এদিকে হুমকির শিকার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তাদের ঘনিষ্টজনদের অভিযোগ, হুমকিদাতাদের শনাক্ত এবং তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের তেমন তৎপরতা নেই। এ নিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করেও অনেকে হুমকিদাতাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। বরং কেউ কেউ পাল্টা পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছেন। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। যা ভুক্তভোগীদের অনেকে প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে হুমকি দেয়ার ঘটনা পুলিশকে জানানোর পরও কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা বিষয়টিকে অত্যন্ত ‘দুঃখজনক’ বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন বলেন, হুমকিদাতারা আটক না হওয়ায় এ ঘটনা বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া হুমকি পেয়ে অনেকে থানায় যেতে অনীহা প্রকাশ করছে বলে মনে করেন ওই শিক্ষক নেতা।
যদিও রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের দাবি, হুমকিদাতাতের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তাদের মোবাইল ফোন নাম্বার ট্রাক করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ সিম হুমকি দেয়ার পরপরই বন্ধ করে দেয়ায় এবং তা অনিবন্ধিত হওয়ায় হুমকিদাতাতের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিকের অভিযোগ, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার এবং এর কয়েকদিন পরই রংপুরে জাপানি নাগরিক হোসে কোমিও খুনের পর সাময়িকভাবে নিরাপত্তায় জোরদার করা হলেও তা এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। খোদ ডিপ্লোমেটিক জোন গুলশান-বারিধারার নিরাপত্তা স্তর আগের মতো ঢিলেঢালা পর্যায়ে নেমে এসেছে।
অথচ গত বছরের ডিসেম্বরেও বাংলাদেশে ভ্রমণ-সতর্কতা জারি করে যুক্তরাজ্য। এতে বলা হয়, পশ্চিমাদের ওপর আরো হামলা হতে পারে এবং তা নির্বিচারে হতে পারে। বাংলাদেশে সন্ত্রাসের উচ্চমাত্রার ঝুঁকি রয়েছে বলেও বাংলাদেশে অবস্থান ও ভ্রমণরত ব্রিটিশ নাগরিকদের হুশিয়ার করা হয়।
এর একদিন পরই প্রায় অভিন্ন সতর্কতা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। ওই সতর্কবার্তায় বলা হয়, ডিসেম্বরের শেষদিকে বিশেষ করে নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।
এর আগে ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ ভ্রমণে নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এতে বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মার্কিনদের যথাযথ সাবধানতা ও উচ্চপর্যায়ের নজরদারি রাখতে বলা হয়। এ সতর্কতা ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে জানানো হয়েছিল।
এ ছাড়া বাংলাদেশে স্বল্পদিনের ব্যবধানে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পর ইতালি, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও হংকং সতর্কতা জারি করে। যা অদ্যবধি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছে বলে সেদেশের গোয়েন্দারা একাধিকবার অভিযোগ তুলেছে। ২০১৪ সালের শেষভাগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশি অন্তত ৪ জন জঙ্গি জড়িত রয়েছে বলে সেদেশের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) অভিযোগ তোলে। যদিও এ ব্যাপারে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য বাংলাদেশকে দেয়নি।
গত ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর বোমা বানাতে গিয়ে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে শাকিল আহমেদ ও সুবহান ম-ল নামে দুই জঙ্গি নিহত হন। ভারতের পুলিশের বরাত দিয়ে সে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে দাবি করা হয়, নিহতরা বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য।
এ ছাড়া বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন পরিচয়ে ভারতে দীর্ঘদিন অবস্থান করে বলেও দেশটির বিভিন্ন পর্যায় থেকে অভিযোগ তোলা হয়।
এদিকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ২৬ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠায় সিঙ্গাপুর সরকার।
সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ওই ২৬ জন ‘জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাসী একটি গোপন পাঠচক্রের’ সদস্য ছিলেন। আল-কায়েদা নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির মতো ব্যক্তিদের প্রচার করা মতাদর্শের ‘চর্চা’ করতেন তারা। আল-কায়েদা এবং ইরাক-সিরিয়ার উগ্রপন্থী দল আইএসের সশস্ত্র জিহাদের মতাদর্শেও তাদের ‘সমর্থন’ ছিল। এর বাইরে আরো একজন বাংলাদেশিকে সিঙ্গাপুরে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি ওই চক্রের সদস্য না হলেও ‘জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলেন’ বলে সিঙ্গাপুরের ভাষ্য।
