আর মাত্র কয়েক দিন পরেই বাংলাদেশের জন্মদিন অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। আসছে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ ৪৫ পেরিয়ে ৪৬ বছরে পা দিতে চলছে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে দেশপ্রেমিকদের সাহসী ও শক্তিশালী পদক্ষেপ যুদ্ধে অংশগ্রহণ। দীর্ঘ নয় মাসের সেই মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ বাঙালির জীবন ও দুই লাখ বাঙালি নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আজ প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের গর্ব। আর মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাস। এই ইতিহাস নতুন করে স্থায়ী একটি রেখা আঁকে বিশ্বের মানচিত্রেও। ইতিহাস ঘিরে প্রাপ্ত বিশ্ব মানচিত্রে অঙ্কিত বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই চিরকাল।
সময়ের চাকায় নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে দেশ ও প্রশাসনের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের যারা ১৯৭১ সালে শিশু ছিলেন কিংবা যুদ্ধপরবর্তীকালে স্বাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁদের কোনো স্মৃতি অথবা বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। তবে তারা বিভিন্নজনের লেখা পড়ে, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ও চলচ্চিত্র দেখে, কাছের মানুষের মুখে গল্প শুনে জেনে নিচ্ছেন দেশের ইতিহাস। কিন্তু গল্পে মাঝে মাঝে ভর করছে জুজুবুড়ি ও ইতিহাসের পাতায় ধরেছে উইপোকা। বিকৃত হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস কিছু প্রতারকদের মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই প্রতারকেরা আমাদেরই খুব কাছের কেউ না কেউ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম কীভাবে ইতিহাসের সত্যতা যাচাই করবেন এবং কীভাবে নিজেদের কাছের মানুষদের উপেক্ষা করেও সত্য ইতিহাসকে অক্ষুণ্ন রাখতে সহায়তা করবেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে তাঁদের সহযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের আকাশে একগুচ্ছ উজ্জ্বল তারকা হয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন। তাঁদের আর একটি বড় অংশ কর্মজীবনে অবসর নিয়েছেন অথবা অবসর নেওয়ার প্রস্তুতি পর্ব অতিক্রম করছেন। তবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সকলেই দেশের লাল সবুজ পতাকার লাল বৃত্তের একটি অংশ হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। আর তাঁদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশের সর্বকালের নতুন প্রজন্মের।
সময়ের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে যতই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমে আসছে, ততই ব্যক্তি স্বার্থে আবৃত একটি কালো ছায়া দেশের ইতিহাসকে গ্রাস করে পাল্টে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থে তারা ভুল তথ্য প্রচার করে সাধারণ জনগণ ও নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করছে সুনিপুণভাবে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা। তাই তাদের হিসাবটাও সম্পূর্ণ উল্টো। তাদের মতে, দেশ থেকে দল বড়, দলের থেকে বড় ব্যক্তি। যার বহিঃপ্রকাশ তাদের কাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে।
তারা স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে তথ্যহীন বিতর্ক সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত থাকেনি। জাতির শোক দিবস ১৫ আগস্টকে বানিয়েছে মিথ্যা জন্মদিন। এরপরেও আছে ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাস্তা, সেতু ও স্থানের নতুন নামকরণ। এখনো পাকিস্তানের পক্ষে মতামত দেয় তারা প্রকাশ্যে। অথচ তারাই ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্প অর্পণ করে লোক দেখানো শ্রদ্ধা দেখায়। এরা সময়ের সঙ্গে খোলস পরিবর্তন করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করছে।
মিথ্যা প্রচার সহজ হয় সত্যের অবর্তমানে। সুতরাং সেই সুযোগ ব্যবহারের সময় এখনো বাংলাদেশে আসেনি। কারণ এখনো বেঁচে আছেন সব থেকে কঠিন সত্য, বীরাঙ্গনা মায়েরা। বেঁচে আছেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক প্রতারকদের ভিড়ে হয়তো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা কখনো কঠিন বলে মনে হয়। তবে নতুন প্রজন্ম পারে না এমন কিছু নেই। তাঁদের জন্য শুধু দরকার হয় সঠিক পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিকৃত ইতিহাস থেকে মুক্ত রাখতে প্রতিটি দেশপ্রেমিককে এগিয়ে আসতে হবে। সঠিক ইতিহাস জানার জন্য দেশের নতুন প্রজন্মকেও এগিয়ে আসতে হবে নিজেদের ইচ্ছায়। কেবলমাত্র পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বহমান স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে দিন পার করলে দেশের ইতিহাস রক্ষা হবে না। স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতকারীরা কিন্তু আমাদেরই বন্ধু, প্রতিবেশী, পরিচিত ও পরিবারের মানুষজন। নিজের কাছের মানুষদের দেওয়া তথ্য ভুল কিংবা সন্দেহমূলক হলে নতুন প্রজন্মের কর্তব্য হবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা এবং তাঁদের থেকে ইতিহাস জানা। তবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা চেনার কিছু সহজ পদ্ধতি নতুন প্রজন্মকেই বের করতে হবে। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি; একজন সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর তাঁর প্রথম পরিচয় স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং ইতিহাসে তিনি একজন বিজয়ী যোদ্ধা। মাঠে নামলে এমন আরও অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। তবে সে জন্য দরকার হবে সুশিক্ষা ও বিবেকের সঠিক ব্যবহার।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন ও ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ-এগুলো সফল হয়েছে, ইতিহাস তৈরি হয়েছে। কারণ এগুলোতে নতুন প্রজন্ম জড়িয়ে ছিল ওতপ্রোতভাবে। তাই কালের বিবর্তনে নতুন করে নতুন প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে সত্যকে রক্ষা করতে এবং সুন্দরভাবে তা প্রতিষ্ঠিত করতে। তারাই কেবল রোধ করতে পারবেন সকল স্বার্থান্বেষীদের অশুভ ছায়া।
নতুন প্রজন্মকে অনুরোধ করছি, দেশ ও দেশের মানচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে সঠিক ইতিহাস জানুন। প্রতারকদের মিথ্যা আবদার ও ঘুণে ধরা কালোছায়া মুছে ফেলে দেশ ও জাতির দায়িত্ব বুঝে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে রক্ষা করুন। আপনাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ ও বোধগম্য করে তুলুন। আপনারাই দেশের ভবিষ্যৎ। একাত্তরের অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব এখন আপনাদেরই।