শিক্ষকের প্রতিকৃতি বলতে আমার সামনে মূর্ত হয়ে উঠেন বাবু বীরেন্দ্র চন্দ্র কাব্য তীর্থ। তিনি আমার বাবা’র শিক্ষক। আমারও শিক্ষক তিনি। যতীন্দ্র মোহন বাগচী’র বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, কবিতাটি আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন। যখন আমি শিশু শ্রেণিতে পড়ি। মৃত্যুর পর তার নাম জেনেছি। জানতাম পণ্ডিত স্যার বলে। তিনি দশ গ্রামের জনপ্রিয় পণ্ডিত স্যার ছিলেন। তার ছাত্রদের কেউ কেউ তখনই দেশ-বিদেশের আলোকিত মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বাররাও তার ছাত্র ছিলেন। যারা হয়তো স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাশালীও। ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পণ্ডিত স্যার দর্শক আসনে বসতেন, আর ছাত্রদের কেউ মঞ্চে।এতে বিব্রত হতেননা পন্ডিত মশাই। কারণ ছাত্ররা তার যেরূপ সম্মান প্রাপ্য, সেই ষোল আনাই পেতেন।
পণ্ডিত স্যার,বৈষয়িক ছিলেন না। জ্ঞান বিতরণ এবং আলোকিত মানুষ তৈরি করাই ছিল তার ব্রত। একথা সত্য সেসময় পণ্ডিত স্যারকে মুক্তবাজার অর্থনীতির মুখে পড়তে হয়নি। সমাজে ভোগবাদ এই পর্যায়ে পৌঁছেনি। পৌঁছলেও তিনি যে কোচিং সেন্টারে দৌড়াতেন না বাড়তি রোজগারের জন্য, তা আমি সকল দিব্যি দিয়ে বলতে পারি।
তবে একথাও সত্য জীবন যাত্রার ব্যয় এখন যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে ভোগের সমুদ্রে ঝাঁপ না দিলেও শিক্ষকদের সচ্ছলভাবে জীবন নির্বাহ করা কঠিন। প্রাথমিক, মাধ্যমিকের যারা কোচিং বাণিজ্যতে নেই, তাদের জীবন দারিদ্রসীমা বরাবর প্রায়। বিশেষ করে যারা প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক তাদেরতো বটেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা দারিদ্রসীমার নিচে। কলেজের শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্যের পথ না ধরলে নিম্ন মধ্যবিত্ত টিকিয়ে রাখা মুশকিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত কোঠায় টিকে থাকতে লড়াই করে যেতে হয়। শিক্ষকরা আর্থিক স্বচ্ছলতা নিয়ে বিচলিত হলে পাঠদিনে মনোসংযোগ করবেন কীভাবে? এছাড়া শিক্ষক কেন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করবেন? তাই সরকার শিক্ষকদের জন্য যে বেতন কাঠামো তৈরি করেছে, তাতে সন্তুষ্ট আমি। শিক্ষকদের আরও বাড়তি বেতন দিলে সমাজ ও রাষ্ট্রেরই লাভ। তবে তাদের অবশ্যই শিক্ষক হতে হবে।
শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন যারা তাদের কতজন আসলে শিক্ষক হতে এসেছেন? জ্ঞান বিতরণ কতজনের ব্রত,কতজন নিজেকে পুর্ণাঙ্গ শিক্ষক ভাবছেন? এই প্রশ্নের মীমাংসা প্রয়োজন। শ্রেণিকক্ষে এসে পাঠদানের বদলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে যাবার উস্কানি, কোচিং না করলে পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া যাদের এখন ধর্ম, তাদের কি শিক্ষক বলে সম্মানিত করতে পারি?
এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রসঙ্গে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক হবার পরেও তাদের কাঙ্গালপনা আমলা হবার। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমলা ছাত্রটির পাশে বসার সুযোগ নেওয়ার। যারা এই দাবিতে সোচ্চার তাদেরকেই দেখি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌঁড়াচ্ছেন। এনজিওর ছুটা কাজ করতে প্রান উৎসর্গ করে দিচ্ছেন মধ্যরাত অবধি টকশোতে জাতির ডিজিটাল ক্লাস নিচ্ছেন। মিডিয়া তাকে তুলে আনতে ছোট না বড় গাড়ি পাঠাচ্ছে, সেই মাপ নিচ্ছে,আর ভাবছে ক্ষমতার কত কাছাকাছি যাওয়া গেলো।
আমি তাদের শিক্ষক ভেবে কী করে নত হই। তবে আমি বিশ্বাস করি এবং জানি এরাই আমাদের শিক্ষক সমাজের প্রতিরূপ নন বা প্রতিনিধিত্ব করছেন না। আমাদের শিক্ষকরা আছেন, তারা নিস্বার্থে জ্ঞান বিতরন করছেন বাবু বীরেন্দ্র কাব্য তীর্থের মতোই। আমলার সমতুল্য হবার ব্যাকুলতা নেই তাদের এই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই রাষ্ট্রের কাছে আবেদন,প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়,সব স্তরের শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন কাঠামো তৈরি হোক।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি