না পারি তাহলে সেটা না নেওয়াই উচিত। কেননা ভোক্তা টাকাটা দিচ্ছে আর কিছু অসাধু মানুষ সেটা সরকারকে দেব বলে নিজের পকেটে নিচ্ছে। এই দুর্নীতি বন্ধ হওয়া জরুরি।
এনবিআর সদস্য এনায়েত হোসেইন (ভ্যাট ইপ্লিমেন্টেশন) বলেন, ভ্যাট চালান না দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কেউ যদি না দিতে চায় তাহলে সেটা চেয়ে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি এবং পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।