আল মাহমুদ
হারানো সোনার খনি
জীবনযুদ্ধে জয়-পরাজয় খেলা
সেখানে একদা চেয়ে দেখি শেষবেলা
আমার মুখের ওপরে লালের ছিটা
ছড়িয়ে দিয়েছে ভয়ের ভেতরে ভয়,
কি-বা আসে যায় যদি মানি পরাজয়।
বিজয় এখানে তুলেছে নতুন ধ্বনি
আমি কি এ দেশে হারানো সোনার খনি?
বহুদূর আমি এসেছি তো পার হয়ে
কত নদী কত পর্বত নাম ধরে
ডেকেছিল পিছে—আমি কি দাঁড়াতে পারি?
অবশেষে হাত ধরেছিল এক নারী।
যা কিছু আমার অতীত পেছনে ফেলে,
এসেছি এখানে একটি মশাল জ্বেলে।
আবিদ আনোয়ার
এলো-পদাবলি
কবিতা কোথায় তুমি কেঁদে মরে বঙ্গভূমি
কোথা সেই শব্দশর—তীব্র তীক্ষ্ণ তীর
বোধের গহন ফুঁড়ে বিঁধে যায় অন্তঃপুরে
অজানা ক্ষরণে হয় হৃদয় অস্থির
আধুনিকতার মানে শিল্পের ঈশ্বর জানে
সে-ও নয় অর্থহীন এলো-পদাবলি
অধরা অবোধ্য নয় সে-ও করে মন জয়
প্রায়শ পাপড়ির চেয়ে মূল্যবান কলি
বহিরঙ্গে লীলাবতী গহনে সমান সতী
অধুনা ও প্রাচীনতা বলে কিছু নাই
উত্তরাধুনিকে তুমি কী বাজাবে ঝুমঝুমি
তার তালে নেচে-নেচে একই গান গাই
চর্যার ধোঁয়াশা থেকে বঙ্গভাষা পেকে-পেকে
এত দূর এসে ফের ধরেছে পচন
কতেক নষ্টের হাতে কী বা আসে-যায় তাতে
যে খেলে খেলুক লয়ে স্বৈরিণীর মন
শাহ্নাজ মুন্নী
সাদা পৃষ্ঠা কিছু বলতে চায়
কাদার মধ্যে যেমন মাটি ও পানি জড়াজড়ি করে থাকে
সুষম মমতার জটিল অনুপাতে
ভাষার মধ্যে তেমন ভাষাহীন একা
শব্দের মাঝে শব্দহীন নীরবতা
শোনো, সাদা পৃষ্ঠাও কিছু বলতে চায়
পাথরকে ভালোবাসার অসম্ভবতা নিয়ে
অশরীরী কেউ হাঁটে আলাদা রাস্তায়,
হাঁটে ভিন্ন রং ও রেখায়,
উড়ে যায় রাত, গাছের শেকড়,
আমাদের বিনিদ্র চুম্বন কাতরতা
শ্বাস নাও,
চক্ষুকে দাও অন্ধকারে দেখবার ক্ষমতা
আসাদ চৌধুরী
শব্দগুচ্ছ, পুষ্পগুচ্ছ
চোখের সামনে
মালার ফুল পুড়ছে
সুরভি কি পোড়ে? জ্বলে?
সুগন্ধ নয়,
দগ্ধ-বিবর্ণ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে
কষ্ট পাচ্ছিলাম খুব।
দগ্ধ পুষ্পের পাশে
ছেঁড়াখোঁড়া অ্যালবাম
রেশমি ফিতে জড়ানো কাগজপত্র।
জোত-জমির দরকারি কাগজ নাকি তপ্ত নিশ্বাসের প্রেমপত্র?
