তাঁকে পছন্দ করুন আর না করুন, এটা মানতে হবে, গোলপোস্টের সামনে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো একজন ভয়ংকর, নির্মম শিকারি। উসাইন বোল্টের গতিতে দু-তিন ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলার পর প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের আত্মা শুকিয়ে দেওয়া শটে বল জালে জড়িয়ে দিচ্ছেন রোনালদো—রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচে এটা বেশ নিয়মিত দৃশ্য। ‘গোলস্কোরিং মেশিন’—নামটাকেও প্রতিদিনই নতুন অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফুল হয়ে ফুটেছিলেন, সৌরভ ছড়িয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে এসে। খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিদিনই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। সঙ্গে নিয়ম করে ‘ছোট্ট’ একটা কাজ করে যাচ্ছেন—একের পর এক রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছেন। প্রিমিয়ার লিগ হোক আর স্প্যানিশ লিগ, কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগ বা আন্তর্জাতিক মঞ্চ, রোনালদোর নামের পাশে অবিশ্বাস্য কিছু সংখ্যা ছাড়া যেন কোনো রেকর্ড বই-ই পূর্ণ হয় না।
রেকর্ডের ক্ষেত্রে যে ক্লিশে বাক্যটা ব্যবহার করা হয়, ‘গড়াই হয় ভাঙার জন্য’, সেটির আওতা থেকে রোনালদোর রেকর্ডগুলোও বাদ যাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে এর মধ্যেও কিছু রেকর্ড থাকে, আরও একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি বা নেইমার না আসা পর্যন্ত যেগুলোকে নিরাপদ বলা যায়। রোনালদোর এমন পাঁচটি রেকর্ডে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক –
রিয়াল মাদ্রিদের সর্বোচ্চ গোলদাতা: ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’—রিয়ালে রোনালদোর স্বপ্নযাত্রাকে এর চেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। ২০০৯ সালে সে সময়ের দলবদলের রেকর্ড গড়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রিয়ালে আসার পর থেকে লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগ আর কোপা দেল রের দলগুলোকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছেন ‘সিআরসেভেন’। সঙ্গে নিজের গোলের রেকর্ডটাকে জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে নিচ্ছেন।
রিয়ালে রাউলের ৩২৩ গোলের যে রেকর্ডটাকে এক সময় ‘ভাঙতে অনেক কষ্ট হবে’ মনে হচ্ছিল, সেটিকে মাত্র ছয় মৌসুমেই কেমন অবলীলায় টপকে গেলেন রোনালদো! এরই মধ্যে ৩৩৮ গোল হয়ে গেছে পর্তুগিজ অধিনায়কের, অথচ ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ৩২৪টি! ম্যাচপ্রতি গোলের হার ১টির বেশি! সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় সেরা পাঁচে থাকা আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (৩০৮ গোল), কার্লোস সান্তিলানা (২৮৯) কিংবা ফেরেঙ্ক পুসকাসের (২৪২) মতো কিংবদন্তিদেরও নেই এমন রেকর্ড।
উয়েফার বর্ষসেরা দলে সবচেয়ে বেশিবার মনোনীত: চ্যাম্পিয়নস লিগ ‘মাত্র’ দুবার জিতেছেন—২০০৮ এ ইউনাইটেডের হয়ে আর ২০১৪ তে রিয়াল মাদ্রিদে। কিন্তু উয়েফার বর্ষসেরা দলে ২০০৭ থেকেই নিয়মিত রোনালদো।
উয়েফা আয়োজিত ক্লাব ও দেশের প্রতিযোগিতাগুলোতে ভালো পারফরম্যান্স করলেই একজন খেলোয়াড় এই দলে নির্বাচিত হতে পারেন। ২০০৪ এ পর্তুগালের হয়ে ইউরোতে ভালো খেলে প্রথম এই দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন রোনালদো। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৯ বার—বলা বাহুল্য, আর কোনো খেলোয়াড় এর চেয়ে বেশিবার নির্বাচিত হননি। এর চেয়েও বড় ব্যাপার, ২০০৭ থেকে ২০১৪—টানা ৮ বারই উয়েফার বর্ষসেরা দলে ছিলেন ‘সি রন’।
একটানা মৌসুমে ৫০+ গোল: রিয়ালে তাঁর প্রথম মৌসুমে ‘৯’ নম্বর জার্সি পরে খেলতে হয়েছিল বলেই কিনা একটু মিইয়ে ছিলেন। সব মিলিয়ে ‘মাত্র’ ৩৩ গোল করেছিলেন। সঙ্গে নতুন লিগ, নতুন পরিবেশ খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি তো ছিলই। দ্বিতীয় মৌসুমে রাউল জার্মান ক্লাব শালকেতে চলে যাওয়ার পর প্রিয় ‘৭’ নম্বর জার্সিটি ফিরে পান রোনালদো। ব্যাস, আর কী চাই! প্রতি মৌসুমেই গোলের ‘ফিফটি’! ২০১০/১১ থেকে ২০১৪/১৫—টানা ৫ মৌসুমে ৫০ গোলের মাইলফলক পেরিয়েছেন রোনালদো। এখানে তাঁকে ‘ধাওয়া’ করছেন কে বেশ ভালোভাবেই বোঝার কথা—মেসি। ২০১৩/১৪ মৌসুমে ৪১ গোল করায় ছেদ পড়ে গেছে বার্সেলোনা ফরোয়ার্ডের, তা না হলে তিনিও এই পাঁচ মৌসুমের চারটিতে গোলের ‘৫০’ পূরণ করেছেন।
ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শ্যু পুরস্কার: ইউরোপের ঘরোয়া লিগগুলো মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও সবচেয়ে বেশিবার তাঁরই—এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৪ বার ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শ্যু জিতেছেন পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড। ইউনাইটেডে থাকার সময়ে একবার (২০০৭/০৮), আর রিয়ালে তিনবার (২০১০/১১, ২০১৩/১৪ ও ২০১৪/১৫)। দুই বছর আগের (২০১৩/১৪) পুরস্কারটি অবশ্য সে সময়ের লিভারপুল স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছিল। এখানেও তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মেসিই, তিনি সোনালি জুতোটি জিতেছেন ৩ বার (২০০৯/১০, ২০১১/১২, ২০১২/১৩)।
পর্তুগালের সর্বোচ্চ গোলদাতা: যদিও ক্লাবের মতো জাতীয় দলের হয়ে সফল হতে পারেন না বলে একটা বদনাম আছে তাঁর। তবে রোনালদো সমালোচকদের ঠিকই এই রেকর্ডটা দেখিয়ে বলতে পারেন ‘দেখো, আমি ঠিকই চেষ্টা করি, সতীর্থরা আমার মানের নয় বলেই হয় না!’ পর্তুগালের হয়ে ১২৩ ম্যাচে এরই মধ্যে ৫৫ গোল হয়ে গেছে তাঁর। আর কোনো খেলোয়াড়ই পর্তুগালের জার্সিতে ৫০ গোল করতে পারেননি। দেশটিকে কেন শুধু ’৬৬ বিশ্বকাপে তৃতীয় আর ’০৪ ইউরোতে রানার্সআপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, সেটি এখান থেকেও বুঝে নিতে পারেন।