‘বাইজিদ সেন্ট মার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল এন্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। সকালে ক্লাস করে বিকেলে বাড়ি ফেরে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবার ক্ষুদ্র ব্যবসায় কাজ করে কেটে যায় ছোট্ট বাইজিদের দিন। রাতে বাড়ি ফেরার পর স্কুলের হোমওয়ার্ক সেরে বিছনায় শুয়ে জীবনের স্বপ্ন আঁকে সে। বড় হয়ে নামকরা ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা বাইজিদের। চায় গ্রামের অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। “বাবা চান, আমি তার মাছের দোকানে বসি। কিন্তু আমি ডাক্তার হতে চাই। তবে কিভাবে হতে হবে তা জানি না’-বড় হয়ে কি হতে চাও এমন প্রশ্নে ছোট্ট বাইজিদের আত্মবিশ্বাসী জবাব। বিজ্ঞান বাইজিদের পছন্দের বিষয়, বিশেষ করে নতুন নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে পড়তে তার ভাল লাগে।
একই স্কুলের ছাত্র মহিউদ্দীনের জীবনের লক্ষ্য শিক্ষকতা। বই পড়ে জেনেছে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। “আমাদের স্কুলে শিক্ষকের অভাব। বড় হয়ে আমি স্কুল শিক্ষক হব, ছেলে-মেয়েদের পড়াব’-ছোট্ট মহিউদ্দীনের কণ্ঠও দৃঢ়চেতা। বাংলা তার ভালো লাগার বিষয়, প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ।
মহিউদ্দীনের সহপাঠী কানিজের গণিতেই ভালো লাগা। তার স্বপ্ন গণিত নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া। ‘আমি জানি, এখানে আমি সর্বোচ্চ এসএসসি পর্যন্তই পড়তে পারবো। তবে শহরের বড় কোন কলেজে গিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আমার বাবা একজন দিনমজুর। আমাকে শহরে বড় প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সামর্থ তাঁর নেই’-বলতে বলতে কণ্ঠ ভারি হয়ে এলো কানিজের!
বাইজিদ, মহিউদ্দীন কিংবা কানিজের মতোই তাদের সহপাঠী ছৈয়দ আলম, তমিজা, সাজেদা আক্তার, রবিউল, সিয়ামরাও বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তাদের কেউ হতে চায় ডাক্তার, কেউ শিক্ষক কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার। তবে ডাক্তার আর শিক্ষক হওয়াই বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর লক্ষ্য মনে হলো। হয়তো এখানকার মানুষের মৌলিক অধিকার দু’টির সংকটই তাদের স্বপ্নের বাঁধকে শক্ত করেছে।
এই শিশুগুলো জানে, সেন্টমার্টিনে পড়ালেখার সুযোগ সর্বোচ্চ এসএসসি পর্যন্তই। আর এইচএসসি এখনো শুরুর প্রক্রিয়াধীন। তার ওপর তাদের কারো বাবা হয়তো জেলে, কারো বাবা ভ্যান চালক কিংবা নৌকার মাঝি। অনেকের বাড়িতে হয়তো ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’, কারো বাড়ির ছাদ বলতে হয়তো উদার আকাশ। হাজারো চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা তাদের সামনে। কিন্তু প্রতিভা আছে, আত্মবিশ্বাস আছে এবং আছে বুকভরা স্বপ্ন। সংকট প্রতিভা বিকাশের সুযোগের, অভাব স্বপ্নপূরণের একটি প্লাটফর্ম। তবুও তারা নিজকে এবং মাতৃভূমিকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখে। চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াসের অমীয় বানী ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’-বোধ হয় তাদেরও জানা।
