প্রান্তজন :
সাংবাদিকতায় বন্ধুর পথ পাড়ি অগ্রযাত্রা অব্যহত রয়েছে তা আজ নতুন করে বলার কিছু নেই। বলা হয় সাংবাদিকতা পেশার মাধ্যমে জনগনের ও সমাজের দর্পন হিসেবে কাজ করা যায়। কিন্তু এ কাজটি করতে গিয়ে জিবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই হারিয়েছেন প্রান। এবং রাষ্ট্র তার সঠিক বিচার করতে অক্ষম হয়েছে এমনকি খুনীদের খুঁজে বের করতেও ব্যর্থতার কালিমা নিয়ে আছে। যার একটি প্রকৃত উদাহরন সাংবাদিক দম্পতি সাগর- রুনি হত্যকান্ড।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতের কোনও এক সময় পশ্চিম রাজাবাজারের একটি ভাড়া বাসায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে চার বছর পার হলেও এই মামলার তদন্তে কোনও অগ্রগতি নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডটি ‘সবোর্চ্চ গুরুত্ব’ দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র উল্টো। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হলেও খুনিরা এখনও রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বলা যায়, অনেকটা অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
তাদের হত্যাকান্ডের পরবর্তীতে বহু সময়ের আবর্তনে অনেক স্রোত বয়ে গেলেও এখনো প্রকৃত খুনীদের বের করার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আছে। একটি দেশের সার্বিক উন্নতির পিছনে সবচেয়ে বেশি যাদের অবদান তারাই যখন নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয় তাহলে কিভাবে মুক্ত মনে জনগনের নিকট সঠিক ও এবং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করবে। এ পর্যন্ত আমাদের দেশের সাংবাদিকরা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, ধর্ম কিংবা কখনো কখনো রাষ্ট্রের হয়রানীর শিকার হয়েছে। সংবাদ পত্রের ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশের অতীত সরকাগুলো বার বার ব্যর্থ হয়েছে।
এটি কেবল উদাসীনতা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক সাংবাদিকগন রোষানলের শিকার হয়ে থাকার কারনে সাংবাদিকতা সময়ের পালাবদলে ঝুঁকির পেশা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যম কর্তৃক নির্যাতিত এবং লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় তার সুষ্ঠু বিচার এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন না করায় সাংবাদিকতার মাধ্যমকে একটি সুষ্ঠু এবং নিরাপত্তা প্রদানে রাষ্ট্র বারংবার ব্যর্থ হওয়ার ফলাফল হিসেবে সাংবাদিকদের উপর হামলা হরহামেশাই হচ্ছে। এমটাই মনে করেন আক্রান্তরা।
সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদকসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদি হয়ে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করেছে। এই পোর্টালের সম্পাদকক গ্রেফতারও করা হয়েছে। এর আগে টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসায়িরা ৫ সাংবাদিকের উপর নগ্ন হামলা চালিয়ে ছিল। এ থেকেই বুঝা যায় সাংবাদিককে, সংবাদপত্র বা মিডিয়ার কন্ঠ চেপে ধরে রাখতে চায় এবং সে অনুযায়ী সাংবাদিকদের উপর হামলা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে বেসরকারী টিভি চ্যানেল এর চেয়ারম্যান, পত্রিকার সম্পাদকসহ বিভিন্ন সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার এর ন্যাক্কারজনক ঘটনা সাংবাকিতার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আমাদেরকে এবং আমাদের জাতির বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সাংবাদিকতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরনে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি