বিশ্বব্যাপী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সমর্থকরা মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান তাকে ছাড়া সম্ভব নয়। গত এক বছরে তিনি ক্রমাগত ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও এ ধারণা ঠিকই। তবে জাতিসংঘ মিশনের প্রতিবেদন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সিদ্ধান্তের পর সু চি এখন তার সরকারের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।রোহিঙ্গা ইস্যুতে সঠিক কাজটি করার এটিই হয়তো তার জন্য শেষ সুযোগ।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে এক লেখায় এমন অভিমত ব্যক্ত করেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসির (সিজিপি) জ্যেষ্ঠ ফেলো ড. আজিম ইব্রাহিম। ‘দ্য রোহিঙ্গা : ইনসাইড মিয়ানমার’স হিডেন জেনোসাইড’ নামে তার একটি বইও রয়েছে।রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির রয়েছে বলে বৃহস্পতিবার আদালতটি ঘোষণা দেন। এটিকে ইতিহাসের পাতায় নিজের ভূমিকাকে সঠিকভাবে তুলে ধরার সু চির সামনে শেষ সুযোগ বলে মনে করেন সিজিপির ওই গবেষক।আইসিসির ওই সিদ্ধান্তের অল্প কদিন আগেই জাতিসংঘের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ ৬ জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করার পরামর্শ দেয় মিশনটি। দেশটির সরকারকে ওই গণহত্যার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে অং সান সু চির তীব্র সমালোচনাও করা হয়।সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও দেশের রাজনীতির ধারা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই সু চির সরকারের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটের পুরোটা সময় সু চি ও তার সরকার তাদের ক্ষমতাকে সেনাবাহিনীর অভিযানের সমর্থনে কাজে লাগিয়েছে। আন্তর্জাতিক তদন্তের উদ্যোগ আটকে, ধ্বংসযজ্ঞের আলামত বিনষ্ট করে এবং রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের বক্তব্যকেই সমর্থন জানিয়ে গেছেন।তা সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই সু চির ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেননি। তারা মনে করেন, সু চির অবস্থান নড়বড়ে হলে দেশটি আবারও সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এখনো অনেকে এই মনোভাব ধরে রেখে রোহিঙ্গা সংকট ঘনীভূত হতে দেখছেন, আর আশা করছেন সু চি হয়তো শেষ পর্যন্ত ঠিক পথটি খুঁজে পাবেন এবং রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবেন। আবার জাতিসংঘের সদ্য সাবেক মানবাধিকার প্রধান জেইদ রা’দ আল হোসেনের মতো অনেকেই বলেছেন, সংকট নিরসনে হস্তক্ষেপ সম্ভব না হলে সু চি পদত্যাগ করে দেশের ভেতর সেনাদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন গড়ে তুলতে পারতেন।যা হোক, এখন সু চির সামনে সবচেয়ে বড় সুযোগ এসে হাজির হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন, আইসিসির সিদ্ধান্ত ও নিজের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় প্রবলভাবেই দাঁড়াতে পারেন।তার সামনে এখন এ পথই খোলা আছে। প্রথমত, তিনি গণহত্যা বিষয়ে আইসিসির সম্ভাব্য তদন্ত কার্যক্রমে তার সরকারের সহযোগিতার প্রস্তাব দিতে পারেন। নিশ্চিতভাবেই এটি তার জন্য খুব কঠিন হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে আবারও চাপের মধ্যে পড়েছেন তিনি। এবার তাকে ইতিহাসে সঠিক অবস্থানে থাকার সিদ্ধান্তটিই নিতে হবে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সহায়ক অনেকগুলো অনুঘটকও এখন তার পক্ষে রয়েছে। তিনি যদি মিয়ানমারের সত্যিকারের গণতন্ত্রে উত্তরণ চান, তা হলে উচিত হবে সামরিক বাহিনীর ওপর তার সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা।দ্বিতীয়ত, সু চির উচিত হবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার প্রতিকার বিধান করা। এভাবে মিয়ানমার ও নিজেকে বিশ্বের কাছে কলঙ্কমুক্ত করা। কফি আনানের নেতৃত্বাধীন জাতিসংঘের উপদেষ্টা কমিশনের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।গত কয়েক বছরে সু চির ভাবমূর্তির অবিশ্বাস্য পতন হয়েছে। এখন তার সামনে তার ভাগ্যনিয়ন্তা মুহূর্তটি উপস্থিত। এখন তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাতেই নির্ধারিত হবে তার পরম্পরা। নিজের জন্য, দেশের জন্য, রোহিঙ্গাদের জন্য সু চির উচিত হবে এই সুযোগ দুহাতে আঁকড়ে ধরা।