মনির, শাহেদ, সজল, আজিজ, উত্তম, লিটন, সাজু, শোয়েব, ফায়াদ, দিলাল, জিল্লুর, কামরান- একে একে ঊনচল্লিশটি নাম। যারা ছিলেন নিজ নিজ পরিবারে-সংসারে উজ্জ্বল, উচ্ছল স্বপ্নময় তরুণ; যে তরুণ চেয়েছিলেন প্রবাসে গিয়ে নিজের পরিবারে, সংসারে আরও স্বাচ্ছন্দ্য আনতে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রদত্ত সূত্রমতে, ১০ মে তিউনিসিয়ার উপকূলবর্তী ভূমধ্যসাগরের ঘটনায় বাংলাদেশের এ ঊনচল্লিশ তরুণ নিখোঁজ হয়েছেন।
ধারণা করা হচ্ছে, এ তরুণদের কেউই আর বেঁচে নেই। তাদের ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনাও নেই। আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো নিশ্চিত করেছে, ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে যাওয়া এ তরুণরা চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এ মর্মান্তিক দুঃসংবাদে স্বপ্ন দেখা পরিবারগুলোর চোখের জল ফেলে আহাজারি করা ছাড়া আর কিছ্ইু করার নেই। দৃশত কারও কাছে তারা বিচারও চাইতে পারছেন না। দালালের খপ্পরে পড়ে নিজেদের ভুলের জন্য তারা নিজেরাই যেন আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছেন।
১০ মে ভূমধ্যসাগরে যে করুণ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে গেল, তা আমাদের হৃদয় স্পর্শ না করে পারেনি। ওইদিনের ঘটনায় বিপদসংকুল ভূমধ্যসাগরে ৩৯ তরুণের করুণ মৃত্যু ঘটে আর মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান ১৪ বাংলাদেশি তরুণ। এ ঘটনায় ৬৫ অভিবাসন প্রত্যাশীর সলিল সমাধি ঘটে। বাংলাদেশের বাইরে আরও মৃত্যু ঘটে মিসর, মরক্কো এবং আফ্রিকার বেশ কয়েকজন ইউরোপ গমনেচ্ছু অভিবাসীর। যাদের মৃত্যু হয়েছে এবং যারা উদ্ধার হয়ে জীবিত ফেরত এসেছেন, তাদের সবারই স্বপ্ন ছিল ইতালিতে যাওয়া। সেই মিথ্যা স্বপ্ন সাজিয়ে দিয়েছিল মানব পাচারকারী চক্র। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে নৌকাযোগে ইতালির উদ্দেশে রওনা করানো হয় সেই স্বপ্নবিলাসী তরুণদের। অধিক মুনাফার আশায় মানব পাচারকারী চক্র নৌকাগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত মানুষ উঠানোর কারণেই সাগরের মাঝখানে ডুবে গিয়ে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপে মানব পাচারের এক বড় ও পরিচিত রুট ভূমধ্যসাগরের লিবিয়ার জোয়ারা উপকূল আর ইতালির ল্যাম্পেদুসা দ্বীপ। নিরাপত্তা রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এ পথে মানব পাচারের ঘটনা নতুন নয়। এ রুটে সাগরপথে লিবিয়া আর ইতালির মোট দূরত্ব তিনশ’ মাইলের মতো। এ দূরত্ব অতিক্রম করা বৈধভাবে খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এ পথ বরাবরই অবৈধভাবে গমনেচ্ছুদের জন্য বিপদসংকুল ভয়ানক কঠিন এক পথ। আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো বেশি লাভের আশায় মানুষগুলোকে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ প্লাস্টিক বোট অথবা অন্যান্য নৌযানে নিয়ে রওনা হয় আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। সেই ভয়ানক দুর্ঘটনার পুনঃচিত্রই ফের প্রদর্শিত হল।
ভূমধ্যসাগরে মানব পাচারের ঘটনায় করুণ মৃত্যৃ মোটেও নতুন নয়। এর আগেও এ ধরনের ঘটনা অনেকবার ঘটেছে- সেটা কখনও বড় আকারে, আবার কখনও ছোট আকারে। অনেক ঘটনা নীরবেও ঘটে গেছে। তবে বড় ঘটনাগুলোই বারবার আন্তর্জাতিকমহলসহ সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে। মানব পাচারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ পথটি কোনোকালেই নিরাপদ ছিল না, এখনও নয়। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্টও এ রুটে একইভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ২৪ বাংলাদেশি তরুণের সলিল সমাধি হয়েছিল। সেই দুঃখজনক ঘটনাও বাংলাদেশের ইতিহাসে লেখা রয়েছে।
