চামড়া ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছেন চট্টগ্রামের মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। মাঠ থেকে সংগ্রহ করা চামড়া কেনার যে দর হাঁকছেন আড়তদাররা তাতে পুঁজি হারানোর শঙ্কা ভর করেছে ফড়িয়া ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মনে। তবে কেউ কেউ অবশ্য ট্যানারি মালিকদের কাছে সরাসরি বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতে নিজেরাই লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেছেন।
এদিকে, ‘উপযুক্ত’ দাম না পাওয়ায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া ধরে রাখায় চট্টগ্রাম থেকে ঈদের দু’দিন পরও মাত্র ৩ লাখ চামড়া সংগ্রহ হয়েছে। এ বছর বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে পৌণে ৬ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন আড়তদারগণ।
ফড়িয়া ও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, বেঁধে দেয়া দামে চামড়া কিনতে নেমে শুরুতেই তাদের হোঁচট খেতে হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে অধিক দামে চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হতে দেখে একপর্যায়ে সকলেই প্রতিযোগিতা দিয়ে বেশি দামে চামড়া কিনতে শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে আড়তে গিয়ে তাদের পক্ষে লাভে চামড়া বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়ে।
অবশ্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির উপদেষ্টা ও সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, মাঠ পর্যায়ের চামড়া সংগ্রহকারীদের আগে থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল যেন গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৩০ থেকে ৩২ টাকা, মহিষের ২১ থেকে ২২ টাকা, খাসির চামড়া ১৭ টাকা এবং বকরির চামড়া সর্বোচ্চ ১২ টাকা দরে কেনেন।
কিন্তু মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বেঁধে দেয়া দামে চামড়া না কিনে নিজেরাও বিপদে পড়েছেন। আমাদেরকেও বিপদে ফেলেছেন। মুসলিম উদ্দিন বলেন, বড় আকারের একেকটি চামড়া সাধারণত ২১ থেকে ২২ বর্গফুটের হয়ে থাকে। সেই হিসেবে বড় আকারের একটি চামড়া বেঁধে দেয়া দরে সাড়ে ৬শ টাকায় মাঠ থেকে কেনার কথা। কিন্তু মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এই চামড়াই কিনেছেন ১১শ থেকে ১২শ টাকায়। লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে আরো দুই থেকে আড়াইশ টাকা খরচ আছে। সবমিলিয়ে চামড়ার দাম পড়বে ১৪শ থেকে সাড়ে ১৪শ টাকা। এখন এই দামে কি ট্যানারি মালিকেরা চামড়া কিনবেন? অন্যদিকে, ছোট আকারের চামড়াও মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অনেকে ৮শ থেকে এক হাজার টাকায় কিনেছেন। এগুলো নিয়ে এখন লোকসান দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
এবারে চামড়া যে দর বেঁধে দেয়া হয়েছে সেটিও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করে মুসলিম উদ্দিন বলেন, চামড়ার বাজারে মান বিবেচনায় গ্রেড রয়েছে এক নম্বর থেকে আট নম্বর পর্যন্ত। ঈদের এক সপ্তাহ আগেও সবচেয়ে নি¤œমানের (অষ্টম গ্রেডের) চামড়া ট্যানারি মালিকেরা কিনেছেন বর্গফুট প্রতি ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। সেখানে অতি উন্নতমানের (এক নম্বর থেকে পাঁচ নম্বর পর্যন্ত) কোরবানির কাঁচা চামড়ার দর কিভাবে ৫০ টাকা হয়, তা বোধগম্য নয়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, আমরা (আড়তদার) মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ক্ষতি লাঘবে নিজেরাও বেঁধে দেয়া দরের চেয়ে কিছু বেশি দরে কিনেছি। আশা করছি, ট্যানারি মালিকদের কাছে দরদাম করে বেশি দরে বেচতে পারব।
নগরীর একাধিক মৌসুমী কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, তারা মাঝারি গরুর প্রতিটি চামড়া কিনেছেন ৮শ থেকে ১ হাজার টাকায় এবং বড় চামড়া কিনেছেন ১২শ টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়। কিন্তু সেই চামড়া নিয়ে আড়তে নিয়ে দেখেন, আড়তদাররা যে দাম দিতে চাইছেন সেই দামে তারা কিনতেও পারেননি। কেনা দামের চাইতে চামড়াপ্রতি ৫শ থেকে ৮শ টাকা কম হাঁকছেন আড়তদারগণ।
আকবরশাহ থানাধীন বিশ্বব্যাংক কলোনির একটি এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক সাইফুল ইসলাম জানান, ‘মাদ্রাসার জন্য প্রতি বছরই কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে আবার কেউ অর্ধেক দামে এতিমখানাকে চামড়া দিয়ে থাকেন। গত ১০ বছর ধরে আমি এসব চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করছি। কিন্তু এবারের মতো খারাপ অবস্থা দেখিনি।’
একাধিক মৌসুমী ব্যবসায়ী বলেন, আন্তর্জাতিক দরপতনের দোহাই দিয়ে ট্যানারি মালিকেরা কারসাজির আশ্রয় নিয়ে চামড়ার বাজার অস্থির করে ফায়দা লুটতে চাচ্ছেন। যারা ধার দেনা করে চামড়া কিনেছেন তারা লোকসান দিয়ে সরে পড়েছেন। তবে যাদের সামর্থ্য আছে তারা আড়তে বিক্রি না করে উপযুক্ত দাম পাওয়ার আশায় চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। অতীতেও সরাসরি বিভিন্ন ট্যানারির এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে তারা কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত দাম পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন কয়েকজন মৌসুমী ব্যবসায়ী।
কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘ইতোমধ্যে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে আড়াই থেকে তিন লাখের মতো কোরবানির পশুর চামড়া চট্টগ্রামের আড়তে এসে গেছে। বিভিন্ন এলাকার কিছু চামড়া ব্যবসায়ী চামড়ায় লবণ দিয়ে রেখে দিয়েছেন পরে ভাল দামে বিক্রির আশায়।’
মুসলিম উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের দুটি ট্যানারি বন্ধ থাকায় আমাদেরকে ঢাকার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ঢাকার পোস্তা ও হাজারিবাগের ছোট ছোট ট্যানারি মালিকরা এখনও চট্টগ্রামের আড়তদারদের গত বছরের কোরবানির চামড়ার টাকা পুরোপুরি পরিশোধ করেননি।
চট্টগ্রাম চামড়া আড়তদার সমিতির নেতারা বলেন, এমনিতেই ‘বিশ্ব বাজারে চামড়ার দাম কম’ এই অজুহাতে ট্যানারি মালিকরা দাম কম দিচ্ছেন। এরমধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে লবণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। ঈদের দিন ১৪শ টাকায় এক বস্তা লবণ কিনতে হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় যে লবণের দাম ছিল সাড়ে ৫শ টাকা।