ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৪ দলের শরিক বিভিন্ন দল মাঠপর্যায়ে অস্বস্তিতে পড়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়েই তারা চিন্তিত। সরকারি দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় কিছু নেতার কর্মকাণ্ডে বিব্রত মহাজোটের শরিক দলের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতারা। মনোনয়ন জমা দেওয়ার শুরু থেকেই বিএনপি নির্বাচনের পরিবেশ ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে।
তৃণমূলে গণতন্ত্র চর্চা বাড়াতে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ১৪ দলের শরিক সংগঠনগুলো সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মত দেয় যে, এর ফলে তৃণমূলে ওই সব সংগঠনের কার্যক্রম জোরদার হবে। কিন্তু দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগের মনোনীত বা বিদ্রোহী প্রার্থীরাই ২০৭টি পৌরসভার মধ্যে ১৬৮টিতে বিজয়ী হয়।
আগামীকাল মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বেশির ভাগ এলাকায় সরকারি দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীরাই একে অপরের মূল প্রতিপক্ষ। এরপর আছেন বিএনপির প্রার্থীরা। নিবন্ধন না থাকায় জামায়াতে ইসলামীর দলগত প্রার্থী নেই।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শুরু থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভয়ভীতি, হুমকি ও মারধরের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে মহাজোটের প্রার্থীরাও দেশের অনেক জায়গায় সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়ার কথা বলছেন। ওই সব প্রার্থী যাঁরা মনোনীত করেছেন তাঁরা মহাজোটের মন্ত্রী বা সাংসদ। নিজের এলাকায় তাঁদেরও যথেষ্ট প্রভাব ও পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের কারণে তাঁরাও অনেক ক্ষেত্রে বিব্রত হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধী দল সব সময় এমন অভিযোগ করে। তবে তারা যে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এটা ভালো সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, নির্বাচনে বিচ্ছিন্ন কিছু খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এটা দলের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। বিএনপি ও মহাজোটের শরিকদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পুলিশের মহাপরিদর্শককে বলেছেন, নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। পুলিশ ও প্রশাসন যেন নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে। তিনি বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের এটি প্রথম অভিজ্ঞতা। কিছু ভুলত্রুটি ও বিচ্ছিন্ন অনিয়ম হতে পারে। তবে এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও ভালো নির্বাচন করার শিক্ষা আমরা অর্জন করব।’
বিরোধী দল বিএনপির প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে ৬১৩টি ইউনিয়নে অংশ নিচ্ছে। দলের যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হবে জবরদস্তিমূলক, ন্যক্কারজনক ও তামাশার নির্বাচন। এত হতাশার মধ্যে জাতি তৃণমূলের এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে আশার আলো দেখছিল, তা নিভিয়ে দেওয়া হবে মঙ্গলবার। তাঁর মতে, হামলা-মামলা, ভয়ভীতি ও কারচুপির প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে, স্বাধীনতার পর এটা হবে সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসন সরকারি দলকে সহায়তা করতে যেন প্রস্তুত হয়ে আছে।
বিরোধী দল বিএনপির মতো এতটা কড়া সমালোচনা না করলেও ১৪ দলের শরিকদের মনঃকষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টি গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে জোটের প্রার্থীদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, সরকারি দল ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি সারা দেশে ইউপি চেয়ারম্যান পদে ২২ জন প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে দলের সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নির্বাচনী এলাকা বাবুগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে চারটি ও উজিরপুরে দুটিতে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন দলের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কিছু সদস্য এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতা নির্বাচনবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছেন বলে ওয়ার্কার্স পার্টি অভিযোগ তুলেছে।
বরিশাল থেকে নির্বাচিত ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদ টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ইতিমধ্যে উজিরপুরের হারতায় চেয়ারম্যান প্রার্থী বিমল চন্দ্র করাতির সমর্থকদের মারধর করা হয়েছে। পছন্দের লোকদের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য এলাকায় ভয়ভীতি ও মারপিট চলছে। ওই সাংসদ বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ওপরে ওপরে বলে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সবকিছু করবে। কিন্তু বাস্তবে সেই অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন প্রশাসনকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছে না বলেও জানান ওই সাংসদ।
এ বিষয়ে রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তৃণমূলে গণতন্ত্রের বিকাশে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৃণমূলে অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ হলে এবং প্রশাসনের ভূমিকা নিরপেক্ষ না হলে এই উদ্যোগ তৃণমূলে আস্থা হারাবে এবং ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
মহাজোট সরকারের শরিক জাতীয় পার্টি (জেপি) প্রথম পর্যায়ে ১৭টি ইউনিয়নে প্রার্থী দিয়েছে। দলটি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া, কাউখালি ও জিয়ানগরে তাদের প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। জানতে চাইলে দলের চেয়ারম্যান এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে ভয়ভীতি, মাস্তানি একটু-আধটু থাকবে। আশা করি, সব আশঙ্কা ও অপচেষ্টার পরও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।
১৪ দলের অপর শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ প্রথম পর্যায়ে ২৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী দিয়েছে। জাসদের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলে দুটি কমিটি হওয়ায় মাঠপর্যায়ে প্রার্থীদের কেউ কেউ বিপাকে পড়েছেন। তা ছাড়া অস্থিরতার কারণে দলের কেন্দ্র থেকেও সেভাবে প্রার্থীদের দেখভাল করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গতকাল এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
জাসদের বিদ্রোহী কমিটির সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রথম আলোকে বলেন, দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে এই নির্বাচনে ভালো কিছু আশা করা যায় না। প্রার্থীরা একদিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে, অন্যদিকে তাঁদের ওপর নানামুখী চাপও আছে।
একই সঙ্গে সরকারে ও জাতীয় সংসদে বিরোধী দলে থাকা জাতীয় পার্টি ১২৭টি ইউনিয়নে প্রার্থী দিয়েছে। পার্টির শক্ত প্রার্থী থাকা কিছু ইউনিয়নে প্রার্থীরা চাপের মুখে আছেন। দলের কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজই (রোববার) আমরা বেশ কয়েকটি অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছি। পুলিশ প্রশাসনকে জানান হয়েছে। কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষ থেকে লোভ, ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের ভূমিকায় বোঝা যাবে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) চারটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী দিয়েছে। নির্বাচনের হালচাল সম্পর্কে পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন এই নির্বাচনে হবে না। তিনি বলেন, এটাকে নির্বাচন না বলে টাকা ও পেশিশক্তির খেলা, ছলচাতুরী ও প্রশাসনের কারসাজি বলা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়াটা বড় কথা নয়। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সবার চাওয়া।