এবারে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের পথ থেকে যারা বেঁচে এসেছেন, তারা গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন নির্মম সত্যগুলো। জাহাজে ওঠার আগে লিবিয়াতে অন্তত তিন মাস তাদের বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল; যেখানে খাওয়া-দাওয়া, শোয়া, টয়লেটের ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যেমনটি বিবিসির কাছে বলেছেন বেঁচে যাওয়া তরুণ সিলেটের সিজুর আহমেদ। ‘আমরা ছিলাম ১৫০ জন। একটি মাছধরা ট্রলারে করে আমাদের মধ্যসাগরে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ছোট প্লাস্টিক বোটে তোলা হয়। দুটি নৌকা ছিল। একটি নৌকায় তোলা হয়েছিল ৬০ জন, যে নৌকাটি ইতালি চলে যায়। আর আমাদের নৌকায় তুলেছিল ৮০ জনের ওপর। আমাদের ছোট নৌকাটি পাঁচ আঙুল পানির ওপর ভেসে ছিল। ঢেউ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা উল্টে গেছে। এরপর আমরা সাগরের পানিতে আট ঘণ্টা সাঁতার কেটেছি। উল্টে যাওয়া নৌকাটি ধরে আমরা ভেসেছিলাম। আমাদের ৮০ জনের মধ্যে প্রতি পাঁচ মিনিটে এক-একজন করে সাগরে তলিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে একজন একজন করে অর্ধেকেরও বেশি লোক হারালাম।’
বিবিসি প্রদত্ত রিপোর্টের তথ্যমতে, আইওএমের ২০১৭ সালে একটি জরিপে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেসব দেশের নাগরিক ইতালি ঢোকার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশিরা রয়েছেন সেরকম প্রথম পাঁচটি দেশের তালিকায়। সমুদ্রপথে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরিসংখ্যানবিষয়ক পরিদফতর ইওরোস্ট্যাটের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যেসব দেশের নাগরিক ইউরোপে সবচেয়ে বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেছে, সে রকম প্রথমদিকের দশটি দেশের তালিকাতেও বাংলাদেশ রয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এসব চিত্র মোটেও আমাদের জন্য সন্তোষজনক কিছু নয়; বরং বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক।
সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮১ শতাংশ বিমানযোগে ও ০.২১ শতাংশ সড়কপথে বিদেশে যায়। বাকি প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ বিপজ্জনক সমুদ্রপথ ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি দেয়। এ শ্রমিকদের ১০.৩৬ শতাংশ যাওয়ার সময় সীমান্তে আটক হয়, ৪৭.৫০ শতাংশ চরম মানসিক যন্ত্রণায় সময় পার করে, ১০ শতাংশ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়। একটি অংশকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হয়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রপথে বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের ৩৮.৯৬ শতাংশ নিয়মিত বেতন পায় না, ১৪.০৬ শতাংশ জেল খাটে, ২৮.৫১ শতাংশকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়, ১৫.২৬ শতাংশ বাইরে যেতে পারে না, ২৩.৭০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, ১০.৮৪ শতাংশের কাজের নিশ্চয়তা থাকে না এবং খাওয়া-দাওয়া ও স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগতে হয় ২১.২৮ শতাংশ শ্রমিককে। এদিকে রামরুর এক গবেষণায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে সমুদ্রপথে বিদেশ যেতে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হয়েছে। আবার পৃথিবীর বিভিন্ন কারাগারে ১৫-১৬ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি বন্দি আছে; বিশেষ করে ইউরোপে নেয়ার কথা বলে অনেককেই এখন লিবিয়ায় জেলে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।