দেশিবিদেশি হাজারও পর্যটকদের জীবনাচরণ দেখে দিন দিন তাদের স্বপ্নগুলো শুধু বড়ই হয়েছে, খুলেনি স্বপ্ন পূরনের রুদ্ধ দ্বার। ‘কতো জ্ঞানীগুণী-খ্যাতনামা ব্যক্তিরা সেন্টমার্টিনে এসে রূপ-যৌবন-লাবন্য উপভোগ করে চলে যায়, কিন্তু পেছনে ফিরে চায় না। এই দ্বীপের ছাত্রছাত্রী কিভাবে জীবনধারণ করে, কি তাদের সমস্যা, কি তাদের স্বপ্ন তার খোঁজ-খবরও নেয় না কেউ। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ঘুরতে এসে ছাত্রছাত্রীকে স্বপ্নের কথা শুনিয়ে যায়, বড় হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যায়-ব্যাস এটুকুই’-আক্ষেপের সুরেই বলছিলেন শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত স্থানীয় ভ্যান চালক মোহাম্মদ কালাম। তিনি জানালেন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এখানে কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেককে হয়তো মাছ শিকার কিংবা ভ্যান চালাতে হয়।
ইতিহাস বলছে, প্রায় তিন’শ বছর আগে নারিকেল জিনজিরার আবিষ্কার এবং আড়াই’শ বছর ধরে মানুষের বসবাস। প্রথমে রাখাইনরা মাছ ধরার জন্য কিছুকাল এখানে বসবাস শুরু করে। পরে মুসলমানরা মাছ ধরতে এসে দেখল বসবাস উপযোগী। একসময় ব্রিটিশরা দখলে নেয় দ্বীপটি। পরে পাকিস্তানিদের আওতাভুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর স্বভাবতই এটি বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড, সারাবিশ্বের পরিচিত একটি প্রবালদ্বীপ।
প্রবাল এবং নারিকেল গাছ বেষ্টিত এই দ্বীপে বর্তমানে প্রায় ৮হাজার মানুষের বসবাস। যার মধ্যে ভোটার ৩হাজার। পুরুষ ও মহিলা অনুপাত ৬০:৪০। ২০০১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী শিক্ষার ১৫.১৩ভাগ। প্রায় ৮বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং হাই স্কুলের বাইরে রয়েছে বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল দুটি, কওমি মাদরাসা দুটি, হাফিজিয়া মাদরাসা দুটি, ইবতেদায়ী মাদরাসা ১০টি।
১৯৪৮সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জিনজিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। অনেক পরে এসে ১৯৯০ সালে যাত্রা করে ‘সেন্ট মার্টিন বিএন ইসলামিক স্কুল এন্ড কলেজ’(এমপিওভুক্ত)।সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রায় ৫শ। আর শিক্ষক মাত্র ৩জন। এরপরও গত পিএসসি পরীক্ষায় ৩৩জন অংশ নিয়ে সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে বলে জানালেন শিক্ষক সাইদুর রহমান। ‘সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে এখানকার অভিভাবকদের কোন মাথা ব্যথা নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে এলো কি এলো না, তারা কোন খোঁজ নেয় না। তবে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিভাবান। কিন্তু প্রতিভা বিকাশের যে সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন তার কিছুই নেই এই স্কুলে, শিক্ষক সংকট তো আছেই’-বলছিলেন মি. সাইদুর রহমান।
এদিকে হাজারো সমস্যার মাঝেও বিএন ইসলামিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা চালিয়ে নিচ্ছে। এই বিদ্যাপীঠে প্রায় আড়াই’শ ছাত্রছাত্রী। ৮জন শিক্ষকের মধ্যে একজন নারী। শিক্ষক সংকট, অবকাঠামো এবং আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত হয়েও গত এসএসসি পরীক্ষায় পাশের হার প্রায় ৯০ভাগ বলে জানালেন স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মিল্টন দত্ত। তিনি বলছিলেন, ‘আগে সেন্টমার্টিনে শিক্ষার অবস্থা ছিলো ভয়ানকভাবে খারাপ। ছাত্রছাত্রী খোঁজে পাওয়া যেতো না। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় অভিভাবকদের যেমন অসচেতনতা ছিলো, ছেলেমেয়েরাও তেমনি অনাগ্রহী ছিলো’। মি. দত্ত বলছেন, ‘এখন পূর্বের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় আগ্রহী হচ্ছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে বাইরে পড়তে যাচ্ছে এবং উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে অনেকে সেন্টমার্টিনে ফিরে শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রাখছে’।
প্রতিবছর অন্তত ৮-১০জন শিক্ষার্থী সেন্টমার্টিনের বাইরে বিভিন্ন কলেজে পড়তে যায় বলে জানালেন এখানকার শিক্ষকরা। তারা বলছেন, যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে মূলত তারাই বাইরে পড়তে পারে। এমনই একজন হলেন আবছার কামাল। তিনি ঢাকার একটি নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ শেষ করে ফিরে এসেছেন সেন্টমার্টিনে। নিজের স্কুলেই এখন শিক্ষকতা করছেন। পাশাপাশি বাড়ির হোটেল এন্ড রিসোর্ট দেখাশুন করেন। মি. কামালের স্বপ্ন এখানকার প্রাথমিক শিক্ষার ভীতটাকে শক্ত করা। এর জন্য তিনি একটি ডিজিটাল পদ্ধতির স্কুল চালু করতে চান। পড়ালেখার মান বৃদ্ধি করে আলোকিত করতে চান সেন্টমার্টিনকে। ‘এখানকার মানুষগুলো শিক্ষিত হলে দেশেরই লাভ। তারা নিজেরাই দেশিবিদেশি পর্যটকদের পর্যটন সেবা দিতে পারবে। ফলে পর্যটক বাড়বে, দেশের অগ্রগতি হব’-বলছিলেন আবছার কামাল। মি. কামাল সেন্টমার্টিনের শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে চান। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশ সরকার, দেশিবেদিশি বিভিন্ন সংস্থা এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতা কামনা করছেন।
পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় এই প্রবালদ্বীপে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসেছেন ইকবাল হাসান। তিনি ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ের প্রভাষক। সেন্টমার্টিনের শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, “বিশ্বকে আলোকিত এবং সমৃদ্ধশালী করতে জাতিসংঘ, ইউনডিপি, ইউনিএইচসিআর, ব্র্যাক সহ অসংখ্য সংগঠন কাজ করে চলেছে। কাজ করছে নিজ নিজ দেশের সরকারগুলোও। কিন্ত এখানে এসে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সুরে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘ইশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ভদ্র পল্লীতে, এই দ্বীপে নয়”।
মি. হাসান বলছিলেন, বাংলাদেশের ১০/১৫বছর আগের লক্ষ্যমাত্রা আর বর্তমান লক্ষ্যমাত্রা এক নয়। আগে আমরা ক্ষুধা এবং দরিদ্র বিমোচনের জন্য কাজ করতাম। এখন লক্ষ্য ডিজিটাল সিস্টেমে আলোকিত বাংলাদেশ। কিন্তু সেন্টমার্টিনকে আমার মারাত্মকভাবে অবহেলিত মনে হয়েছে। আমরা হাতে থাকা সুযোগটিকে নষ্ট করছি। সেন্টমার্টিনে বিনিয়োগ আরো ১০/২০গুণ বাড়ানো প্রয়োজন বলছেন ইকবাল হাসান।
তিনি বলেন, তখন মানুষ শিক্ষিত হবে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এখন এসএসসি পাশ করার পরও এখানকার ছাত্রছাত্রীদের পেশা জেলে বা ভ্যান চালক। তখন এর পরিবর্তন ঘটবে, যেখানে কিছু স্বপ্নের নতুন বীজ বপন হবে। আর আমরাও পাবো সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা প্যানাঙ এর মতো এশিয়ার আর একটি অনিন্দ্য সুন্দর, নিরাপদ এবং সুসজ্জিত পর্যটন কেন্দ্র’।