এবং এর দায়বার কার? এটা নিশ্চই আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে সাংবাদিকতার উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অশনী সংকেত। সাংবাদিকতায় কোন দলমত নির্বিশেষে কাজ করে যেতে হবে, সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জনগনের নিকট পৌঁছে দেওয়া রীতিমত বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। জ্ঞানীরা বলেছেন বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।
সাংবাদিকতা জীবনে এই কথাটা আমার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। অর্থ ,সম্পদ ,গোলাবারুদ ও জনশক্তি নিয়ে হয়তো যে কোন একটি যুদ্ধে জড়ানো যায় কিন্তু সত্যিকারভাবে বিজয় ছিনিয়ে আনা যায় না। কিন্তু যে যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার সত্যর পক্ষের কলম সে যুদ্ধে বিলম্ব হলেও বিজয় অনিবার্য। সত্যের পক্ষের হাতিয়ার খুব কম হলেও সে হাতিয়ারগুলোর ক্ষুরধার অতি তীক্ষ্ন। তাই কলম দিয়ে যে যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয় সেখানে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হলে সৎ সাহস আর উপযুক্ত প্রজ্ঞার মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। যারা কলম নিয়ে যুদ্ধ করে তাদের এ বিষয়টি উপলব্দি করা খুবই গুরুত্বপূর্ন ।
কলম যোদ্ধা যার লৌকিক নাম সাংবাদিকতা, এই হাতিয়ার যার কাছে থাকবে সে অনেক শক্তিশালী; যদি সে সত্যের পক্ষে তার হাতিয়ার ব্যবহার করতে জানে। তলোয়ার সবাই চিনে কিন্তু তলোয়ার সবাই চালাতে পারে না , সাংবাদিকতা কি তা সবাই কমবেশি জানে তবে এটা কিভাবে পরিচালিত করতে হয় অর্থাৎ এই হাতিয়ার কিভাবে চালাতে হয় তা না জানলে নিজের আঘাতে নিজেই হতাহত হতে হয়। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে, আগুন হাতে নিয়ে রাখাটা যতটা কষ্টের তার চেয়ে অধিক কঠিন বিষয় সত্যর পক্ষে আর অন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান করে কলম চালানো বা সাংবাদিকতা করা।
ছোটবেলায় জানতাম যে লোক তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানে সেই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান। প্রশ্নগুলো একদিকে যেমন হাস্যকর অপরদিকে জ্ঞানগর্ভমূলকতার পরিচয় বহন করে।
সেগুলো হলো- এ দুনয়িায় আওয়াজ বড় কার? পেট বড় কার ? এবং প্যাঁচ বড় কার?। আসমান, জমিন এবং কলম এই উত্তরগুলোর মাঝেই পৃথিবীর সব রহস্য লুকিয়ে আছে। এই উত্তরগুলোর কার্যকারিতা আজ সাংবাদিকতার কলম ধরেই বুঝতে পারছি।
আমাদের কলম সৈনিক যারা আছেন তাদের প্রথমে জানা উচিত যুদ্ধের শুরুর প্রস্তুতি পর্ব সারবেন কিভাবে? কিভাবে এবং কোন কৌশলে সাংবাদিকতার দায়িত্ব হাতে নিয়ে আপনি যুদ্ধে নামবেন । কেননা একটি যুদ্ধের বিজয় নির্ভর করে তার পূর্বপরিকল্পনার উপর এবং আমাদের জানতে হবে ও বুঝতে হবে সাংবাদিকতার আসল দায়িত্ব কর্তব্য কি? যখন একজন মানুষ সাংবাদিকতার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেয় তখন তার উপর একটা সমাজের অনেক কিছুই নির্ভর করে।
তার লেখনী শক্তির মাধ্যমে তিনি একটি সমাজকে আলোকিত করে নিতে পারেন। একটি সমাজকে শোষনমুক্ত করতে পারেন, পারেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ।
