বিশ্বাস ভঙ্গ, প্রতারণা, চুরি, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও মিথ্যা পরিচয় সংক্রান্ত প্রায় ২০ হাজার মামলা নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছে দুদক। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কেরানি, নিরাপত্তা প্রহরী, ভৃত্য, চাকর, কাজের বুয়াদের বিরুদ্ধে এসব মামলা তদন্তে হিমশিম খাচ্ছে তদন্তকারীরা। দণ্ডবিধির ৪০৬/৪০৮/৪২০/৪১৯/৪২০ /৪৬২-এ/৪৬২বি/৪৬৫/৪৬৬/৪৬৭/ ৪৬৮/৪৭১ ধারার মামলাগুলোর কোনো কূলকিনারাই করতে পারছে না। তদন্ত শেষে দেখা যাচ্ছে এসব মামলার শতকরা ৯৫ ভাগই হয়রানিমূলক, শত্রুতা সাধন ও উদ্দেশ্যমূলক।
দুদকের মূল উদ্দেশ্য যেখানে দুর্নীতি দমন এবং প্রাতিষ্ঠানিক বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা উদঘাটন, সেখানে এসব ছেঁচকা চুরি ও প্রতারণার মামলা তদন্ত করতে গিয়েই অধিকাংশ কর্মকর্তাকেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। দীর্ঘদিনের দাবি ও বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সভায় দুদক ওইসব ছোটখাটো অপরাধ তদন্ত আইনের সংশোধনটি অনুমোদন হয়। পরবর্তীকালে সংশোধনীটি সংসদে উপস্থাপিত হলে সেটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রেরণ করা হয় সংসদীয় কমিটিতে। আট মাসেরও বেশি সময় ধরে সংশোধনীটি ওই কমিটিতে পড়ে থাকায় দুদক বেকায়দায় পড়ে রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞ ও দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যত দ্রুত সংশোধনটি সংসদে পাস হবে, ততই দ্রুত দুদক ওইসব মামলার প্যাঁচ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মামলায় মনসংযোগ করতে পারবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এ সংশোধনী আনা হয়। ওই সংশোধনীতে ফৌজদারি দণ্ডবিধি ৪০৮ (বিশ্বাস ভঙ্গ), ৪১৯ (মিথ্যা পরিচয়), ৪২০ (প্রতারণা), ১৬৫/৪৬৬ (৪৬২-এ/৪৬২-বি/৪৬৬/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ (জাল-জালিয়াতি)সহ বেশ কিছু ধারা দুদকের তফসিলভুক্ত করা হয়। এসব ধারায় সংঘটিত অপরাধের মধ্যে রয়েছে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কেরানি, নিরাপত্তা প্রহরী, ভৃত্য, চাকর, কাজের বুয়া কর্তৃক উল্লেখিত অপরাধ।
দণ্ডবিধির এসব ধারা দুদকের অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশে সংঘটিত সব জালিয়াতি, প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অপরাধজনিত বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ ও মামলার তদন্ত চলে আসে দুদকে। তফসিলভুক্ত হওয়ায় দুদকও অভিযোগ-মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত এড়াতে পারছে না।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, দুদকে এখন ৪০৮/৪১৯/৪২০/৪৬২-এ/৪৬২-বি/৪৬৫/৪৬৬/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/ ধারার মামলা রয়েছে ২০ হাজারের মতো। শুধু তিনটি ধারায় (দণ্ডবিধির ৪০৬/৪০৮/৪২০ ধারা) দায়ের হওয়া মামলা রয়েছে ৬ হাজার। তবে দুদক আইনের সংশোধনী মন্ত্রিপরিষদে নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়ায় এসব ধারার মামলা দুদকে আসা কমেছে। এর আগে যেসব মামলা এসেছে সেগুলোর তদন্ত করতেও হিমশিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা। তদন্তের পর প্রতিবেদন বেশির ভাগই যাচ্ছে আসামির পক্ষে।
মামলাগুলোর ৯৫ শতাংশই হয়রানিমূলক। অধীনস্থ কর্মচারীকে শায়েস্তা করা কিংবা ব্যক্তিগত শত্রুকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের মামলা করা হয়। ফলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তদন্তে নিরীহ আসামিদের খালাস দেয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকছে না। কর্মকর্তারা জানান, দুর্নীতি দমনে যেখানে দুদকের কার্যক্রম হওয়ার কথা দৃষ্টান্তমূলক, সেখানে ছোটখাটো অপরাধের অনুসন্ধান-তদন্ত নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সারাক্ষণ। ফলে গুরুত্বপূর্ণ বহু মামলায় সময় দিতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা। তারা আরও জানান, লঘুদণ্ডের এ ধারা তফসিলভুক্ত হলেও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে দুদক সরাসরি অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করছে না। থানা কিংবা আদালত থেকে আসা মামলাই শুধু তদন্ত করছে।
