জেলার অর্ধশত লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট ও স্টিমারঘাট ইজারাদার সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে আছে দীর্ঘদিন। বেশ কিছু ঘাট চলছে ইজারা নীতিমালা লঙ্গন করে। নির্ধারিত মূল্য তালিকা না টাঙ্গিয়ে আদায় করছে ইচ্ছেমতো টাকা। লাইটিংসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক সেবাও নেই এসব ঘাটে। অধিকাংশ ঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারদলীয় নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। টেন্ডার ভাগাভাগি ও কৌশলী টেন্ডারের কারণে সরকার প্রতি বছর হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।
সাধারণ জনগণের ভাষ্যমতে, সরকারকে রাজস্ব কম দেয়ার জন্য সিন্ডিকেট করে টেন্ডার ফরম জমা দেয় ঘাট ইজারাদাররা। এতেকরে কাঙ্খিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে ঘাটসমূহের ইজারা দিতে হয় প্রশাসনকে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারস্থ স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এএফএম আলাউদ্দিন খান বলেন, ইজারাদাররা বোঝাপড়া করে নিলাম কার্যক্রমে অংশ নেয়। তাদের এ কৌশলের কারণে সরকার প্রতি বছর কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যারা দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থ বড় করে দেখে তারাই একাজ করে থাকে। এ বিষয়ে সবাইকে আরো বেশী সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় সরকার বিভাগের অফিস সুত্র জানায়, জেলায় অর্ধশত লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট ও স্টিমারঘাট রয়েছে। এসব ঘাট থেকে সরকার প্রতি বছর আড়াই কোটি টাকারও বেশী রাজস্ব আদায় করছে। সেখানে শুধুমাত্র স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে ১৮ টি খেয়াঘাট, ১০টি ফেরিঘাট ও দুইটি লঞ্চঘাট থেকে বছরে রাজস্ব আয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। ব্যক্তি পর্যায়ে এসব ঘাট নিলাম দেয়া হয়।
জেলা পরিষদ সুত্র জানায়, তাদের আওতায় রয়েছে ১টি লঞ্চঘাট, ২টি ফেরিঘাট ও একটি স্টিমারঘাটসহ ২০টি ঘাট থেকেও প্রতি বাংলা সনে প্রায় ৮০ লাখ টাকা সরকারের রাজস্ব আদায় হচ্ছে। ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত ঘাটসমূহের ইজারাদার আহবান করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সবমলিয়ে কক্সবাজার থেকে সরকারী কোষাগারে ফি বছর জমা হচ্ছে অন্তত আড়াই কোটি টাকা রাজস্ব। সামনের মৌসুম থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জেলার অধিকাংশ লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট ও স্টিমারঘাট সরকারদলীয় নেতা ও প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কৌশলে এসব ঘাট ইজারা নিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তথাপিও জেলার অর্ধশত ‘ঘাট’ থেকে বছরে আড়াই কোটি টাকার মতো রাজস্ব আয় বিরাট মাইল ফলক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভৌগলিকভাবে কক্সবাজার জেলা শহর বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে অবস্থিত। জেলার ৮ উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় ছোট-বড় অনেক খাল-বিল রয়েছে। এসব এলাকায় পারাপারে রয়েছে লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, স্টিমারঘাট। কমেই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও চাহিদা রয়েছে বিভিন্ন ঘাটের।
এক সময়ে জেলার মানুষজন হাঁটবাজারে যেতে কাঁদামাটি ও পানি অতিক্রম করতে হতো। এক যুগ আগেও প্রচুর পরিমাণ খেয়াঘাট প্রচলন ছিল এই জেলায়। তখন যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল খেয়াঘাট। যুগের পরিবর্তনে যাতায়াত ব্যবস্থাও অনেক সহজ হয়েছে। অজপাাড়ায় নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন ব্রীজ-কালভার্ট। স্থাপিত হচ্ছে আধুনিক সড়ক উপ-সড়ক। এসবের ফলে আজকাল খেয়াপারাপার ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। অনেক খেয়াঘাট এর ওপর নতুন কালভার্ট-ব্রীজ হওয়ায় কমে আসছে খেয়াঘাটের সংখ্যা। এরপরও বর্ষা মৌসুমে জেলার নিম্নাঞ্চলপ্লাবিত হওয়ায় খেয়াঘাটের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রয়োজনের তাগিদে মানুষ ঘাট ধরে রেখেছে।
