সাগরের স্বচ্ছ নীলাভ জলরাশি। পানির নিচে নেই ধারালো কিছু কিংবা প্রবাল। সেইসঙ্গে নেই ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক প্রাণীর কোনো ঝুঁকি। আর এসব সুবিধাই কক্সবাজারকে করে তুলেছে সার্ফিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা।
সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন জাহানার বেগম ও তার বান্ধবী শবে মেহরাজ। শত বাধা উপেক্ষা করে এ দুই কিশোরী সার্ফিং করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে আয়োজিত অনেক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ের স্বাদও পেয়েছেন তারা। কিন্তু এবার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন কক্সবাজার শহরের ঘোনারপাড়া এলাকার গোলাম হোসেনের মেয়ে জাহানারা ও জাফর আলমের মেয়ে মেহরাজ।
সার্ফার জাহানারা বেগম বলেন, ‘সামাজিক অনেক বাধা পার হতে হয়েছে। যা শুনলে আপনার চোখে জল আসবে। সেদিকে ফিরে তাকাতে চাই না। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। দেখিয়ে দিতে চাই আমরাও পারি। সেই ছোট বেলায় ঝিনুক বিক্রি করতাম সৈকতে, সেখান থেকেই সার্ফিংয়ে মন যায়।’
‘দীর্ঘ আট বছর ধরে পরিবার ও সমাজের সাথে সংগ্রাম করে আজকের আমি। যদি সরকার আমাদের একটি ক্লাব করে দেয়, তাহলে আমরা আরও বড় ধরণের টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারব।’
একই সুর জাহানারার প্রিয় বান্ধবী শবে মেহরাজের কন্ঠেও। মেহরাজ বলেন, ‘সার্ফিংয়ের জন্য অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছি। এখন শুধু দেখিয়ে দিতে চাই, মেহরাজ অনেক ভাল সার্ফার। বাবা-মা দুইজনই বাধা দিয়েছিলেন। সামাজিকভাবেও অনেক হেনস্থা হতে হয়েছে। কিন্তু বাবা-মা তখন সার্ফিং সম্পর্কে জানতেন না, তাই হয়তো বাধা দিয়েছিলেন। এখন সবকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাই বহুদূর।’
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমুদ্র সৈকতে বহু আগে থেকেই সার্ফিং চালু থাকলেও বাংলাদেশে সার্ফিংয়ের শুরুটা ২০০০ সালে। তবে দেরিতে হলেও এখন বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে আসা বিদেশিদের ঝোঁক থাকে সার্ফিংকে ঘিরে। এ সার্ফিং নিয়ে বেশ সম্ভাবনাও দেখছেন সার্ফাররা। সম্ভাবনার কথা বলছেন ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটক ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তারাও।
সাধারণত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, লাবণী ও শৈবাল পয়েন্টে দিনভর সার্ফাররা মগ্ন থাকেন জলক্রীড়ায়। গর্জন তোলা সমুদ্রের ঢেউ বেয়ে লাফিয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর জলনৃত্য উপভোগ কিংবা সৈকতে আসা পর্যটকদের চিত্তবিনোদনের খোরাকই শুধু নয়, সমুদ্রে নামা মানুষের জীবন রক্ষাকারী হিসেবেও কাজ করছেন সার্ফাররা। কেউ কেউ আবার একেবারেই লাইফ সেভিংয়ের কাজ করছেন। অল্প সময়েই কক্সবাজারের শতাধিক সার্ফার জাতীয়ভাবে পরিচিত করে তুলেছেন নিজেদের।
তারই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে সৈকতের সিগাল্ড পয়েন্টে পঞ্চম বারের মতো জাতীয় সার্ফিং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিন দিনব্যাপী এ প্রতিযোগিতায় প্রায় ৫০ জন সার্ফার অংশ নিচ্ছে। সেখানে ১৬ নারী রয়েছে। এছাড়াও বেলজিয়াম, জার্মানিসহ ১৩ দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন।
সিনিয়র সার্ফার রাসেদ বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, একদিন আমরা বিশ্বজয় করব। সেদিনের স্বপ্ন নিয়ে সার্ফিং করে যাচ্ছি। আশা করি আগামীতেও ভাল কিছু করতে পারবো।’
উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান খান কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের সার্ফিং এখন অনেকদূর এগিয়েছে। আমরা আসা করছি আগামীতে আরও ভাল করবে। সরকারের উচ্চ মহলকে অবহিত করা হচ্ছে। এখানে যেন একটা সার্ফিং ক্লাব করা হয়।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) আশরাফুল আবছার বলেন, ‘সৈকতে আসা পর্যটকদের চিত্তবিনোদনের খোরাকই শুধু নয়, সমুদ্রে নামা মানুষের জীবন রক্ষাকারী হিসেবেও কাজ করছেন সার্ফাররা। আমরা মনে করছি আগামীতে একটি ক্লাব করা গেলে এ সার্ফাররা একদিন দেশের হয়ে বিদেশের মাটিতে আলো ছড়াবেন।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে সার্ফিং বোট নিয়ে কক্সবাজারের উত্তাল তরঙ্গে দোল খেয়ে অভিভূত হয়েছিলেন লোন সার্ফার টম বাওয়ার্ডের নেতৃত্বে আসা একদল অসি-মার্কিন সার্ফার। বিদেশি সার্ফারদের এই ঢেউয়ে নৃত্য দেখেই শখ জাগে বর্তমানে সার্ফিং আইকন হিসেবে পরিচিত জাফর আলমের। নিজের সাধনায় তিনি হয়ে উঠেন বাংলাদেশের প্রথম সার্ফার। পরে ২০০০ সালের দিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সৈকতের অনেক শিশু হকার সার্ফিংয়ে যোগ দেয়।