হয়তো জরুরি ছিল একসময়,
এখন পুড়ছে।
আমার মতোই বেশ কয়েকজন
সম্ভবত তারও প্রতিবেশী
এই দৃশ্য দেখছিলেন
কোত্থেকে কে জানে
কয়েকজন তরুণ-তরুণী
ছোঁ মেরে তুলে নিল
ওই শব্দগুচ্ছ
কবেকার ভালো লাগা এই দুর্লভ দৃশ্যটি
ফুলের চেয়েও টাটকা ও তাজা।
রুবী রহমান
শিশু আজ ফেব্রুয়ারি
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন
সে কথা তো ভোলে না পলাশ আর শিমুলের বন
ফেব্রুয়ারি মাস এলে পর
প্রকৃতি লালে লাল করে তোলে
বাংলার নগর-অরণ্য-গ্রামান্তর
রাজপথে লাল রক্ত ঢেলেছিল বাংলার তেজদীপ্ত সাহসী তরুণ
সেই কথা মনে রেখে
গাছে গাছে সহস্র রক্তিম ফুল ফোটায় ফাল্গুন।
নিসর্গের নিয়মেই আমরা বাঁচি-মরি
শিশুর মাথায় তবু না-ফুটিয়ে গোলাপমঞ্জরি
আমরা তার করোটিতে ঢালছি সেঁকো বিষ
আর নাকে তেল দিয়ে ফাঁকা বুলি গাইছি অহর্নিশ।
মাহবুব কবির
তাঁতের শাড়ি
তাঁতের শাড়ি কিনে আনি।
তাঁতের শাড়িতে মায়ের গন্ধ, মানুষের গন্ধ।
তোমার শরীরে মেশিনের গন্ধ।
কে পরবে এই শাড়ি, মা তো নেই।
এই শাড়ি থাকুক আমার ঘরে, আমার ওয়ার্ডরোবে—
মায়ের গন্ধটুকু থাকুক আমার ঘরে।
মোহাম্মদ রফিক
মেলা
নানা বর্ণ বহু বর্ণ পাখি সার বেঁধে
এই সন্ধ্যাকালে
এসে বসে ছাতিমের বৃদ্ধ ভাঙা ডালে,
মিলেছে মেলায় তারা
কিছুক্ষণ আরামে আয়েশে বিচ্ছুরিত ঠোঁটে-ঠোঁটে
সংরাগে সংলাপে রসালাপে,
উচ্চকিত ডাল নড়েচড়ে, সাড়া দেয়
পলক না পড়তেই উড়ে যায়,
বৃদ্ধ ভাঙা ডাল একবার কেঁপে উঠে
তাকিয়ে রয়েছে শূন্যে-মহাশূন্যে, অতঃপর
স্থির নিষ্পলক কিছুটা বিমূঢ়,
ঘনিয়ে এসেছে রাত—ঠান্ডা, ভারী, কিমাকার, হিম;
আমি দেখি।
আলতাফ শাহনেওয়াজ
অন্ধকার
কত কাল পরে,
যখন তোমার আর আমার সম্পর্ক নেই কোনো,
স্পর্শ নেই;
আমরা ঘুরতে ঘুরতে বেড়াতে এসে
গ্রামে
ধানখেতের ভেতর দিয়ে
হেঁটে যাব;
অবেলার রোদ আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখবে
কিছুক্ষণ, পুরোনো ডায়েরিজুড়ে কে কী লিখে গেছি
মনে পড়বে। চিঠিগুলো কি ফিরিয়ে দেব?
তাপ নিয়ে কথা হবে নাকি সে মুহূর্তে?
ভীষণ রোদের মধ্যে, দুজন ভিলেজ পলিটিক্সে
ভরা ধানখেতে
খুব হাত ধরে
চলতে চলতে, এই গ্রামে পৌঁছে
কেউ কোনো কথাই বলব না, মনে হবে
আমরা প্রত্যেকে বানোয়াট, অদ্ভুত বানানো গল্প, কাল্পনিক চরিত্রের মতো;
যেন গ্রামেই যাইনি কোনো দিন!
রাসেল রায়হান
আলজিভ
সকল ভাষাই চিরআরাধ্য—তীব্র শারীরিক; অন্ধকার কোনো ফাঁদে
যেন কোনো পরিচিত ধ্বনি।
আমাদের মৃত সন্তানটির গাঢ় লাল জিভ বেরিয়ে আসার দৃশ্য
তুমি সহ্য করতে পারোনি।
তাকিয়ে ছিলাম তার আধবোজা পাপড়ির পানে, প্রসারিত কোনো দুই
ক্লান্ত ডানার নিচে। আর
তুমি কিছু সান্ত্বনা শুনতে চেয়েছ, উচ্চ স্বরে…নিরুত্তাপ সমস্ত ভাষার
তীব্রতাকে খুব খেলো মনে হয়, যখন তোমাকে ঠিক উত্তর দিতে পারছি না।
যেভাবে ত্রিমোড়ে—
প্রতিদিন ভিখিরিটি ডাক দেয়, আর এই পবিত্র শহরে
পবিত্র কোনো ভাষা নেই, শুধু মুদ্রার ভাষা। সে ভাষার আলজিভ
পুরোনো টিনের এক থালা—
জীর্ণ, জড়তাময়, লালসায় পূর্ণ—এ রকম তীব্র কোনো ভাষা
আমি তোমাকে বলার জন্য খুঁজি।