রাশেদুল মজিদ : আইনে নিষিদ্ধ নোট-গাইড-সহায়ক বই বিক্রি চলছে দেদারছে। এছাড়া নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার মানহীন বই বাজারজাত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে কক্সবাজার শহরের রহমানিয়া লাইব্রেরী, মোহাম্মদীয়া লাইব্রেরী, বুকভিলা, বিদ্যাসাগরসহ বেশ কয়েকটি লাইব্রেরী বিভিন্ন ভুঁইফোড় প্রকাশনী সংস্থার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মানহীন বই বাজারজাতে নেমে পড়েছে। এর অংশ হিসেবে এসব লাইব্রেরী কক্সবাজারের পুরো জেলার অর্ধসহ¯্রাধিক কিন্ডার গার্টেন (কেজি) স্কুল প্রধানের সাথে চুক্তি করে তাদের বই শিক্ষার্থীদের উচ্চ মূল্যে কিনতে বাধ্য করছে। একদিকে এসব মানহীন বই নিজেদের ইচ্ছেমতো পাঠ্য তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করে শিক্ষার্থীদের উচ্চ মূল্যে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে, অন্যদিকে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই সহায়ক বই হিসেবে উচ্চ মূল্যে শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রশাসনের নজরদারী না থাকায় এসব প্রকাশনী সংস্থা, লাইব্রেরী ও স্কুল প্রধানরা সিন্ডিকেট করে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এসব লাইব্রেরী লাখ লাখ বই বিভিন্ন গুদামে মজুদ করেছে। অথচ গেল বছর নিষিদ্ধ ও মানহীন বই বিক্রির অভিযোগে বুকভিলার মালিককে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। বই জব্দ করা হয়েছিল বুকভিলা, রহমানিয়া লাইব্রেরী ও মোহাম্মদীয়া লাইব্রেরীর। এর পরও চলছে তাদের অবৈধ ও প্রতারণামূলক ব্যবসা।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন গতকাল রাতে সকালের কক্সবাজারকে বলেন, ‘জনবল সংকটের কারণে অভিযান চালানো যাচ্ছে না। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে দ্রুত অভিযান চালিয়ে তা বন্ধ করা হবে।’
সরেজমিন কক্সবাজার শহরের মোহাম্মদিয়া, রহমানিয়া, বুকভিলা, বিদ্যাসাগরসহ বেশ কয়েকটি লাইব্রেরী ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারেও পাঞ্জেরী গাইড, লেকচার পাবলিকেশন্স, জুপিটার, অনুপম, নবদূত, আলোড়ন, আদিল, দিকদর্শন প্রকাশনী, গ্যালাক্সি, ইন্টারনেট, বর্ণমালা, পপি, অরবিট, নব পুঁথিঘর, কাজল, দিগন্ত, ক¤িপউটার, নিউ লেকচার, সাইমুম, আল ফাতাহ, আল বারাকা, আল আরাফা, নেপচুনসহ নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার গাইড-নোট-সহায়ক বই লাইব্রেরীগুলোতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে শহরের প্রধান সড়কের ফজল মার্কেটের সামনে মোহাম্মদিয়া লাইব্রেরী, রক্ষিত মার্কেটে রহমানিয়া লাইব্রেরী, বিদ্যাসাগর লাইব্রেরী ও লালদিঘীর পশ্চিমপাশে প্রধান সড়কের বুকভিলা লাইব্রেরীতে। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বই সরবরাহ করা হচ্ছে গ্রামে-গঞ্জে। মানহীন এসব বই বিক্রি চলছে ধুমধামের সাথে।
সূত্র জানিয়েছে- কক্সবাজার, চট্রগ্রাম ও ঢাকা ভিত্তিক নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান প্রতি বছরের মত এবারও তাদের নিম্নমানের নোট-গাইড, বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা, ইংরেজি র্যাপিড, সাধারণ জ্ঞান, একের ভেতর তিন ও ওয়ার্ড বুকসহ বিভিন্ন সহায়ক বই স্কুলে তালিকা ভূক্ত করানোর পর বিক্রির জন্য লাইব্রেরী ও এলাকা ভিত্তিক এজেন্ট নিয়োগ করেছে। মূলত: লাইব্রেরী ও এজেন্টরাই সমিতির নেতাদের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সাথে সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন স্কুলে বই’র (স্যাম্পল) সৌজন্য কপি সরবরাহ করেছে। সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ও মানহীন সহায়ক বই বিক্রি করতে বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থার প্রতিনিধি ও লাইব্রেরী প্রতিনিধিরা মোটা অংকের টাকা নিয়ে কক্সবাজার জেলার অর্ধসহ¯্রাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। আগাম লেনদেনের মাধ্যমে স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন মোহাম্মদীয়া, রহমানিয়া, বুকভিলা, বিদ্যাসাগরসহ বেশ কয়েকটি চুক্তিবদ্ধ লাইব্রেরীর টোকেন। ওই সব লাইব্রেরী ছাড়া অন্য কোথাও এসব বই পাওয়া যায় না। এমনকি লাইব্রেরীগুলোর নির্দিষ্ট দামেই কিনতে হয় এসব মানহীন বই। এভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে লাইব্রেরী ও প্রকাশনী সংস্থাগুলো। বর্তমানে কক্সবাজার শহরের বইয়ের দোকানগুলোতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ও এনসিটিবি’র অনুমোদন বিহীন সহায়ক পাঠ্য পুস্তকের অবৈধ মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে। এসব বই শহর ও জেলার প্রত্যান্ত অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রির জন্য প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে জোর তৎপরতা চলছে। অথচ ২য় শ্রেনী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই সহ এনসিটিবি’র অনুমোদন বিহীন সহায়ক পাঠ্য পুস্তক মুদ্রণ, মজুদ ও কেনা-বেচা প্রতিরোধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রতি সরকারের নির্দেশ রয়েছে। সরকার ২য় শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত সকল নোট, গাইডসহ সহায়ক নিম্নমানের বই প্রকাশ, বিতরণ এবং ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও কক্সবাজারে তা দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। ফলে নোট-গাইড বই সহ এনসিটিবি’র অনুমোদনবিহীন বই নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
শহরের পাহাড়তলীর রফিকুল ইসলাম জানান, তাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ রহমানিয়া লাইব্রেরীর একটি টোকেন ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন এসব বই পাওয়া যাবে ওই লাইব্রেরীতেই। শহরের ঘোনারপাড়ার শাহেনা আক্তার বলেন, আমার সন্তান ৫ম শ্রেনীতে পড়ছে। ফি বছরই স্কুলের দেয়া টোকেন নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট লাইব্রেরী থেকেই নির্দিষ্ট করে দেয়া বই কিনছি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুস্তক বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রহমানিয়া লাইব্রেরীর মালিক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্টানের শিক্ষার্থীদের চাহিদার ভিত্তিতেই আমরা বই বিক্রি করছি। প্রকাশনী সংস্থা এসব বই প্রকাশ্যে আমাদের কাছে বাজারজাত করছে। এছাড়া এসব বিষয়ে আমাদের সভাপতি সব জানেন।’ এ বিষয়ে জানতে মোহাম্মদীয়া লাইব্রেরী ও পুস্তক বিক্রেতা সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক এর মোবাইল ফোনে গত তিন দিন ধরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।