এতকিছুর পরও বার বার কেন এ ভুল পথে চলা? আমাদের দেশে তো খরা, দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধবিগ্রহ নেই। আমরা তো সিরিয়া, আফগানিস্তান, বসনিয়া বা লিবিয়া নই। তাহলে কেন আমাদের তরুণরা মিথ্যা স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনিশ্চিত সমুদ্রযাত্রায় মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে। কার ভুলে, কিসের প্রলোভনে, কিসের আশায় ইউরোপ যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগরে বার বার জীবনহানির ঘটনা ঘটছে আমাদের তরুণদের। এবার ভূমধ্যসাগরে যে ৩৯ তরুণ নিখোঁজ হয়েছেন; তারা যে কেউ লেখাপড়া জানেন না, তা নয়। তরুণদের বেশিরভাগই লেখাপড়া জানতেন। নিখোঁজ হওয়া তরুণদের বড় অংশ সিলেট অঞ্চলের। এর বাইরে রয়েছে শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং নরসিংদী এলাকার।
শুধু যে নিছক বেকারত্বের কারণে তরুণরা ইউরোপে পাড়ি জমাতে চেয়েছিল, তা নয়। সলিল সমাধি হওয়া বেশিরভাগ পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল। মূলত অধিক আয়ের উদ্দেশ্যেই বেশিরভাগ তরুণ অবৈধপন্থায় ইউরোপ যেতে চেয়েছিল। আর সেই সুযোগটিই নিয়েছিল দালাল বা মানব পাচারকারী চক্র। নিখোঁজ হওয়া শরীয়তপুরের নড়িয়ার উত্তম দাসের মা কবিতা দাস ছেলের হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ শুনে বিলাপ করে বলেন, ‘বড়লোক হওনের নেশায় ছেলেটারে হারাইলাম।’ তরুণ উত্তম দাস সবে এইচএসসি পাস করেছিল। সামনে জীবন তৈরি করার অবিরত সুযোগ ছিল তার। কিন্তু দ্রুত বেশি টাকা আয়ের ইচ্ছার কাছে একটি পরিবারের সব স্বপ্ন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। হয়তো প্রতিটি পরিবারের গল্পগুলো কম-বেশি এরকমই।
অভিবাসন খাতে বর্তমানে আমাদের অর্জন ও সাফল্য অনেক। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এ খাতে ধীরে ধীরে সেবার মান, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। বর্তমানে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে শুধু সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম নয়, আন্তর্জাতিক অনেক নিয়ম-কানুন ও শর্তকে অগ্রাধিকার দিতে হয় ও মানতে হয়। তবে এও সত্য, এ খাতের সঙ্গে প্রকৃত উদ্যোক্তাদের বাইরে বিপুলসংখ্যক কথিত দালাল শ্রেণী রয়েছে; যারা বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে বিদেশে যেতে প্রলুব্ধ করে। এদের ফাঁদে পড়েই মানুষ নিঃস্ব-রিক্ত হয়। শুধু ইতালি বা ইউরোপ নয়, মালয়েশিয়াতেও অবৈধ পন্থায় সমুদ্রপথে বহুবার মানব পাচারের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। আমি মনে করি, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি আমাদের আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; যাতে করে আমাদের তরুণরা এ ভুলের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
দেশে তরুণদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান তৈরি করাসহ জনশক্তি পাঠানোর সক্ষমতা বাড়িয়ে এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। বন্ধ হওয়া আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কুয়েতসহ বিভিন্ন ট্রাডিশনাল শ্রমবাজারগুলোয় কর্মী পাঠানো, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। গার্মেন্ট, চামড়া, পাট বা কুটির শিল্পের মতো জনশক্তি খাতকে শিল্পখাত হিসেবে ঘোষণা করে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তাদের সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে হবে। ১২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির উদ্যোক্তাদের সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ট্রেনিং সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ, স্বল্পসুদে ঋণ, ট্রেনিং যন্ত্রপাতি শুল্কমুক্ত করা এবং উদ্যোক্তাদের হয়রানি বন্ধ করাসহ একটি প্যাকেজ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে পারলেই দালালদের খপ্পরে পড়ে মিথ্যা স্বপ্নে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেবে না তরুণরা। তখন হয়তো আমাদের দেখতে হবে না, সমুদ্রে ডুবে অথবা দুর্গম জঙ্গল পাড়ি দিতে গিয়ে কোনো তরুণের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আর স্বপ্নভঙ্গের করুণ দৃশ্য। তখন হয়তো বা আর শুনতে হবে না মানব পাচারের লোমহর্ষক কাহিনী।