দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। নয়নাভিরাম এই দ্বীপটি স্বপ্নের দ্বীপ নামে খ্যাত। দ্বীপে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন। ঢেউ তোলা জীবন্ত পাথুরে সৈকত, চোখ জুড়ানো নারিকেল বীথি, কেয়াবন, জীবন্ত মাছের বারবিকিউ, পালতোলা নৌকাসহ হরেক রকম প্রাণজুড়ানো নৈসর্গিক উপসঙ্গে একাকার এই দ্বীপে। সাথে আছে ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। মানববসতিহীন এই দ্বীপ। তবুও লোকে লোকারণ্য কেয়াবনের ওই দ্বীপটি। সব মিলিয়ে প্রাণজুড়িয়ে দেয়া যুগলবন্দি সেন্টমার্টিন-ছেঁড়াদিয়া দ্বীপ। পর্যটনের অপূর্ব সমাহার নিয়ে সাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপটি। আর এখানকার আগামীর জীবনচিত্র? এই দৃশ্য কারও চোখে পড়ে না। নেই কারও মনোদর্পণেও। সরকার, প্রশাসন, উচ্চ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি কারও নজর নেই সেন্টমার্টিনের ৯ হাজার মানুষের ওপর।
দ্বীপের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা হলেও বতর্মানে পর্যটনকে কেন্দ্র করে নানা পেশার সাথে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।
দ্বীপের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, পর্যটনসমৃদ্ধ হলেও এই দ্বীপের লোকজন নানা সমস্যায় জর্জরিত। যোগাযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ অনেক সমস্যার সন্ধান মিলেছে তাদের সাথে কথা বলে। অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে সেন্টমার্টিনবাসীর প্রধান সমস্যা যোগাযোগ।
মূল ভূখণ্ড টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব জাহাজে তিন ঘণ্টা। স’ানীয় কাঠের বোটে হলে চার ঘন্টার অধিক। এতে করে জরুরি কাজে টেকনাফ ও জেলা সদর কক্সবাজার আসতে গেলে তা কখনো সম্ভব হয় না।
সিপড বোট থাকলেও শুষ্ক মৌসুম ছাড়া তা চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। দ্বীপের লোকজনের অভিযোগ, টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিনের যোগাযোগ অনেক সহজ ও কাছের। শাহপরীর দ্বীপের সাথে যোগাযোগ ব্যবস’া করা হলে সময় ও অর্থ দুটিই সাশ্রয় হত। কিন’ রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তা হতে দিচ্ছে না। টেকনাফ দিয়ে ঘাট বানিয়ে তারা সেন্টমার্টিনবাসীকে একদিকে চরম কষ্টে দিচ্ছে, অন্যদিকে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস’াও ভালো নয়। দীর্ঘদিন ধরে দ্বীপের অর্ধেক আয়তনের সড়ক অত্যন্ত নাজুক অবস’ায় রয়েছে। ফলে সেখানকার লোকজনকে হেঁটে চলাচল করতে হচ্ছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যোগাযোগ ও চিকিৎসা সংকট একই সূত্রে গেঁথে আছে। দ্বীপে একটি মাত্র স্বাস’্যকেন্দ্র রয়েছে। তাতে একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পদও রয়েছে। কিন’ স্মরণকাল পর্যন্ত সেখানে পা পড়েনি সেই চিকিৎসকের।
সেন্টমার্টিনের সচেতন লোকজনের অভিযোগ, কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স’ানীয় প্রশাসনও। সেন্টমার্টিনে যেকোন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য নেয়ার ক্ষেত্রে লাগে অনুমতি। অনুমতির পরও রয়েছে হয়রানি। তল্লাশির নামে। সেই সাথে হাতিয়ে নেয় টাকা।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, মৌলিক খাদ্যপণ্য নেয়ার ক্ষেত্রেও কেন বিজিবির অনুমতি লাগবে? সেন্টমার্টিনের অনেক সমস্যা মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যা অন্যতম। পর্যটনকেন্দ্র হেেলও এখনো বিদ্যুৎ ব্যবস’া নিশ্চিত করা যায়নি দ্বীপে।
জেনারেটরের ব্যবস’া থাকলেও তা শুধু পর্যটকবাহী কটেজকেন্দ্রিক। সৌর বিদ্যুতের দেখা মিললেও দরিদ্রতার কারণে অধিকাংশ মানুষ তার বাইরে রয়ে গেছে। দ্বীপে এক সময় সরকারি উদ্যোগে একটি অস’ায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থাকলেও ১৭ বছর ধরে তা বিকল। অর্থাৎ অন্ধকারেই রয়েছে দ্বীপের মানুষ।
জানা গেছে, ৯ হাজার মানুষের একটি ইউনিয়নে রয়েছে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তাতেও রয়েছে চরম শিক্ষক সংকট। সেন্টমার্টিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে এই বিদ্যালয়ে ৫০২ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র ২জন শিক্ষক। বেসরকারি ভাবে আরো দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও তাতেও নানা সংকট। ফলে দ্বীপের অনেক শিশু এখনো বিদ্যালয়ে যায় না।
সেন্টমার্টিন মানুষের কাছে আরো সমস্যা দেখা গেছে, রড, সিমেন্টসহ আধুনিক নির্মাণ সামগ্রী নেয়ার অনুমতি নেই। তবে অবাক হলেও সত্য, প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না এই নিয়ম।
দ্বীপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, দীর্ঘদিন সেন্টমার্টিন অবহেলিত থাকলেও কোনো সরকার এগিয়ে আসেনি। এক্ষেত্রে দোষটা বেশি জনপ্রতিনিধিদের। স’ানীয় চেয়ারম্যান থেকে উপজেলা প্রশাসন, এমনকি কোন সংসদ সদস্যই সেন্টমার্টিন নিয়ে ভাবেননি।
সেন্টমার্টিন আদর্শ সংসদের সভাপতি হেলাল উদ্দীন সাগর বলেন, সেন্টমার্টিন আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনসপট। কিন’ এ নিয়ে সরকারের সে রকম কোনো পরিকল্পনা নেই। অথচ অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। এখন সময়ের দাবি, সেন্টমার্টিনকে নিয়ে একটি রূপরেখা তৈরি করা হোক। তাহলে একদিকে বাঁচবে সেন্টমার্টিনবাসী, অন্যদিকে বাড়বে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সমপাদক নূরুল আলম আরমান বলেন, সেন্টমার্টিন পর্যটনসপট হচ্ছে দেশ ও মানুষের সমপদ। আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমরা বুঝি দলমত নির্বিশেষে সেন্টমার্টিনের উন্নয়ন।
সেন্টমার্টিন আওয়ামী লীগ সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, স্বীকার করতে হচ্ছে, সেন্টমার্টিনবাসীর জীবনমান উন্নয়নে তেমন কিছু করা হয়নি।
সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বলেন, সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছে, কিন’ সেন্টমার্টিনের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আলম বলেন, দ্বীপ হিসেবে সেন্টমার্টিনের উন্নয়নে একটা রোডম্যাপ দরকার। সরকার এই সিদ্ধান্ত নিলে সব সমস্যা দূর হবে।
টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি, সেন্টমার্টিনের সমস্যাগুলো নিরসন করতে।