এ ধরনের কয়েকটি মামলার কেসস্টাডিতে দেখা যায়, এক মহিলা বিচারক তার ড্রাইভারের বিরুদ্ধে গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ডিজেল চুরির মামলা করেছেন। আমাকে বারবার চাপ দিচ্ছেন মামলাটিতে ড্রাইভারের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে। এতে ড্রাইভারের চাকরি চলে যাবে। মামলাটির তদন্তে নেমে আমি দেখলাম, ড্রাইভার গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ডিজেল চুরি করেনি। মূলত বিচারকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। কিন্তু দুর্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে ওই বিচারক মামলা করতে পারছেন না। এ কারণে তার বিরুদ্ধে যন্ত্রাংশ ও তেল চুরির অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারায় মামলা করেন। পরে মামলাটির ফাইনাল রিপোর্ট হয়।
মহিবুল আলম চাকরি করতেন কীটনাশক বিপণন কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে। বেশি বেতনে অন্য একটি কোম্পানিতে চাকরি পান। সেখানে যোগ দিতে ছেড়ে দেন চাকরিটি। কিন্তু পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বরং তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬ ধারায় ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঠুকে দেয় মামলা। মামলার ধারাটি দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় তদন্তের জন্য চলে আসে দুদকে। একজন উপ-সহকারী পরিচালক মামলাটি তদন্ত করছেন।
রাজশাহীর চালের আড়তের কর্মচারী মো. জনি। মালিক ছুটি না দেয়ায় না বলে তিনি চলে আসেন বাড়ি। আড়তের মালিক তার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগে দণ্ডবিধির ৪০৮ ধারায় থানায় মামলা ঠুকে দেন। তফসিলভুক্ত হওয়ায় পবা থানা পাঠিয়ে দেয় দুদকে।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের তরুণ আদিলউদ্দিন শেখ বিয়ে করেছেন রাজধানীর মাতুয়াইলে। কিছুদিন পর মেয়েপক্ষ জানতে পারে- আদিলউদ্দিনের আরেক স্ত্রী রয়েছে। এ নিয়ে বিসম্বাদ। বনিবনা না হওয়ায় একপর্যায়ে মেয়ে তালাকের নোটিশ পান। মেয়েপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, যে কাজী অফিসের স্বাক্ষরে তালাকনামা পাঠানো হয়েছে সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই। সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রার মেয়েপক্ষকে জানিয়ে দেন এই অফিসে তালাকটি রেজিস্ট্রি হয়নি। মেয়েপক্ষ আদিলউদ্দিনের বিরুদ্ধে দায়ের করে জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলা। মামলায় আসামি করা হয় নিকাহ রেজিস্ট্রারকেও। ধারা দুটি দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় তদন্তের জন্য চলে আসে দুদকে।
এ প্রসঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, যত দ্রুত ধারাগুলো দুদকের তফসিল থেকে বাদ দেয়া যাবে ততই মঙ্গল। তিনি বলেন, আমাদের আইনে মাঝে মধ্যে যে উদ্ভট সব সংশোধনী হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ২০১৩ সালের দুদক আইনের সংশোধনী। এ ধারার অপরাধ আগে পুলিশ তদন্ত করত। কেন এগুলো দুদকে আনা হল বোধগম্য নয়। যত দ্রুত ধারাগুলো দুদকের তফসিল থেকে বাদ দিয়ে আইনের সংশোধনী হবে- জনদুর্ভোগ তত দ্রুত কমবে। ড. শাহদীন মালিক বলেন, শুধু দণ্ডবিধির ৪০৬/৪০৮/৪২০/৪৬৭/৪৬৮ ধারাই নয়, প্রভাবশালীরা যে কোনো ধারায় সংঘটিত অপরাধের তদন্তেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। নিরীহরা আরও নিপীড়িত হচ্ছেন। হয়তো ভাবা হয়েছিল- দুদকে এলে মানুষের নিপীড়ন কম হবে। এ রকম হলে তো পুলিশের সব মামলাই দুদকে নিয়ে আসা উচিত। কিন্তু কথা হচ্ছে, দুদকের বিদ্যমান জলবল দিয়ে এসব অপরাধের তদন্ত করা সম্ভব নয়। জালিয়াতি, প্রতারণা, চুরি, মিথ্যা পরিচয় দেয়া আর দুর্নীতি এক কথা নয়। এগুলোও অপরাধ। তবে এসব অপরাধের তদন্তের জন্য বিশেষায়িত পৃথক সংস্থা গঠন করা যেতে পারে। তবু দুদকের তফসিলে ঠাঁই পেতে পারে না। এ কারণে আইনের সংশোধনী দ্রুত পাস হওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা আইনটির সংশোধনী পাসের অপেক্ষায় রয়েছি। বিশেষ করে কয়েকটি ধারা দুদকের কাজের পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। তফসিল থেকে আইনের ধারাগুলো বাদ না দিলে মামলার সংখ্যাগত দিক থেকে দুদক হালকা হতে পারছে না। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তেও বিঘ্ন ঘটছে।