একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে প্রধান দুই প্রতিপক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ঐক্যফ্রন্টের একটি চিঠি এবং সেই চিঠিতে ইতিবাচক সাড়া জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ পাল্টে দিয়েছে সেই আবহ। সরকারবিরোধী জোট জাতীয় নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকেই সরকারকে আহ্বান জানিয়ে আসছিল সংলাপে বসার। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সংলাপের বিষয় উড়িয়ে দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাওয়া লেগেছে সংলাপের পালে। ইতোমধ্যে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে সংলাপের জন্য গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ খবরে উজ্জীবিত গোটা জাতি। দেশের মানুষের প্রত্যাশা, দেশের রাজনীতিতে যে বরফ জমেছে, সে বরফ হয়ত এবার গলবে। তবে সংলাপ অর্থবহ না হলে দুই পক্ষের মধ্যে সংকট আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। জানা গেছে, সরকারি দল ঐক্যফ্রন্টের কোনো দফা আমলে না নিলে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে সরকারবিরোধী জোট। সে ক্ষেত্রে ঢাকার জনসভা থেকেই আসবে আলটিমেটাম এবং শুরু হবে রাজপথের আন্দোলন।বিরোধী জোটের সঙ্গে সংলাপে বসছে সরকারি জোট। আজ সন্ধ্যা সাতটায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে দুই জোটের নেতারা আলোচনায় বসবেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজপথের সম্ভাব্য সহিংস রাজনীতি আলোচনার টেবিলে গড়ানোয় স্বস্তি ফিরেছেদেশজুড়ে। সকলের প্রত্যাশাÑ সংলাপ ফলপ্রসূ হোক এবং দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা বিরাজ করুক।একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আদালতের রায়ে বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া যখন চূড়ান্তভাবে দ-িত তখন অনেকটা দ্রুতগতিতে পাল্টাতে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন। দীর্ঘদিন সংলাপের বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থানে থাকা প্রধানমন্ত্রী সবাইকে চমকে দিয়ে এ আহ্বানে সম্মতি জানিয়ে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সংলাপ ও নৈশভোজের আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ জানান ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। দুই পক্ষের পারস্পরিক আমন্ত্রণের ভিত্তিতেই আজ সন্ধ্যায় শুরু হচ্ছে সংলাপ। যদিও সংলাপের ফল নিয়ে এখনো ধোয়াশা কাটেনি। কারণ শেষ সময় পর্যন্ত দুই জোটই পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকার দৃঢ়তা ব্যক্ত করে আজকের আলোচনার টেবিলে বসতে যাচ্ছেন। সরকারি দলের দাবি, আলোচনা যা-ই হোক, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের দাবি, সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার। পাশাপাশি নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিও দাবি করছে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক বিএনপি।ঐক্যফ্রন্টের সাত দফার প্রথম দাবি, ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’। আর সরকারি দলের ভাষ্য, এটি সংবিধানসম্মত নয়। সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধানসম্মত বিষয়ে আলোচনা হবে। বস্তুত, দুই পক্ষ বিপরীতমুখী অবস্থানে অটুট থেকেই সংলাপে বসতে যাচ্ছে।বিএনপি নেতারা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে সংলাপ নিয়ে আশাবাদী হতে পারছেন না তারা। কারণ একদিকে যখন সংলাপের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, অন্যদিকে তখন তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় হাইকোর্টে আরও বাড়ানো হয়েছে এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজার রায় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র গতকাল গ্রহণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকালও বিএনপির মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সব বিষয় সংলাপে আন্তরিক হওয়ার নমুনা হতে পারে না। বিএনপি মনে করছে, লোক দেখানো ও সময়ক্ষেপণের উদ্দেশে সংলাপে সম্মত হয়েছে সরকার।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, সংলাপে দুই পক্ষের দাবি দাওয়া নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি স্মৃতি রোমন্থনও হবে। কারণ গণভবনে যারা সংলাপে আসছেন, তাদের অনেকেই এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। সে সময়ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন। এ ছাড়া ঐক্যফ্রন্টের তিন প্রভাবশালী নেতা সুলতান মুহাম্মদ মনসুর ও মাহমুদুর রহমান মান্না দুজনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মোস্তফা মহসীন মন্টু ছিলেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান। জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘদিন পর দলের পুরনোদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় স্মৃতিচারণাও উঠে আসতে পারে সংলাপের ফাঁকে কিংবা নৈশভোজের টেবিলে।আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকবেন ২০ জন। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতারাও থাকবেন। গতকাল রাতে সর্বশেষ পাঠানো আওয়ামী লীগের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সংলাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অংশ নেবেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, কাজী জাফর উল্যাহ, ড. আব্দুর রাজ্জাক, রমেশচন্দ্র সেন, অ্যাড. আবদুল মতিন খসরু, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান ও দীপু মনি, দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম। এ ছাড়া সরকারি জোটের নেতাদের মধ্যে জাসদ একাংশের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদের আরেকাংশের কার্যকরী সভাপতি মইনুদ্দিন খান বাদল, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়–য়াও উপস্থিত থাকবেন।অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেবে সংলাপে। এ দলে রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও মির্জা আব্বাস। নাগরিক ঐক্য থেকে এর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও এসএম আকরাম। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু ও নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী। জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন, প্রেসিডিয়াম সদস্য তানিয়া রব। ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আ ব ম মোস্তফা আমিন ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।সংলাপে মূলত কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হবেÑ এমন প্রশ্নে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল বিকালে আমাদের সময়কে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার আমন্ত্রণপত্রেই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনা করবেন। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।একই বিষয়ে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গতকাল দুপুরে কারওয়ানবাজারের নিজ কার্যালয়ে আমাদের সময়কে বলেন, যে কোনো আলোচনায় বসার আগে অনেকেই অনেক দাবি করে থাকেন। কিন্তু তাদের কোন দাবিগুলো মানা হবে, আর কোনগুলো মানা হবে নাÑ সেটা নির্ধারিত হয় আলোচনার টেবিলে। গণভবনে নেত্রীর আমন্ত্রণে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ আশা করি ফলপ্রসূ হবে। তবে অসাংবিধানিক কোনো দাবি আওয়ামী লীগ মানবে না।এ দিকে সংলাপের আগের দিন অর্থাৎ গতকাল রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, সরকার একদিকে সংলাপের প্রস্তাব করছে, অন্যদিকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি করছেÑ এমন আচরণ সাংঘর্ষিক। এটি কখনোই গণতান্ত্রিক কোনো আচরণের প্রতিফলন ঘটায় না। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, দেশনেত্রীকে কারাগারে রেখে সংলাপ বা নির্বাচন কখনোই ফলপ্রসূ হবে না।মির্জা ফখরুলের এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, দুই মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার রায় আলোচনার পথে বাধা হবে না। কারণ, রায় প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ দেয়নি। লিগ্যাল ম্যাটারের সঙ্গে ডায়ালগের সম্পর্ক নেই। ডায়ালগ চলবে ডায়ালগের মতোই।নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, সংবিধানের বেড়াজাল সৃষ্টি করা হলে সংলাপ সফল হবে না। খোলা মন নিয়ে আলোচনা করতে হবে।একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সংলাপে নিজেদের অবস্থান চূড়ান্ত করতে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা গত দুদিন একাধিক বৈঠক করেছেন। ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কেন প্রয়োজনÑ এর বিস্তারিত লিখিতভাবে তুলে ধরবেন ড. কামাল।দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি ছাড়া সবগুলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গণভবনে সংলাপে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন খালেদা জিয়া। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে শুধু ঐক্যফ্রন্ট নয়, ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী নির্বাচনে সকল দল অংশগ্রহণ করুক, এমনটাই চান তিনি ও তার দল।
One thought on "সংলাপে বরফ গলবে তো"
Comments are closed.