অন্যদিকে গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথমভাগে মালেয়শিয়া পুলিশ মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক বাংলাদেশিসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। দেশটির পুলিশ বিভাগের প্রধান খালিদ আবুবকরের দাবি, গ্রেপ্তারকৃত ওই ৫ জন বিদেশে জঙ্গি কার্যক্রমে অংশ নিতে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। তারা মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে সিরিয়াভিত্তিক আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করতেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র, ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামও সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন, তাদের তালিকায় থাকা মোস্ট ওয়ান্টেড ৫ জঙ্গি মালেয়শিয়ায় পালিয়ে গেছে। তারা স্টুডেন্ট ও ভ্রমণ ভিসায় দেশত্যাগ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব জঙ্গি দেশে অবস্থান করা জঙ্গিদের সংগঠিত করার জন্য অর্থসহ নানা ধরনের সহায়তা করছে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বাংলাদেশি জঙ্গিদের বিদেশে আত্মগোপন করে দল সংগঠিত রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার খবরে শুধু দেশবাসীই নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলও উৎকণ্ঠিত।
এদিকে বিভিন্ন সময় সংঘটিত বিভিন্ন হামলার দায় স্বীকার ও বিশিষ্টজনদের হুমকিদাতা হিসেবে আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর নাম আসার বিষয়টিও উদ্বেগজনক বলে স্বীকার করেন তারা।
প্রসঙ্গত, ২১ জানুয়ারি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ নাটোরের তিন সাংসদ, সাংবাদিক ও বিশিষ্টজনদের হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-১১ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তারা রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলায় প্রথম আঘাত হানবে। আর আঘাতের প্রথমেই যাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে তাদের একটি প্রাথমিক তালিকা দেয়া হলো। পরে আরো একটি নামের তালিকা দেয়া হবে বলেও ওই হুমকিপত্রে উল্লেখ করা হয়।
এর আগে রাজশাহীতে ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান, রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি ইকবাল বাহার, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হায়াত, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও কথাশিল্পী অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকসহ বিশিষ্ট আট ব্যক্তিকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। আনসার আল ইসলাম (আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ) নামে সংগঠনটির প্যাডে হত্যার এই হুমকি দেয়া হয়। হুমকির শিকার ব্যক্তিরা থানায় নিরাপত্তা চেয়ে মামলাও করেছিলেন।
২০১৫ সালের ১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মু. এন্তাজুল হক এবং পরিবেশবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক আজিজুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়। দুজনকে একই নাম্বার থেকে ফোন করে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়।
এর মাত্র ৪ দিন আগে চরমপন্থী গ্রুপ পরিচয় দিয়ে চাঁদা দাবি ও হুমকি দেয়া হয় রাবির দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমীন হামিদ ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানীকে। দুজনকে যে নাম্বার থেকে ফোন করে চাঁদা দাবি করা হয়, সেই একই নাম্বার থেকে ৬ মার্চ ফোন করা হয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আখতার ফারুক ও একই বিভাগের অধ্যাপক আজাহার আলীকে।
গত বছরের ১৬ মার্চ লাল বাহিনীর কমান্ডার পরিচয়ে চাঁদা দাবি করা হয় দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আনিসুজ্জামানের কাছে। ২১ মার্চ হুমকি দেয়া হয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মজুমদারকে। ২২ মার্চ লাল বাহিনীর পরিচয়ে হুমকি দেয়া হয় ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর এ এইচএম সেলিম রেজাকে।
ওই বছরের ১০ জুলাই রাতে রাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রশাসক ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদীকে মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করা হয়। ‘জনযুদ্ধের কমান্ডার মেজর জিয়া’ পরিচয়ে হুমকি দেয়া হয়।
‘সর্বহারা পার্টি’র সদস্য পরিচয়ে চাঁদা চেয়ে ২৭ নভেম্বর হুমকি দেয়া হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাশেম, ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ শাফি ও অধ্যাপক মো. মাহবুবর রহমানকে। অধ্যাপক মাহবুবর রহমানের স্ত্রী তাহদিনা নাজনীনকেও হুমকি দেয়া হয়।
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি আবারো চার শিক্ষকের কাছে চাঁদা দাবি করে হুমকি দেয়া হয়েছে। এরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিধান চন্দ্র দাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. আজিজুল হক, একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শাহ্ মখদুম হলের প্রাধ্যক্ষ ড. জাহাঙ্গীর আলম এবং এনিমেল হাজবেন্ড্রি অ্যান্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এসএম কামরুজ্জামানকে।
সম্প্রতি চাঁদা চেয়ে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (ডিআইজি প্রিজন, হেডকোয়ার্টার) কর্নেল একেএম ফজলুল হককেও হুমকি দেয়া হয়েছে। ‘সর্বহারা পার্টি’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য পরিচয়ে তাকে এই হুমকি দেয়া হয়। এরপর রাজধানীর চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেছেন ডিআইজি প্রিজন।
এসব হুমকিদের প্রায় সবাই অধরা রয়েছে। হাতেগোনা যে দু-চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে তাদের নেপথ্যে কারা তা রহস্যজালেই ঘেরা।