আলোকিত করার সুযোগ করে দিতে পারেন একটি গোষ্টিকে ও দেশকে । কেননা একজন সাংবাদিক যেমন একটি সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে তাই তার পথ চলা খুবই বন্ধুর হবে। এটাই স্বাভাবিক । একটি সুস্থ্য সমাজের দর্পন হিসেবে একজন সাংবাদিকের ভুমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি একজন সাংবাদিক তাই আমার জ্ঞানের পরিধি এবং জানার পরিধি থাকা উচিত সবচেয়ে বেশি। তাই আমি যদি সাংবাদিক হই আমাকে জানতে হবে প্রচুর। কেননা এ কথা আমরা সবাই জানি যে কাজ একজন মন্ত্রী আমলা করতে ব্যর্থ হয় সে কাজ একজন সাংবাদিক তার সৎ সাহস ও মেধা দিয়ে করতে পারে।
একজন সাংবাদিক মানে একজন জ্ঞানপিপাসু একথাও মানতে হবে। এলাকা , সমাজ, দেশ নিয়ে যখন বিবেচনা করবেন তখন আপনাকেও জানতে হবে এ বিষয়ে। সত্যের পক্ষে কলম ধরা এবং বস্তুনিষ্টতার সাথে কাজ করা রিতীমত চ্যলেঞ্জিং একটি বিষয় এখন, এটা যতটা না পূর্বে ছিল। অসহায় আর অত্যাচারিতদের আর্তনাধ সকলের সামনে তুলে ধরা, দেশের প্রত্যেকটি খুটিনাটি বিষয় সাধারন জনগনকে অবগত করা, মৌলিক অধিকার আদায়ে কে কতটা সচেষ্ট, রাষ্ট্র কর্তৃক একজন নাগরিকের যতটা সুযোগ সুবিধা পাওয়া প্রয়োজন তা রাষ্ট্র প্রদান করছে কিনা কিংবা এসব বন্টনে কোথায় গাফিলতি, কিংবা কোথায় অনিয়ম আর অব্যস্থাপনা সেই সংবাদ জনগনের নিকট পৌছে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব এসব বিষয় মাথায় রেখে একজন কলম সৈনিক কে এগিয়ে যেতে হবে এটাই মেনে নেওয়া বাঞ্চনীয় বিষয় হয়ে দাড়ায়।
একজন কলম সৈনিক যখন যেকোন বিষয় সম্পর্কে জনগনকে সঠিক তথ্য উপস্থাপনে প্রস্তুত হবেন তখনই নানা ধরনের বাধা বিপত্তি সামনে এস হাজির হবে। জীবনের এই ঝুঁকিটাই একজন সাংবাদিক বা কলম সৈনিক কে নিতেই হয়। কেননা সৎ সাহস নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালে অপরাধীদের ভীত কেঁপে উঠে। আর যখন সাংবাদিকতা অন্যায়কারীদের চাটুকারিতার পর্যায়ে চলে যায় তখন সেই ভীত সন্ত্রস্ত মানুষগুলো পেয়ে যায় অন্যায় করার সাহস।
অসি দিয়ে যেমন মানুষ হতাহত করা যায় তেমনি মসি দিয়েও মানুষকে হতাহত করা যায়। অসি (তলোয়ার)দিয়ে হতাহত করলে হয়তো মানুষের বেচেঁ থাকার সুযোগ থাকে কিন্তু মসি( কলম) দিয়ে মানুষকে হতাহত করলে সেটা বেঁচে থেকেও মৃত বলে ধরে নেওয়া যায়। মসির আঘাতে আহত হওয়া ব্যক্তির আঘাত কোনদিন শুকায় না। অন্যায়কারীদের পক্ষে চাটুকারীতায় হয়তো নিজের অবস্থানকে আপাতত তাদের কাছ থেকে নিরাপদ রাখা যায় তবে বিবেকের কাছে চিরদিন দায়ী থাকতে হয়।
এখন কথা হল বিবেকের দায় মানে কয়জনে? আমাদের এই দেশে অন্যায় কি কম হচ্ছে? সাধারন মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে কেন এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে না ? অনেক সমস্যা যেগুলো ওপেন সিক্রেট হয়ে আছে সেগুলোতে সাংবাদিকতার নজরদারী নেই কেন? এসব কি আসলেই দেখছে নাকি দেখেও না দেখার ভান করে আসছে। বিষয়টি আসলেই তেমন কিছু বিষয় দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হয় যদি সেখানে মাসোহারা আসে। সাংবাদিকতা মহান একটি দায়িত্ব এর কাজ হল জনগনের সামনে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ তুলে ধরা কিন্তু আমরা আদৌ কি তা পারছি সেটাও আমাদের বিবেকে প্রশ্ন আসে না।
আমরা সাংবাদিকতাকে ব্যবসা হিসেবে ধরে নেই তখন সেই মহান দায়িত্বের কথা ভুলে যাই। কেননা আজকাল সাধুকথাও টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় । সাংবাদিতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এইসব বেড়াজাল ছেদ করে এবং রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা অসৎভাবে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়া কি আমরা আদৌ থামাতে পারবো? সেটাই এখন সময়ের প্রশ্ন এবং কালের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, সচেতন মানুষের কলম হোক সত্য, ন্যায় এবং শান্তির পক্ষে…. ।