২০১৭ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার নতুন পদ্ধতির প্রশ্নকাঠামো কেমন হবে এ বিষয়ে এখনো সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পায়নি শিক্ষা বোর্ডগুলো। ফলে নতুন প্রশ্নকাঠামো সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই শিক্ষকদের। এদিকে অভিভাবকরাও বুঝতে পারছেন না তাদের সন্তানদের কী পড়াবেন বা কীভাবে দিকনির্দেশনা দেবেন। সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে ওই বছরের প্রায় ১৬ লাখ এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থী। কারণ তারা জানেই না কীভাবে শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ এ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে।
বিদ্যমান প্রশ্নকাঠামো অনুযায়ী মাধ্যমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ (বহুনির্বাচনী) প্রশ্ন থাকে ৪০ এবং লিখিত (সৃজনশীল) প্রশ্ন থাকে ৬০ নম্বরের। লিখিততে ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এজন্য দুই ঘণ্টা ১০ মিনিট এবং ৪০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরের জন্য ৪০ মিনিট রেখে ১০ মিনিট দেওয়া হয় বহুনির্বাচনী আর লিখিত পরীক্ষার মাঝে বিরতি। অর্থাৎ মোট তিন ঘণ্টায় শেষ করা হয় পরীক্ষা।
সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৭ সালে এমসিকিউতে ১০ নম্বর কমিয়ে লিখিত পরীক্ষায় ১০ নম্বর যোগ করা হবে। অর্থাৎ এমসিকিউ হবে ৩০ নম্বরের আর লিখিত পরীক্ষা হবে ৭০ নম্বরের। আগামী বছর থেকে পূর্বের ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্নের সঙ্গে আরও একটি যোগ করে সাতটি সৃজনশীল প্রশ্ন রেখে নতুন প্রশ্নকাঠামো তৈরি করা হবে। তবে এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন রূপরেখা এখনো চূড়ান্ত করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এদিকে সাতটি সৃজনশীল প্রশ্নের বিরোধিতা করে দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও মিছিল করছে। কোথাও আবার সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডে স্মারকলিপি দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
নতুন প্রশ্নকাঠামো পদ্ধতি বাতিলের দাবি করে পরীক্ষার্থীরা জানায়, সাতটি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নিয়ম চালু করা এক অর্থে তাদের ওপর জুলুম করা। কারণ হিসেবে তারা জানায়, ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্ন লিখতে আগে দুই ঘণ্টা ১০ মিনিট বা ১৩০ মিনিট সময় দেওয়া হতো। অর্থাৎ প্রতিটি প্রশ্নের জন্য সময় বরাদ্দ ছিল প্রায় সাড়ে ২১ মিনিট। কিন্তু নতুন পদ্ধতিতে একটি প্রশ্ন যোগ করে সময় বাড়ানো হয়েছে মাত্র ১০ মিনিট। এর ফলে কেউই সব প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দিতে পারবে না। পরীক্ষার্থীরা এ পদ্ধতি বাতিল করে পুরনো পদ্ধতিই বহাল রাখার দাবি জানায়।
ধানম-ি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের কয়েক অভিভাবক বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত এখনো গোপন কেন? স্কুলের শিক্ষকরাও জানেন না, কয়টি প্রশ্ন আসবে। তাহলে কীভাবে ছেলেমেয়েরা প্রস্তুতি নেবে?
এদিকে কয়েক শিক্ষক জানান, ছয়টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে একজন পরীক্ষার্থীর হাত ব্যথা হয়ে যায়। আরও একটি বাড়লে পরীক্ষার্র্থীদের ওপর চাপ অনেক বেড়ে যাবে। তারা আরও বলেন, যে বয়সী ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তাদের টানা দুই-তিন ঘণ্টা লেখার জন্য অনেক স্ট্যামিনা প্রয়োজন। তাই সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের বয়স, মেধা, শারীরিক শক্তি সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
গত ১ মার্চ ঢাকা ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে এসব বোর্ডের অধীন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২০১৭ সালের পরীক্ষার্থীরা। এর আগে দিনাজপুর, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীতে শিক্ষার্থীরা সাতটি সৃজনশীল প্রশ্ন রাখার প্রতিবাদ জানায়।
বিষয়টি নিয়ে বিব্রত শিক্ষা বোর্ড ও স্কুলগুলোর শিক্ষকরা। কারণ তাদের কাছেও বিষয়টি অস্পষ্ট। সরকারের এ-সংক্রান্ত কোনো নোটিশ/চিঠি/নির্দেশনা এখনো হাতে পাননি বলে জানান তারা। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছেন, তারা সরকারের কাছে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি তুলে ধরবেন। এ বিষয়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ গতকাল আমাদের সময়কে জানান, ২০১৭ সালের পরীক্ষার প্রশ্নকাঠামো নিয়ে কোনো নির্দেশনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়নি। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সম্পর্কিত একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানি। আর প্রশ্নকাঠামো তৈরি করবে এনসিটিবি।
এদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে ২০১৬ সালের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কোনো বিষয়ের প্রশ্ন-মানবণ্টন পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, নতুন প্রশ্নকাঠামো নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ বিষয়ে আরও বৈঠক হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) চৌধুরী মুফাদ আহমেদ জানান, নতুন প্রশ্নকাঠামো সম্পর্কে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। এটি বাস্তবায়নের রূপরেখাও চূড়ান্ত হবে। আমিও একজন অভিভাবক। পরীক্ষার এখনো অনেক সময় বাকি। তাই এত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এদিকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমরা সৃজনশীল যখন চালু করেছি, অনেকে এর বিরোধিতা করেছে। মুখস্থনির্ভর লেখাপড়া থেকে বেরিয়েছে ছেলেমেয়েরা। আমাদের অভ্যাসগত বিষয় আছে যে, সব সময় নতুন কিছুকে ভয় পাওয়া। একে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ছয়-সাতটি প্রশ্ন হলে তার সময় কীভাবে দেওয়া হবেÑ এ সবকিছুই ঠিক করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছর অক্টোবরে শিক্ষামন্ত্রী নিজ মন্ত্রণালয়ে ২০১৭ সালের প্রশ্নকাঠামো-সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্নে ১০ নম্বর কমবে। এই ১০ নম্বর যুক্ত হবে সৃজনশীল অংশে।
২০১৬ সালে ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায়। আগামী বছরও প্রায় সমসংখ্যক শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেবে বলে জানা গেছে।