জেলা প্রশাসকের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলায় খাস কালকশানের ৯টি ঘাট রয়েছে।
ঘাটগুলো হলো- কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ ফেরিঘাট, বড়ঘোপ মগনামা ফেরিঘাট, মহেশখালী ধলঘাটা বদুয়া ফেরিঘাট, পেকুয়ার পশ্চিম উজানটিয়া লঞ্চঘাট, মধ্যম উজানটিয়া মৌলভীবাজার লঞ্চ ঘাট, পুরুইত্যাখালী মোরাপাড়া ফেরিঘাট, মেহেরনামা পুরুইত্যাখালী ফেরিঘাট, কক্সবাজার সদরের মোক্তারকূল ফেরিঘাট, দিনেশপুর গোমাতলী ফেরিঘাট। এসব খেয়াঘাট থেকে খাস কালেকশানের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, জেলা পরিষদের অধীনে ২০টি খেয়া/লঞ্চঘাট রয়েছে।
খেয়া/লঞ্চঘাটগুলো হলো-পেকুয়া উপজেলার মগনামা লঞ্চঘাট, উজানটিয়া মাতারবাড়ী ফেরিঘাট, পেকুয়া বাংলাবাজার সিরাদিয়া ফেরিঘাট, জমিলাবাপের ঘাট, পহরচাঁদাঘাট, চকরিয়ার বদরখালী স্টিমারঘাট, কৈয়ারবিল ঘাট, পূর্ববড় ভেউলা ঘাট, হাঙ্গরঘাট, সদরের ভারুয়াখালীঘাট, ছনখোলাঘাট, খরুলিয়াঘাট, খোয়াজনগরঘাট, সোমরার ডেইলঘাট, তেতৈয়াঘাট, বাঁকখালী বাজারঘাট, মিঠাছড়িঘাট, উমখালীঘাট, ডুমপাড়া নাশিরকূলঘাট, চকরিয়ার বুড়া মাতামুহুরী তিন খালের মুখেরঘাট।
তাছাড়া জেলা পরিষদের অধীনে রয়েছে আরো ৩টি জেটি ও তিনটি চেঞ্জিং রুম কাম গণশৌচাগার। ৩টি জেটি হলো- সেন্টমার্টিনদ্বীপ জেটি, শাহপরীরদ্বীপ জেটি, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির জেটি।
৩টি চেঞ্জিং রুম কাম শৌচাগার হলো- সমুদ্র সৈকতস্থ লাবনী চেইঞ্জিং রুম কাম শৌচাগার, সী-ইন পয়েন্ট সংলগ্ন নীলিমা চেইঞ্জিং রুম কাম শৌচাগার, ইনানী বীচ চেইঞ্জিং রুম কাম শৌচাগার। এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, প্রতি বাংলা সনের ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত ঘাট ইজারা দেয়ার নিমিত্তে আগ্রহীদের কাছে দরপত্র আহবান করা হয়। দরপত্রের সাথে ২৫ শতাংশ অর্থও জামানত দিতে হয় দরদাতাদের। সর্বোচ্চ দরদাতাকেই চূড়ান্তভাবে এক বছরের জন্য ঘাট ইজারা দেয়া হয়।
এ দিকে জেলা প্রশাসনের অধীনে বিভিন্ন উপজেলায় ১৯টি আন্তঃউপজেলা ফেরিঘাট/লঞ্চঘাট রয়েছে। এগুলো প্রতি বাংলা সনের ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত ‘একসনা’ হিসাবে ইজারা প্রদান করা হয়।
ঘাটসমূহ হলো- কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল লঞ্চঘাট, দরবার লঞ্চঘাট, মহেশখালীর মাতারবাড়ী রাজঘাট লঞ্চঘাট, মধ্যম উজানটিয়া মৌলভীবাজার লঞ্চঘাট, পশ্চিম উজানটিয়া লঞ্চঘাট, চকরিয়া-পেকুয়ার বাগগুজারা হরিণাপাড়ী লঞ্চঘাট, ডেমুশিয়া উজানটিয়া ফেরিঘাট, বদরখালী বইশ্যা ফেরীঘাট, বাংলাবাজার উজানটিয়া ফেরিঘাট, দরবার মগনামা ফেরিঘাট, আলী আকবর ডেইল উজানটিয়া ফেরিঘাট, কক্সবাজার-মহেশখালী দিনেশপুর গোমাতলী ফেরিঘাট, কক্সবাজার-রামুর মুক্তারকুল ফেরিঘাট, চকরিয়া-পেকুয়ার বদরখালী করাইয়ারদিয়া ফেরিঘাট, পেকুয়া-কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ-মগনামা ফেরিঘাট, মহেশখালীর ধলঘাটা বদুয়া লঞ্চঘাট, পেকুয়ার পুরুইত্যাখালী মুরাপাড়া ফেরিঘাট, মেহেরনামা পুরুইত্যাখালী ফেরিঘাট ও পেকুয়া-মহেশখালীর করিয়ারদিয়া মাতারবাড়ী ফেরিঘাট।
ইজারার সময়কাল প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এএফএম আলাউদ্দিন খান জানান, প্রতি বাংলা সনের চৈত্র মাসে নিলাম কার্যক্রম শুরু হয়। ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত উম্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে ইজারাদারের নিকট নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঘাটসমূহ ইজারা প্রদান করা হয়। গত মৌসুমে এসব ঘাট থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। আগামী ২০ চৈত্র (১৪২৩ বাংলা সনের জন্য) ঘাটসমূহের নতুনভাবে টেন্ডার কার্যক্রম শুরু হবে।
এসব ঘাট থেকে গত মৌসুমে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে আগামী মৌসুমে এর দেড়গুন রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি ধারণা করছেন।