নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবিসহ সব জঙ্গি সংগঠন এবং সন্ত্রাসী বাহিনী ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে কক্সবাজার ও বান্দরবান থেকে। সেখানকার গহিন অরণ্যের সীমান্ত পার হয়ে এসব অস্ত্র আসছে দেশে। সীমান্তে যে অস্ত্রটি দুই থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হয়, সেটি কয়েক হাত ঘুরে চট্টগ্রামে পাওয়া যায় সাড়ে তিন থেকে চার লাখে! চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। জেএমবির আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া ভারী অস্ত্রটি নিয়ে অনুসন্ধানেও প্রায় অভিন্ন তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
সর্বশেষ গত ২৬ ডিসেম্বর রাতে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে গ্রেপ্তারকৃত জেএমবি সদস্যরা গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, বান্দরবান থেকে অস্ত্রটি তাঁরা সংগ্রহ করে মোটরসাইকেলে চট্টগ্রামে এনেছিলেন। গত বছর র্যাব ও পুলিশ মিলে জেএমবিসহ জঙ্গিদের কাছ থেকে মোট ১১টি ভারী অস্ত্র উদ্ধার করেছে। উদ্ধারের তালিকায় ছোট অস্ত্রও রয়েছে। জেএমবিসহ জঙ্গি সংগঠনগুলো অস্ত্র সংগ্রহ করছে সীমান্ত জেলা বান্দরবান থেকে। এছাড়া দেশের বাজার থেকে বিস্ফোরক সংগ্রহ করে রীতিমতো ‘ডিপো’ তৈরি করছে। পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও জব্দকৃত বিস্ফোরক দ্রব্যের তথ্য বিশ্লেষণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
জেএমবি সদস্যদের কাছ থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে তিনটি ভারী অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর নগরীর সদরঘাট থানায় জেএমবির তহবিলে অর্থজোগান দিতে ছিনতাই করেন জেএমবি সদস্যরা। ওইদিন এক ব্যবসায়ীর টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় বিস্ফোরণে ব্যবসায়ী ও জেএমবি সদস্যসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। এদিন দুটি একে ২২ রাইফেল ফেলে যান জেএমবি সদস্যরা। পরে অস্ত্র দুটি পুলিশ উদ্ধার করে।
সর্বশেষ জেএমবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের কথিত কমান্ডার ফারদিনের আস্তানা থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার হয়। তিন মাসের ব্যবধানে জেএমবির কাছ থেকে তিনটি ভারী অস্ত্র উদ্ধার হওয়ার পর নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) বাবুল আক্তার বলেন, ‘জেএমবি শুধু বোমা নিয়ে বসে নেই, ভারী অস্ত্র সংগ্রহের দিকেও মনোযোগ দিয়েছে। তিন মাসে দুটি ঘটনায় তিন অস্ত্র উদ্ধার এরই প্রমাণ।’
অন্যদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৭) এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চলতি বছর চট্টগ্রামভিত্তিক শহীদ হামজা ব্রিগেড নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে র্যাব। এই সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে মোট আটটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ক্ষুদ্রাস্ত্রও রয়েছে উদ্ধারের তালিকায়।’ মিফতা উদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, ‘র্যাব-৭ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারী ও ক্ষুদ্রসহ ১৩৪টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে র্যাব। এর মধ্যে তিনটি একে-৪৭, ৯টি একে-২২, ৪৪টি বিদেশি রিভলবারসহ অন্যান্য অস্ত্র রয়েছে।’ জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকেই আটটি অস্ত্র উদ্ধারের বিষয় নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনগুলো শুধু বোমার ওপর নির্ভর করছে না। বোমার পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্রের দিকেও ঝুঁকেছে। এই কারণে জঙ্গি সংগঠনসহ সন্ত্রাসীরা বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত পেরিয়ে আসা অস্ত্র সংগ্রহ করছে।’ জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকে ভারী অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহমেদ জানান, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাঁশখালীর লটমনি পাহাড়ি এলাকায় শহীদ হামজা ব্রিগেডের প্রশিক্ষণ আস্তানা থেকে তিনটি একে-২২ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এপ্রিল মাসে নগরীর পাঁচলাইশ থানার কসমোপলিটন এলাকার একটি বাসা থেকে উদ্ধার করে আরও পাঁচটি একে-২২ রাইফেল। মাঝে সাতকানিয়ার একজন অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং সন্দ্বীপ থেকে একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে জঙ্গি সংগঠনের কাছে পাওয়া গেছে আটটি ভারী অস্ত্র। অস্ত্রের দামের বিষয়ে অনুসন্ধান করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জেনেছেন,‘জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেড একে-২২ রাইফেল কিনেছে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা দরে। পিস্তল কিনেছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায়। এছাড়া একে-২২ রাইফেলের গুলি ৫৫০ এবং পিস্তলের গুলি ২৫০ টাকায় কিনছে।’
অস্ত্রের দামের বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্য জানিয়ে র্যাবের অধিনায়ক বলেন, ‘শহীদ হামজা ব্রিগেডের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে চীনের তৈরি একে-২২ রাইফেল বাংলাদেশে আসছে ভারতের মিজোরাম থেকে। জঙ্গি সংগঠন ছাড়াও সন্ত্রাসীদের জন্যও অভিন্ন রুটে এবং অভিন্ন দামে অস্ত্র আসছে।’ শহীদ হামজা ব্রিগেডকে ‘পাঙ্কু’ নামের একজন চাকমা যুবক অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। চট্টগ্রামে বহনকারীর কাজ করেছেন জনৈক মোজাহের। মিজোরাম সীমান্ত থেকে মোজাহের এই অস্ত্র সংগ্রহ করেন দুই লাখ থেকে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা দামে। এদিকে জঙ্গি আস্তানা থেকে ২৬ ডিসেম্বর রাতে উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে জানতে চাইলে গ্রেপ্তারকৃতরা গোয়েন্দা পুলিশকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। আসামিদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর) বাবুল আক্তার বলেন, ‘কয়েক মাস আগে জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ফারদিন ও তার দুই সহযোগী ফয়সাল মাহমুদ ও মো. শওকত রাসেল বান্দরবান গিয়ে অস্ত্রটি সংগ্রহ করে। অস্ত্র সংগ্রহের সময় ফারদিন মেঘলা এলাকায় একজন লোকের সঙ্গে কথা বলে। তখন ফয়সাল ও রাসেল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল। পরে একটি ব্যাগ নিয়ে তারা মোটরসাইকেলে চট্টগ্রামে ফিরে আসে। সেই থেকে অস্ত্রটি ফারদিনের বাসায় ছিল। এটি ব্যবহূত হয়নি বলে গোয়েন্দাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত ফয়সাল ও রাসেল জানিয়েছে।’
র্যাবের অভিযানে গত বছর জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকে ৭৬টি বোমা উদ্ধার হয়েছে। আর বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে ৪২০ কেজি এবং ৩০ ধরনের বোমা তৈরির সরঞ্জাম। র্যাবের পাশাপাশি নগর পুলিশও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে। সেই সঙ্গে উদ্ধার হয় বোমা তৈরির নির্দেশিকা। বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহের বিষয়ে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা র্যাবকে জানিয়েছেন, তাঁরা স্থানীয় বাজার থেকে বিস্ফোরক পাউডারসহ বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করেন।