মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন লড়াকু সৈনিক কক্সবাজারের মানুষ যাকে লোকমান মাস্টার নামে চেনে। বয়সের ভারে তিনি নুয়ে পড়েছেন। প্রায় ৫ বছর আগে তার স্ত্রী মারা যান। বর্তমানে তার ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে রয়েছে। সবাই সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ফলে ৭৯ বছর বয়সী এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার সময় কাটে এখন প্রায় নিঃসঙ্গ।
দেশের এই সূর্যসন্তানের জন্ম কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের উত্তর সোনাপাড়া গ্রামে। তবে জন্মের সঠিক দিনক্ষণ বলতে না পারলেও বয়স ৭৯ বলে জানান তিনি।
দেশের জন্য নিজের জান বাজি রেখে লড়াইয়ের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাননি কোনও সুযোগ-সুবিধা। অবশ্যই, মুক্তিযুদ্ধকালীন ভাতা পেলেও সরকারি গেজেটে তার নামটি ওঠেনি ভুলে। গেজেটের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে কোনও তদবিরও করতে পারেননি অর্থাভাবে। তাই মৃত্যুর আগে অন্তত গেজেটে নিজের নামটি দেখে যেতে চান এই বীর সেনানী।
একান্ত আলাপচারিতায় লোকমান হাকিম বলেন, ‘আমি ২১ বছর থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার প্রধান আয়ুব সরকার যখন সামরিক আইন জারি করেন, তখন বঙ্গবন্ধু কক্সবাজারের উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানী অরণ্য ঘেরা ছেংছড়ি গ্রামে এসে আশ্রয় নেন। আসাদ আলী নামের এক মাঝির সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে যখন কক্সবাজারে পৌঁছেন। তখন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে আমরা বঙ্গবন্ধুকে প্যালোরাম চাকমার বাড়িতে পৌঁছে দেই।’ এ পর্যন্ত বলে দম নেন জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে পড়া এই বীর। তারপর বলেন, ‘সে এক বিরাট ইতিহাস। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর সৌহার্দ্য পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছিও। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েছি। মা-বোনের ইজ্জত বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধে।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে যান এই লোকমান হাকিম। হয়তো মনে পড়ে যায় তার সোনালি যৌবনের কথা। ওই সময়ের কথাগুলোই মনে হতে থাকে। কিন্তু লোকমান হাকিম ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা বলেন না। বলেন, প্রিয় দেশের কথা। মুক্তিযুদ্ধের কথা। তারপর বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, জয়বাংলা স্লোগান এবং স্বাধীন বেতার কেন্দ্র ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সেই থেকে কক্সবাজার-বান্দরবান সেক্টরে ক্যাপ্টেন আব্দুস সোবহানের (অব.) নেতৃত্বে আমরা জগেন্দ্র লাল বড়ুয়া, পরিমল বড়ুয়া, আলী আকবর বাঙালি, মুফিজুর রহমান, জাফর আলম ও বাদল বড়ুয়াসহ অনেকেই অস্ত্র হাতে তুলে নেই।’
এ পর্যন্ত বলে আবাও থামেন। তারপর বলেন, ‘কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঈদগাঁও এবং ডুলাহাজরা ব্রিজে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করলে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটে যায়। বার-তারিখ মনে নেই, সম্ভবত ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের ৩ দিন পর। আমরা একটি পাহাড়ে অবস্থান করছিলাম। পাকহানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায় আমাদের ওপর। এ সময় হানাদারের গুলিতে আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আব্দুস সোবহান একটি চোখ হারান। এছাড়া লাবলং চাকমাসহ বেশ কয়েকজন শহীদ হন। তবে, সেই সব শহীদের অনেকেরই নাম-পরিচয় এখন মনে নেই।’ লোকমান হাকিম বলেন, ‘কি আশ্চর্য! শহীদ হলেন লাবলং চাকমা, আর হানাদার বাহিনী অপপ্রচার চালালো ক্যাপ্টেন আব্দুস সোবহান শহীদ হয়েছেন বলে। তারা চাইল, এতে করে যেন আমাদের মনোবল ভেঙে পড়ে।’
লোকমান হাকিম এবার একটু নড়েচড়ে বসেন। তারপর বলেন, আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধাকে হারিয়ে কিন্তু আমাদের মনোবন ভাঙেনি। আমরা ক্রোধে-ক্ষোভে দ্বিগুণ উদ্যোমে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকি। এরপর থেকে প্রতিটি যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের হাতে মার খেতে থাকে। এক পর্যায়ে উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সবাই একত্রে সংগঠিত হই। এ সময় উখিয়ার রুমখাঁ চৌধুরীপাড়া গ্রামের বখতিয়ার আহমদ চৌধুরী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছু ওষুধ কিনে দেন। সঙ্গে দেন ৪শ জাতীয় পতাকা। সেই পতাকা হাতে নিয়ে কক্সবাজার শহরে উদ্দেশে রওয়ানা হই আমরা। এরপর কক্সবাজার শহরের পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুস সোবহান। এ সময় তিনি কক্সবাজারকে শত্রু মুক্ত ঘোষণা করেন।’
দেশের স্বাধীনতার স্মৃতিচারণ করতে করতে একসময় থামেন লোকমান হাকিম। এরপর বলেন, ‘১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮২ সালে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেয়েছি। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা-ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু সরকারি গেজেটে অসাবধানতা বশত আমার নামটি আসেনি।’ গেজেটে কেবল নিজের নাম না ওঠার অভিযোগ করেন না, একই সঙ্গে সহযোদ্ধার কথাও বলেন। বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা জাফর আলমের নামও বাদ পড়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আর্থিক সংকট ও বয়সের চাপে সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাই, এখন একমাত্র আশা, অন্তত মৃত্যুর আগে যেন আমাদের নাম গেজেটে ওঠে। তাহলেই মৃত্যুর পরেও আত্মা শান্তি পাবে। শান্তি পাবে তার নতুন প্রজন্ম।’
যুদ্ধের গল্প শেষ হয়, আর শেষ করেন গেজেটে নাম না ওঠার দুঃখপর্বও। কিন্তু অভিযোগ তার শেষ হয় না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ ১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি। কিন্তু এত বছর পরেও রাজাকার মুক্ত দেশ পাইনি। এদেশে অসংখ্য রাজাকার লুকিয়ে আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গ্রাম-গঞ্জে। তাই, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছে। রাজাকারদের আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানাই।’